রঞ্জু খন্দকার, মহাস্থানগড় (বগুড়া) থেকে: বাংলাদেশে উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার বলা হয় বগুড়াকে। এই বগুড়ার করতোয়া নদীর তীরে অবস্থান প্রাচীন বাংলার রাজধানী পুন্ড্রনগরের, যা এখন মহাস্থানগড় নামে পরিচিত। মহাস্থানগড় উত্তরাঞ্চলের মানুষের মুখে উচ্চারিত হয় ‘মাস্থান’ বা ‘মাস্তান’ নামে। সেখানেই পাওয়া যায় এক ধরনের মুখরোচক খাবার– কটকটি।
ঢাকা-রংপুর হাইওয়ে ধরে গিয়েছেন অথচ ‘মাস্তানের কটকটি’ চোখে পড়েনি অথবা ফেরিওয়ালারা কিনতে সাধেননি, এমন যাত্রী বোধ হয় বিরল। কিন্তু সবাই কি এই কটকটি কিনেছেন?
মিষ্টিরসিকেরা বলছেন, মহাস্থানগড়ে গিয়েছেন অথচ কটকটি মুখে তোলেননি, তাহলে তাকে দুর্ভাগা বলতেই হবে। এমন স্বাদের খাবার একবার হলেও পরখ করা দরকার। এর সঙ্গে মিশে আছে দেড় শত বছরের ঐতিহ্যও!
উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, ঠিক কবে থেকে কটকটি খাবার হিসেবে তৈরি হচ্ছে, তা অজানা। তবে এর ব্যবসা প্রায় দেড় শত বছরের। খাবারটির নাম কেন কটকটি, এরও ইতিহাস জানা যায়নি। তবে কটকটি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত কয়েকজন এবং ওই অঞ্চলের কয়েকজন প্রবীণ ব্যক্তির মতে, খাওয়ার সময় কটকট শব্দ হওয়ার কারণে এই খাবার কটকটি নামে পরিচিতি পেয়ে যায়।
স্থানীয় লোকজন ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, মহাস্থানগড় মাজারের তবারক হিসেবে পরিচিত কটকটির সুখ্যাতি এখন দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও। এখানকার লোকজন বিদেশে বেড়াতে গেলেও সুস্বাদু এ খাবারটি নিয়ে যান। মহাস্থানের মাজার ও প্রাচীন নিদর্শন এলাকায় বেড়াতে আসা দর্শনার্থীরা ফেরার সময় কটকটি কিনতে ভোলেন না। শুধু তাই নয়, কোথাও বেড়াতে গেলে কটকটি নিয়ে যাওয়া স্থানীয়দের কাছে অনেকটা রেওয়াজের মতো।
মহাস্থানগড় বাসস্ট্যান্ডের পশ্চিমেই হযরত শাহ সুলতান মাহী সাওয়ার বলখীর (রহ.) মাজার। এর নিচে উত্তর-দক্ষিণ রাস্তার দুপাশে কটকটির শ খানেক দোকান।
এখানকার সবচেয়ে পুরোনো দোকানের নাম লাল মিয়া কটকটি ঘর। এর প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ লাল মিয়া প্রামাণিক। মাত্র ১২ বছর বয়সে বাবার হাত ধরে কটকটি ব্যবসায় নামেন তিনি।
লাল মিয়া প্রামাণিক বলেন, তাঁর দাদা জোহর মাহমুদ ও বাবা মোহাম্মদ আলী প্রামাণিক প্রায় ১০০ বছর কটকটির ব্যবসা করেছেন। প্রায় ৭৫ বছর ধরে তিনি নিজে এ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। সেই হিসাবে মহাস্থানগড়ের কটকটির ইতিহাস কমপক্ষে ১৭৫ বছরের পুরোনো।
লাল মিয়া কটকটি ঘরের পূর্বপাশেই সুলতান কটকটি ঘর। এটির মালিক মো. মোস্তফা। তিনি ২১ ফেব্রুয়ারি দুপুরে জুমবাংলাকে বলেন, কটকটির ব্যবসায় খুব ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। এখন কথা বলারও তেমন ফুরসত তাঁর নেই।
সুলতান কটকটি ঘরের কর্মীরা জানালেন, তাঁদের দোকানে তিন ধরনের কটকটি হয়। এর মধ্যে সয়াবিন তেলে ভাজা ১২০ টাকা, ডালডায় ভাজা ১৬০ টাকা এবং ঘিয়ে ভাজা কটকটি ১৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। রকমভেদে অন্যান্য দোকানের কটকটির দামও কাছাকাছি।
চারকোনা বিস্কুট আকারের এই কটকটি তৈরির জন্য মহাস্থানগড়ের আশপাশে ছোট–বড় অনেক কারখানা গড়ে উঠেছে। ব্যবসায়ীরা জানান, এসব কারখানায় প্রতিদিন গড়ে ১০০ মণের বেশি কটকটি তৈরি হয়।
কয়েকজন কারিগর জানালেন, কটকটি তৈরি করতে প্রথমে ময়দার সঙ্গে মেশানো হয় চালের আটা। সেটা গোলানো হয় পানিতে, সঙ্গে মাখানো হয় ডালডা। এরপর সেটির খামির তৈরি করে ছোট ছোট টুকরা করা হয়। টুকরাগুলো ভাজা হয় ফুটন্ত তেলে। এরপর সেগুলো ডোবানো হয় গুড়ের সিরায়। পরে ঠান্ডা হলে খাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয় কুড়মুড়ে কটকটি।
মাহবুর রহমান নামের একজন কারিগর প্রায় ১৪ বছর ধরে কটকটি তৈরি করেন। তিনি বলেন, আগে কটকটি গরম পানি দিয়ে মাখিয়ে তৈরি হতো। সেই কটকটি ঠান্ডা হয়ে এলে খুব শক্ত হতো। খাওয়ার সময় কটকট শব্দ হতো। এখন নরম করে তৈরি করা হয়, তাই চাহিদাও বেশি হয়েছে।
স্থানীয় লোকজন ও ক্রেতারা জানালেন, বাসস্ট্যান্ডে থামা অবস্থায় ফেরিওয়ালারা যেসব কটকটি বিক্রি করেন, সেগুলোর মান কিছুটা কম। তাই বাসে বসে খাবারটি না কিনে নেমে দোকান যাচাই করে নেওয়া ভালো। না হলে ‘মাস্তানে’র কটকটির উলটো দুর্নাম হতে পারে।
আসমাউল হুসনা নামের একজন ক্রেতা বললেন, তিনি আগেও মহাস্থানগড় থেকে কটকটি কিনে খেয়েছেন। আবার কিনলেন। তাঁর ভাষ্য, দোকান থেকে কিনে খাওয়ার পর সিদ্ধান্ত নেবেন, মাস্তানের কটকটি আবার কেন কিনবেন না?
মাস্তানের কটকটিকে ‘দিল্লি কা লাড্ডুর’ সঙ্গে তুলনা করে তিনি বলেন, ‘এই কটকটি যিনি খাবেন তিনি বারবার পস্তাবেন আর যিনি খাবেন না তিনিও আরও পস্তাবেন।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।