জুমবাংলা ডেস্ক : এক সাক্ষাৎকারে উপন্যাসিক বুদ্ধদেব গুহ এ রকমটি বলেছিলেন, ‘সত্যজিৎ রায় তার প্রতিভা চলচ্চিত্র নির্মাণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন, মাঝে মধ্যে কিছু সাহিত্য লিখতেন। অথচ সাহিত্যিক হিসেবে তিনি আরও অনেক কালজয়ী রচনা লিখে যেতে পারতেন, সে ক্ষমতা ও প্রতিভা সত্যজিৎ রায়ের ছিলো। কিন্তু পারেননি তার অন্যতম কারণ তার জীবনযাত্রা ছিলো কিছু নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে আবদ্ধ। সত্যজিৎ রায় সমাজের সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশতেন না… যা একজন সাহিত্য রচয়িতার জন্য অপরিহার্য।’ ‘মাধুকরী’ কিংবা ‘কোজাগরে’র লেখক বুদ্ধদেব গুহের এ কথাটি আমাকেও ভাবিয়ে তুলেছে। যেকোনো সৃষ্টিশীল মানুষকে তার সময়ের ভাবনা ও সমাজের চালচিত্রকে তুলে ধরতে হয় সৃষ্টির মাধ্যমে। লেখক-সাহিত্যিক-কবি-চিত্রশিল্পী সবাই তার সময়ের বিবেক বা ধারাবর্ণনাকারী মাত্র। সমসাময়িক ঘটনা সৃজনশীলভাবে প্রকাশ করাই তাদের কাজ। আর এ কাজটুকু করতে গিয়ে অনেক সময় অতীতের সঙ্গে বর্তমান ও আগামীর এক সেতুবন্ধনের প্রচেষ্টাও থাকে। এ চেষ্টা বা প্রচেষ্টার সার্থকতার উপরই নির্ভর করে সৃষ্টির উৎকর্ষতা। তাই যেকোনো সৃষ্টির পেছনে সময় এবং সময়ের ধারক-বাহক মানুষের উপস্থিতিই প্রধান। তাই বিচিত্র মানুষকে না-জেনে বহুমুখী সাহিত্য সৃষ্টি সম্ভব নয়।
যারা বুদ্ধদেব গুহর ‘মাধুকরী’ উপন্যাসটি পড়েছেন, তারা জানেন আমাদের চারপাশে মিশে থাকা কতো ধরনের মানুষের বসবাস। অথচ তারা কেমন লোকচক্ষুর অন্তরালেই পড়ে আছেন। বুদ্ধদেব গুহ কী নিপুণ দক্ষতায় এসব মানুষের বিচিত্রতর জীবনের বিচিত্ররূপ তুলে ধরেছেন। পেশার জন্যই বুদ্ধদেব গুহকে নানা পেশা ও নানা নেশার মানুষের সঙ্গে মিশতে হয়েছে বলেই এমন দক্ষতার সঙ্গে চরিত্রগুলো বর্ণনা
করতে পেরেছেন। বুদ্ধদেব গুহের কথাতেই জানা যায় একটি ঘটনার। একবার মফস্বলের এক কাঠের আড়তের মালিক, যিনি বুদ্ধদেব গুহের মক্কেল, এসে তাকে বললেন, ‘বাবু বলেন তো, কে আপনাকে আপনার বইগুলো লিখে দেন?’ বুদ্ধদেব বাবু বললেন, ‘কেন তাকে দিয়ে আপনার কী দরকার?’ ভদ্রলোক বললেন, ‘পাড়ার পূজোয় আমাকে ভাষণ দিতে ধরেছে, ভাবছি যিনি আপনার বইগুলো লিখে দেন, যতো টাকাই লাগুক তাকে দিয়েই আমার ভাষণটা লিখিয়ে নেবো’। বুদ্ধদেব গুহ মন্তব্য করেছেন, ‘বুঝুন, এ রকম বিচিত্র ধরনের মানুষের সঙ্গেই আমাকে মেলামেশা করতে হয়। আর তাই আমার উপন্যাসের চরিত্রগুলোতেও এ রকম বিচিত্র মানুষের সমাবেশ’। শুধু বুদ্ধদেব গুহ কেন, সব বিখ্যাত লেখক-কবি-সাহিত্যিকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতালব্ধ কাহিনিই তাদের সৃষ্ট মহত্ত্বতম রচনা। কিন্তু অধিকাংশ পাঠকই চরিত্রের সঙ্গে লেখকের সাযুজ্য টানতে পারেন না। সেখানে সৃ ষ্টার উপস্থিতি থাকে পেছনে।
