সাইফুল ইসলাম, মানিকগঞ্জ : মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ফেরিঘাটে গত বুধবার শাহ আমানত নামে ফেরি ডুবে যাওয়ার ঘটনায় খবর পাওয়া গেছে। তলা ফেটে নয় বরং ফেরির মাস্টার শফিকুল ইসলাম লিটন, সুকানি মানিক ও ইঞ্জিন চালক শাহিনুলের অবহেলায় ডুবে যায় ফেরিটি। দৌলতদিয়া ঘাট থেকে ফেরিটি পাটুরিয়ার উদ্দেশ্যে ছাড়ার আগে ফেরিতে অতিরিক্ত মাল বোঝাই ট্রাক লোড করা, সেগুলোকে এক সারিতে রাখা, খালি কাভার্ড ভ্যানকে অন্য পাশে রাখা, গাড়ির সারি চারটার পরিবর্তে তিনটি করা, ফুটবারী দিয়ে পানি প্রবেশ করা, মাঝ নদীতে ইঞ্জিন বন্ধ হওয়া ও ঘাটে এসে সজোড়ে ধাক্কা লাগাসহ একাধিক কারণে ডুবে যায় শাহ আমানত নামের ফেরিটি।
পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌ-রুটের সহকারি পরিচালক (মেরিন) আব্দুস সাত্তার জানান, বুধবার ডুবে যাওয়া শাহ আমানত ফেরিতে মাস্টারের দায়িত্ব পালন করছিলেন শফিকুল ইসলাম লিটন, সুুকানির দায়িত্বে ছিলেন মানিক আর ইঞ্জিন চালকের দায়িত্বে ছিলেন শাহিনুল।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অতিরিক্ত মাল বোঝাই ট্রাক লোড করার কারণে দৌলতদিয়া ঘাটেই ফেরিটি ডান দিকে কাত হয়ে যায়। এটি জানার পরও ফেরিতে দায়িত্বরত মাস্টার শফিকুল ইসলাম লিটন ও সুকানি মানিক পাটুরিয়া ঘাটের উদ্দেশ্যে ফেরি ছাড়ে। আর ইঞ্জিন চালক শাহিনুল সঠিকভাবে তার দায়িত্ব পালন করেননি। ফলে দুর্ঘটনার পর নিজেদের দোষ ধামাচাপা দিতে ফেরিটিতে তলা ফেটে পানি উঠার গল্প বলা হয়। তবে ফেরিটিতে পানি উঠে মূলত ফুটবারী দিয়ে। এটি খোলা বা বন্ধ রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। রয়েছে পানি অপসারণের ব্যবস্থাও। তবে শাহ আমানত ফেরিতে ফুটবারী দিয়ে পানি ঢুকলেও তা বন্ধ কিংবা অপসারণ করার জন্য সেখানে কেউ ছিলেন না।
শাহ আমানত ফেরিতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেন এমন একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ইঞ্জিন চালক শাহিনুল ইঞ্জিন চালু দিয়ে উপরে উঠে আসেন। এরপর ফুটবারী দিয়ে পানি ঢুকে মাঝ নদীতেই একটি ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। ফলে একটি ইঞ্জিন দিয়ে বাকি অর্ধেক নদীতে চলে ফেরিটি। এতে ঘাটে পৌঁছানোর আগেই পানিতে ভরে যায় শাহ আমানত।
এদিকে, ফেরিতে সমস্যা হয়েছে জানিয়ে ঘাটে ভিড়ার সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে নেমে যাওয়ার জন্য মাইকে বারবার ঘোষণা করতে থাকেন মাস্টার শফিকুল ইসলাম লিটন। এই ঘোষণা শোনার পর শাহ আলী নামের ফেরিটি শাহ আমানতকে জায়গা ছেড়ে দিয়ে নদীতেই নোঙর করে। কিন্তু সুকানি মানিকের ভুলে শাহ আমানত ঘাটে এসে সজোড়ে ধাক্কা দেয়। এতে ফেরি ও ঘাটে থাকা লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। যে যার মতো নেমে যায়। গাড়ি আনলোডেও শুরু হয় প্রতিযোগিতা। অতিরিক্ত মাল বোঝাই গাড়িগুলোকে নামার সুযোগ না দিয়ে বাম পাশে থাকা খালি দুটি কাভার্ড ভ্যান নেমে যায়। এতে ফেরিটি ডান দিকে আরো বেশি কাত হয়ে ডুবতে শুরু করে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ডুবে যাওয়া শাহ আমানত নামের ফেরিটিতে ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও মোটরসাইকেলসহ মোট ২১টি গাড়ি ছিল। এর মধ্যে ৯টি ট্রাক, ৮টি কাভার্ড ভ্যান ও চারটি মোটারসাইকেল ছিল। ট্রাকগুলোর মধ্যে ৭টি ছিল সার বোঝাই, একটিতে ছিল চিনি, আর একটির সঠিক তথ্য জানা যায়নি। কাভার্ড ভ্যানের মধ্যে দুটি খালি ছিল, একটিতে সার ছিল, আর বাকিগুলোর তথ্য অজানা।
