কৃষ্ণ কমল রায়: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশ্বগ্রাম ধারণাটির বাস্তবায়নে নিঃসন্দেহে এক বিশেষ অবদান রেখেছে। বিশ্ব দরাবারে কোন এক ব্যক্তি বা সমাজ পরিচিত হতে পারে ক্ষণিকেই। ভালো -মন্দ দু’ভাবেই পরিচিত হতে পারে।
কিন্তু এই মণিহার আমাদের এই সমাজের গলায় সাজে না। মানবাধিকার – মানবিকতা এ সমাজে অনেকের হাতেই ভালো ব্যবসা মাত্র। অনেকে নিজে এই ব্যবসা করে, আর অনেকেই না বুঝেই তার বিজ্ঞাপন বিলিয়ে বেরায়। আমাদের সমাজ আজ এমনই এক জায়গায় এসে পৌঁছাছে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণের শিকার এক পরিবারের ছবি ভাইরাল করে লাইক, স্যাড ইফেক্ট গণনা শুরু করার আগে সত্য ঘটানা জানাটা বিশেষ প্রয়োজন ছিল। মানবিকতা প্রকাশে কিছু হাহাকার বাণী আর দুটি ছবি প্রকাশ করে বাহবা লুটেপুটে নিলো।
আরো ছবি ছিল। ঘটনা যা দুটি ছবিতে দেখলেন, শুনলেন তা সত্য কি না যাচাই করার প্রয়োজনও মনে করলেন না?
আমার অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী এক বিচারকের নিরূপায় ছবি দেখে আমাকেও জিজ্ঞেস করে বসল।
ফোন করে সেখানে কর্মরত বিচারক বন্ধুদের থেকে পুরো ঘটনা জেনে, দালিলিক প্রমাণ হিসেবে ছবি সংগ্রহ করলাম।
পরে জেনেই তাদের জানালাম।
হায়! এতোগুলো বিচারককে, মানুষকে, স্বজনকে মানবিকতার প্রশ্নবানে জর্জরিত করার আগে সত্য জানাটা প্রয়োজন ছিল।
আমি হলফ করে বলতে পারি অন্য যে কোন চাকুরির সহকর্মীর তুলনায় ভাতৃত্ব, সহমর্মিতা এই বিচার বিভাগেই বেশি রয়েছে।
আইন দ্বারা বাহিরের জগতে বিচরণ সীমিত করনের কারণে একই স্টেশনের অফিসারগন এবং তাদের পরিবারবর্গ সকলে ওতোপ্রোতভাবেই জরিত থাকে। সুখ- দুঃখ, আনন্দ- বেদনার ভাগাভাগিতে প্রতিযোগিতা চলে।
অন্য অনেক সার্ভিসে এক ব্যাচ সিনিয়র দের স্যার বা বস বলা হলেও এই সার্ভিসে সদ্য যোগাদান করা এক অফিসার কমপক্ষে ৭ বছর চাকুরীতে অতিবাহিত করা একজন যুগ্ম জেলা জজকে ভাই বলে সম্বোধন করেন।
এমনকি অনেক অতিরিক্ত জেলা জজ পদমর্যাদায় অধিষ্ঠিত অফিসার রয়েছেন যারা আজ পর্যন্ত স্যার ডাকতে দেননি আমাকে। পাছে ভালোবাসায় কিছু ভাটা পরে যায়! বলে রাখা বাহুল্য নয়, উনাদের প্রতি আমার সম্মান বেড়েছে বই এতটুকুও কমে নাই।
উমা দিদির পরিবারও এমন একটি জুডিসিয়াল পরিবার। সেখানে কর্মরত সকল অফিসার তার প্রয়াত স্বামীর চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করা, প্লাজমা জোগার করা থেকে সবই করেছেন। সার্বক্ষণিক পাশে থেকেছেন। আজও রয়েছেন। তার স্বমীর আত্বীয় বলতে এক বোন রয়েছে।
উনার নিজের ছেলেই নাকি করোনা আক্রান্ত। আইসোলেশনে রয়েছে। তিনি নিজেও ক্যান্সার রোগে ভুগছেন।
উমা দিদির পিতা পক্ষঘাত রোগে শয্যাশায়ী। মাতা ষাটোর্ধ সায়ন্ধ্যা।