একটি কথা অনেক সময় আমাকে ভাবিয়ে তোলে, গল্প-উপন্যাস-কবিতা লিখতে পাঠ্যাভাসের চেয়েও হয়তো বেশি দরকার চারপাশকে পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতা। সমসাময়িক সাহিত্য পড়ার চেয়ে সমসাময়িক সমাজ, মানুষ, প্রকৃতি পড়ার গুরুত্ব কোনো অংশেই কম নয়। মানুষ প্রতিদিন বদলায় । প্রতিমুহূর্তে বদলায়। যে মানুষটি ঘর থেকে বের হয়ে আবার ঘরে ঢুকে সে মানুষটি কি একই মানুষ? দীর্ঘ বছর আগে দেখা দেশ-মানুষ-মাটিকে যদি সেরকমভাবেই দেখতে চাই সেটাও কি সম্ভব? এই চলে যাওয়া বছরে কতোটা বদলে গেছে পৃথিবী। মানুষ বদলে গেছে। জনপদ বদলে গেছে। মানুষের বিশ্বাস বদলে গেছে। নিজের অক্ষমতাকে সীমাবদ্ধতার আক্ষেপের জালে জড়িয়ে বলি, দীর্ঘদিন দেশের বাইরে বাস করে দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে লেখার প্রচেষ্টা কতোটুকু সময়কে তুলে আনা আর কতোটুকু বিহগদৃষ্টিতে দূর থেকে দেখা… সে প্রশ্ন থেকেই যায়। কেননা দশকের ব্যবধানে ও প্রযুক্তির অগ্রগতিতে সময় বদলে গেছে, বদলে গেছে মানুষ, বদলে গেছে মানুষের জীবনযাপন, বদলে গেছে জীবনের টানাপড়েনও।
ভাষাবিজ্ঞানীরা বলেন, ভাষাও নাকি অনেকটা বদলে যায় সমাজের অনেক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে। আর লেখক-কবি-সাহিত্যিকের কাজকারবার যেখানে ভাষাকে নিয়েই, সেখানে যথা-উপযুক্ত শব্দটি যদি প্রয়োগ না হয়, তবে সে অপ্রচলিত কিংবা অতীতে প্রচলিত শব্দ দিয়ে নতুন প্রজন্মের হৃদয়-ছোঁয়া কতোটুকু সম্ভব? মাটি থেকে পা তুলে মাটির বর্ণনা সে শুধু অতীতের স্মৃতিচারণই নয় কি? মাটির বর্ণনা তো আর শূন্যে বাস করে করা সম্ভব নয়। মানুষের জীবনকে শিল্প-সাহিত্য-গানে তুলে আনতে হলে তাই মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে হয়। অথচ আমরা ক্রমশ মানুষকেই দূরে সরিয়ে দিচ্ছি। কিংবা প্রতিদিনের প্রযুক্তি মানুষ থেকে দূরে ঠেলে সরিয়ে আমাদের ক্রমশ করে ফেলছে বৃত্তবন্দি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ কতোটুকু করিয়ে দিচ্ছে, কীভাবে করিয়ে দিচ্ছে, আজ সমাজবিজ্ঞানীরা সে নিয়েও ব্যাপকভাবে উৎকণ্ঠিত।
কবি শক্তি চট্রোপাধ্যায় অনেক আগে তার কবিতায় লিখেছিলেন :‘মানুষ বড় একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও/এসে দাঁড়াও, ভেসে দাঁড়াও এবং ভালোবেসে দাঁড়াও/মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও’। লেখক : কলামিস্ট ও প্রকৌশলী
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।