এইচ এম শরিফুল হাসান: বাচ্চার জ্বর ছিল দু’দিন ধরে। ওদেরকে একজন ডাক্তারকে দেখাই ছোটবেলা থেকে। করোনার কারণে উনি গত দুই বছর রোগী দেখেন নাই। জানতাম না যে দেখা শুরু করেছেন আবার। ভদ্রলোকের এসিস্ট্যান্টকে ফোন দিয়ে জানতে পারলাম যে আছেন চেম্বারে। কিন্তু উঠে যাবেন। তাই সাত তাড়াতাড়ি কিছু না ভেবে সিরিয়াল না নিয়েই চলে গেছি। যাওয়ার পরে এক ঘন্টা বসে থেকে আমাকে জানানো হলো উনি সিরিয়াল ছাড়া পেশেন্ট দেখবেন না।
দেখবেন না তো দেখবেনই না। হাত জোড় করে ক্ষমা চেয়ে উঠে গেলেন। আমি সবার শেষে দেখাতে চাইলেও মানলেন না। অসুস্থ বাচ্চাটা নিয়ে খামোখাই এতক্ষণ বসে থেকে আমার লাভটা কি হলো বুঝলাম না!
এই কাজটা যদি আমার মতো কেউ সরকারি অফিসে করতাম, তাহলে চামড়া ছিঁড়ে ফেলা হতো। দিনের কাজ দিনে শেষ না করলে, সার্ভিস প্রোভাইড না করলে চেঁচামেচি, আন্দোলন কোনোকিছুই বাদ যেতো না। এগুলোর প্রয়োজনও আছে।
আমি তাকে আমার পরিচয় দেই নাই কখনো৷ কালকেও না। দিলেও হয়তো লাভ হইতো না। আমি মনে করি, আমার বাচ্চার চিকিৎসা নিতে গেছি। ওখানে আলাদাভাবে ট্রিট করার কিছু নাই।
আর তাছাড়া ছেলের ব্লাড টেস্টে ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন ছিল। তাই তাড়াহুড়া করে বিশেষজ্ঞ একজনকে দেখাতে চেয়েছিলাম। নইলে সাধারণ জ্বরজারি হলে বাসায় ওষুধ খাওয়াই।
সাধারণ মানুষের সাথে তাদের এই ব্যবহারের কারণটা কি কেউ বলতে পারেন?
গত সপ্তাহে আমার এক আত্মীয়ের লিভারের ডাক্তার দেখানোর প্রয়োজন পড়েছিল। কেউ কি রিসেন্টলি বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোয় কল সেন্টারে ফোন করে ডাক্তার দেখিয়েছেন? সেই আত্মীয় সাতদিন ধরে টানা সকাল ৭ টা থেকে এক দেড় ঘন্টা ওয়েটিংয়ে থেকেও সিরিয়াল পান নাই। মাঝে থেকে এক হাজার টাকা ফোনের বিল কেটেছে অহেতুক। আমার এক পরিচিত লোকের সাহায্যে পরে এই উইকে দেখানোর সুযোগ হয়েছে।
আমি চেম্বার থেকে হাফসোল খেয়ে এসে আমার নটরডেমের ডাক্তার বন্ধুকে মেসেজ দিলাম। সে আমাকে সাথে সাথেই একটা প্রেসক্রিপশন দিয়ে দিল। আল্লাহর ইচ্ছায় ছেলে এখন ভালো আছে।
খুব সাধারণ ঘটনা এগুলো। কিন্তু এই সামান্য ঘটনাগুলি কিন্তু সবার মনে দাগ কেটে যায়।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়। ১৪ বছর টানা। উনি রোগীর চেহারা দেখে, নাড়ি টিপে রোগ বলে দিতে পারতেন। এখনকার মত এত টেস্টের সাহায্য তার নেয়া লাগতো না। কোলকাতা মেডিক্যালে তার বিলেতি শিক্ষকেরা অবাক হয়ে যেতেন তার এই ক্ষমতা দেখে।
আমি আরেকটা ব্যাপার খেয়াল করেছি। এইচএসসি বা এ লেভেল পাশের পরে দেশের বাইরে যারা পড়তে যাচ্ছে, সবাই হয় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে অথবা বিজনেসে গ্র্যাজুয়েশন করে। ডাক্তারি পড়ে খুব কম সংখ্যক ছাত্র ছাত্রী। গোটা দুনিয়াতেই হাইয়েস্ট ইনকাম করা প্রফেশনগুলোর একটা হচ্ছে মেডিক্যাল প্র্যাকটিশনার।
আমার ফুপাকে দেখেছি উনি ডাক্তার দেখাতে গেলে আগে দেখেন সেই ডাক্তার কোন মেডিক্যাল থেকে পাশ করেছে। যদি দেখেন যে সরকারি মেডিক্যাল ছাড়া অন্য জায়গায় এমবিবিএস পড়েছে, তাহলে তাকে ধরে বেঁধেও ডাক্তার দেখানো যাবে না। তার সাফ কথা, “তোমাদের মত ইঞ্জিনিয়ার যে কেউ হইতে পারে। কাম তো করবা মেশিন নিয়া। ডাক্তাররা কাম করে মানুষের জান লইয়া। ডাক্তার হইতে হইলে মাথায় ব্রেন থাকা লাগে। সাথে থাকা লাগে বিবেক। সবাই ডাক্তার হইবার পারে না।”
আমি তার সাথে পুরোমাত্রায় না হলেও আংশিক সহমত।
আমাদের কি প্রয়োজন অনুযায়ী ডাক্তার আছে? ঢাকা শহরেই যদি এত ক্রাইসিস হয়, সারা দেশের চিত্রটা কেমন হতে পারে? সরকারি বেসরকারি মেডিক্যাল মিলিয়ে আমাদের অনেক ডাক্তার দরকার আসলেই। আর দরকার কিছুটা সহমর্মিতা। কারণ অনেক সময়েই উপরওয়ালার পরে ডাক্তারের হাতেই রোগীদের বাঁচা-মরা নির্ভর করে। এটা নিশ্চয়ই তারাও বোঝেন! তারা কি কখনো উপলব্ধি করতে পারেন এই দেশে এত এত ডাক্তার, এত এত রোগী থাকার পরেও কেন সবাই চিকিৎসা নিতে দেশের বাইরে যায়?
আমার মনে হয়, বাংলাদেশে প্রচুর ‘মানবিক ডাক্তার’ দরকার। তাহলে এদেশের চিত্রটাই বদলে যাবে।
লেখক: প্রথম সচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।