উমা দিদির ভাই ঢাকার বাসাবো এলাকায় থাকেন।
এসময়ে বাসাবো থেকে ময়মনসিংহ যেতেও কম করে ৫-৬ ঘন্টা সময় ব্যায় হয়। তাথাপি উমা দিদির ভাই – বোন শ্মশানে পৌঁছেছেন। তবে যানবাহন সমস্যায় হয়তো কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। পিপিই না থাকায় তদেরকে মৃত দেহের কাছে ভিরতে দেয়া হয় নাই।
আবার, শ্মশানে একজন হিন্দু বিজ্ঞ এডভোকেটও কয়েক জনকে নিয়ে উপস্থিত ছিলেন ( ছবি সংযুক্ত)। শুনেছি মাননীয় জেলা জজ মহোদয় উনাকে জানিয়েছিলেন।
তাহলে আত্মীয় – স্বজন কেউ আসেনি এটা কিভাবে রটলো? ওই বিজ্ঞ এডভোকেট কি সুজন – স্বজন নয়?কেউ ছিল না তার পাশে এ কথা উমা দিদি নিজে বলে মিথ্যা বলার পাপ তো তিনি নিজেও নিতে চাইবেন না! আবার, সিটি কর্পোরেশন এর হিন্দুদের সৎকার করার আলাদা স্বেচ্ছাসেবক টিমও শ্মশানে উপস্থিত ছিল। তারাও করেছে।
আবার, এক জন মৃত ব্যক্তি, যিনি কিনা পিএইচডি ডিগ্রি ধারী , যুক্তরাজ্যে পুলিশ অফিসার ছিলেন, এখানে গতবছর ফিরে এসেছিলেন, একটি গার্মেন্টসে অফিসার পদে চাকুরী করতেন তার পদ- পদবীও পাল্টে দিল সোস্যাল মিডিয়া! মৃত্যুর পর উনাকে ডাক্তার সম্মাননা দিল!
হায়রে, কয়েকটি লাইক, একটু বাহবা পেতে এতো এতো মিথ্যার রটনা! এই মিথ্যা রটনা আপনার সমাজের মান কোথায় নিয়ে দাঁড় করালো ?
আবার, ধর্ম রক্ষক কিছু প্রভু হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলেন , স্ত্রী কি করে স্বামীর মুখাগ্নি করতে পারে? শাস্ত্রে তো নাই!
তাদের বোঝানো অতি আবশ্যক বটে।
শাস্ত্র বচন অখন্ডনীয়!
পুত্রহীন বৃথা জন্ম বেদের বচন।
ইহ কালে দুঃখ অন্ত নরকে গমন।।– কাশীরাম দাস।
অর্থাৎ -পুত্রহীন ব্যক্তি নরকে গমন করবে। তার জন্মই বৃথা।
তাৎপর্য হলো – এক পুত্র তার পিতা- মাতার মৃত্যুতে মুখাগ্নি করতে পারে এবং শ্রাদ্ধে পিন্ড দানের অধিকারী হয়।
মুখাগ্নি ও পিন্ড দানের মাধ্যমে পুত্র তার প্রয়াত পূর্বপুরুষদের আত্মার মুক্তি দিয়ে স্বর্গ প্রাপ্তি ঘটায়ে থাকে। পুত্র নিজ বংশও রক্ষা করে।
ধর্মীয় আইনানুযায়ী, পিন্ডদানের পরিমান ও ধরণ অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির ত্যাজ্য সম্পত্তিতে বিভিন্ন শ্রেণির উত্তরাধিকারীর অধিকার সৃষ্টি হয়। পুত্র থাকলে সেই সম্পত্তিতে আর কোন উত্তরাধিকারীর এতোটুকুও অধিকার নাই।
শুধু বিধবা মাতা পুত্রের পাশে থেকে সমপরিমাণ পিন্ড দান করায় সীমিত স্বত্ত্বে সম্পত্তি লাভ করে। অর্থাৎ বিধবা স্ত্রী যতদিন জীবিত থাকবেন ততদিন এক পুত্রের সমান পরিমান সম্পত্তি ভোগ করবেন। হস্তান্তরের ক্ষমতা শুধু বিশেষ প্রয়োজনে বিশেষ বিবেচনায় স্বীকৃত। বিধবা স্ত্রীর মৃত্যুতে সেই সম্পত্তি আবার তার স্বামীর নিকটতম উত্তরাধিকারীর নিকট ফেরত চলে যায়।