ফেরি সূত্রে জানা যায়, ফেরিতে সর্বোচ্চ ১৩ টনের মালামাল বহন করার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু শাহ আমানত ফেরিতে সার ও চিনি বোঝাই একেকটি ট্রাকের ওজন ছিল ৩০ টনের অধিক। প্রতিটি ফেরিতে গাড়ি লোড করা হয় চার সারিতে। কিন্তু ডুবে যাওয়া ফেরিতে সেদিন তিন সারিতে গাড়ি লোড করা হয়েছিল। ফেরির ডান দিকের সারিতে ছিল সার বোঝাই ট্রাক। আর বাম পাশের সারিতে ছিল কাভার্ড ভ্যান। এর মধ্যে দুটি কাভার্ড ভ্যান খালি থাকায় অতিরিক্ত লোড পেয়ে ডান দিকে কাত হয়ে যায় ফেরিটি।
সূত্রটি জানায়, টাকার বিনিময়ে অতিরিক্ত মাল বোঝাই ট্রাকগুলোকে ফেরিতে উঠার অনুমতি দেন মাস্টার শফিকুল ইসলাম লিটন। পাঁচ মাস আগেও একবার অতিরিক্ত মাল বোঝাই করার কারণে ডান দিকে কাত হয়ে গিয়েছিল ফেরিটি। পরে সেটি ঘাটে নোঙর করে পুনরায় আনলোড-লোড করে ছাড়া হয়। তবে এবার ডান দিকে কাত হয়ে যাওয়ার বিষয়টি জানার পরও মাস্টার সঠিকভাবে গাড়ি লোড না করে ফেরি ছাড়ে।
নিয়ম অনুযায়ী, ফেরিতে গাড়ি লোড হওয়ার পর প্রতিটি গাড়ির টিকিটের একটি অংশ জমা দেয়া হয় মাস্টারের কাছে। মাস্টার সেগুলো টালি খাতায় নোট রাখেন। অর্থাৎ কতটি ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, মোটরসাইকেল ফেরিতে লোড করা হয়েছে, ফেরিটি কখন ছাড়া হচ্ছে সে সময় উল্লেখ করা হয় টালি খাতায়।
এসব বিষয়ে ফেরির মাস্টার শফিকুল ইসলাম লিটন, সুকানি মানিক ও ইঞ্জিন চালক শাহিনুলের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে এই প্রতিবেদক। তবে তাদের কাউকেই পাওয়া যায়নি। বন্ধ রয়েছে তিনজনের মোবাইল ফোনও।
বিআইডব্লিউটিসি আরিচা কার্যালয়ের উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) জিল্লুর রহমান বলেন, বৃহস্পতিবার তদন্ত কমিটির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলার পর থেকে মাস্টার, সুকানি ও ইঞ্জিন চালককে পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি তাদের মোবাইল ফোনটিও বন্ধ রয়েছে।
উল্লেখ্য, গত বুধবার পাটুরিয়া ৫ নম্বর ফেরিঘাটে ২১টি যান নিয়ে ডুবে যায় শাহ আমানত নামের রো রো ফেরি। এ ঘটনায় পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ডুবে যাওয়া যান উদ্ধারে কাজ করছে বিআইডব্লিউটিএ, ফায়ার সার্ভিস, নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ডের উদ্ধারকারী দল। কাত হয়ে ডুবে যাওয়া ফেরির ভেতর থেকে বিআইডব্লিউটিএর উদ্ধারকারী জাহাজ ‘হামজা’ দিয়ে যানবাহন উদ্ধারের তৎপরতা চালানো হচ্ছে। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত মোট ১২টি যান উদ্ধার করেছে উদ্ধারকারী দল।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।