কন্যাগন পিতা-মাতার সংসারে বিবাহ অবধি কজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির আওতাভুক্ত মাত্র। এর বেশি মোটেও নয়। কন্যা ওই সম্পত্তির উত্তরাধিকার নয়।
পাশ্ববর্তী দেশের সংসদ আইন পাশ করেছে। ধর্মীয় আইনের উপর সময়োপযোগী আইন পাশ করে ক্ণ্যার উত্তরাধিকার পুত্রের সমান করেছে। কিন্তু, আমাদের দেশে এমন কিছু করা এখনো সম্ভব হয়নি।
ছাত্রজীবনে হিন্দু সম্পত্তিতে নারীর সমাধিকার নিয়ে এক আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়েছিলাম।
এক বক্তা বললেন -” ভুলে যাবেন না- আপনারা সংখ্যালঘু। এক সুন্দরী মেয়েকেই ঘরে রাখতে পারছি না, উত্তরাধিকারী হলেতো সম্পদের লোভে মেয়েকে নিয়ে যাবে। হারানোর কারণ দ্বিগুন হবে “!
বক্তাকে অব্যক্তরূপে কয়েকটি গালি দিয়ে চলে এসেছিলেম সেদিন। উনি ভাবলেন না, যৌতুকের পরিবর্তে অধিকার দিলে হিন্দু সমাজের মঙ্গল হতে পারত!
যাই হোক, সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারী হোক বা না- হোক, এক কণ্যা বা স্ত্রী তার সংসারের পরলোকগত সকলের আত্মা যেন মুক্তি পেয়ে স্বর্গ লাভ করে সেটিই নিশ্চিতরূপে কামনা করে থাকে। মৃত্যুতে মুখাগ্নি বা শ্রাদ্ধে পিন্ডদানের অধিকার নিয়ে তারা মোটেও বিব্রত বোধ করে না।
হয়তো ভাবতে পারেন, যে জন্ম দিল তার মুখেই আগুন দেয়, সেটার আবার কেমন অধিকার? প্রকৃত পক্ষে হিন্দু শাস্ত্র মতে সৃষ্টির দেবতা ব্রহ্মা। সকল সৃষ্টি তিনিই করেছেন। তিনি অগ্নির দেবতা। আর সেই অগ্নিই শবের মুখে স্পর্শ করিয়ে সৃষ্টিকে চিতায় পুড়িয়ে স্রষ্টার সাথে লীন করে দেয়া হয়।
যাই হোক, পুত্র মাত্র ১জন থাকলে সেই পুত্রই মুখাগ্নি ও শ্রাদ্ধে পিন্ড দান করে থাকে । আর একাধিক থাকলে জ্যৈষ্ঠ পুত্র প্রথমে এবং অন্যান্যরা জন্ম ক্রমানুযায়ী আধিকারী হন। পুত্রের রাজ সিংহাসন প্রাপ্তিরও ওই একই নিয়ম।
স্ত্রী -কণ্যার মুখাগ্নিতে কোন অধিকার নাই।
ভাই, ভাতিজা, ভাগিনা, কাকা ইত্যাদি, অর্থাৎ রক্ত সম্পর্কীয় পুরুষগনই মুখাগ্নি ও পিন্ড দানের অধিকারী হন।
সময়ের বিবর্তন হয়েছে। ভরত ও লক্ষণের মতো ভাই ক’জন আছে? মামাকে মুক্তি দান করতে শ্রী কৃষ্ণের মতো ভাগিনা হাতে গুনে পাওয়া যাবে না। চারিদিকে সম্পদের কারনে ভাইয়ে – ভাইয়ে অহি- নকুল সম্পর্ক বিরাজমান। যে আত্মা নিজেই বিশুদ্ধ নয়, যে ভাইয়ের প্রতি জীবনভর অবজ্ঞাপূর্ণ ছিল, সেই হাতের আগুন আর পিন্ড কি করে মৃত ভাইয়ের আত্মাকে স্বর্গে নিয়ে যাবে? ভাতিজির ভালো ঘরে- বরে সম্পর্কটা তো তার কাছে বীভিষিকা হয়ে উঠতে পারে! ভাইয়ের চিতার মতো নিজেও জ্বলতে থাকবে! আর তাকেই মুখাগ্নি, শ্রাদ্ধে পিণ্ড দান ও সম্পদের অধিকার দিয়ে ভাতিজির বিবাহের দ্বায়িত্ব দান তো অধর্মের হাতে ধর্মের সন্তানের বলিদান!
সময়ের বিবর্তনে ধর্মের রীতির পরিবর্তন অবশ্যাম্ভাবী। সেই পরম্পরা থেকে বের হয়ে আসাও ধর্ম।
সত্য যুগের বেদ পাঠ ও যজ্ঞ করে ভগবানকে সন্তুষ্ট করার রীতিও পাল্টেছে।
শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু এ যুগে অবতার হয়ে এসে শুধু হরি নাম করতে বললেন। বললেন, তাতেই জীবের মুক্তি মিলবে।
ফলে বেদ পাঠ, যজ্ঞানুষ্ঠান ভাগবান প্রাপ্তিতে অনাবশ্যক হলো।
তাহলে সেই বেদ বাক্যে আর পরম্পরায় কেন আটকে থাকা?
যা ধারণ করলে মানবের কল্যাণ হয় তাইতো ধর্ম।
ধর্মকে পুরাতন চিন্তা- ভাবনায় আবদ্ধকরণও অধর্ম।
সতীদাহ প্রথা কালের বিবর্তনে এখন ঘৃণ্য, অধর্ম।
বিধবা বিবাহ এখন সর্ব স্বীকৃত।
তাহলে সময়ের বিবর্তনে ধর্মের পরম্পরায় পরিবর্তন স্বীকার করতে কার্পণ্য কেন ? তবে মানুষ পরিবর্তন স্বীকার না করলেও, যুগই সংকট তৈরি করে সেই পরিবর্তন ঘটায়।
সিনিয়র সহকারী জজ, সদর আদালত, ময়মনসিংহ, উমা দিদির মাধ্যমেই হয়তো স্বয়ং ভগবান ধর্মের পরম্পরায় পরিবর্তন এনেছেন।
করোনার ছোবলে পরলোকগত স্বামীর সৎকারে মুখাগ্নি নিজেই করেছেন । অন্য কাওকে যেন এই ভাইরাস আক্রান্ত না করতে পারে তাই হয়তো এমন উপায়। আড়াই বছর বয়সের ছেলের হাতে একটি পাটখড়ি ছুঁইয়ে এনেছিলেন। নিজেই স্বামীর মুখাগ্নি করলেন। সংকট কালে যথোপযুক্ত কাজই করলেন। অন্যদেরও ভাইরাস আক্রমণ থেকে নিরাপদে রাখলেন, নিজের স্বামীকেও মুক্তি দিলেন । এটাই তো ধর্ম! দিদি প্রমাণ করলেন, রক্তের সম্পর্কের ভিত্তিতে নয়, পুত্রের বা পুরুষ উত্তরাধারীর মাধ্যমেও নয় বরং প্রেম -ভালোবাসার মাধ্যমেই মানুষের মুক্তি লাভ হয়। দাদা নিঃশ্চই স্বর্গলাভ করবেন। দাদার জীবন অবশ্যই স্বার্থক।
প্রীতি- প্রেমের পূণ্য বাধনে যবে মিলি পরস্পরে,
স্বর্গ আসিয়া দাঁড়ায় তখন আমাদেরই কুঁড়ে ঘরে।
ভগবানের কৃপায় দাদার আত্মার স্বর্গ প্রাপ্তি হোক, তিনি দিদির পরিবারকে এই শোক সইবার ক্ষমতা প্রদান করুক, মিথ্যার প্রচারণা বন্ধ হোক আর ধর্মের ধারকগণ এই পরিবর্তনকে ধর্ম রূপেই গ্রহণ করবে- এই প্রার্থনা করি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।