রঞ্জু খন্দকার ও সোহান আমিন, রাজশাহী থেকে: প্রশস্ত চোখজুড়ানো সব সড়ক। সড়কের দ্বীপে ফুটে আছে বাহারি ফুল। কোথাও এক পায়ে দাঁড়ানো তালগাছের সারি। সেগুলোর পাশে বসানো হয়েছে বাতি। সেগুলোও বলিহারি। কোথাও লাগানো হয়েছে প্রজাপতি-বালব, কোথাও যেন জলসাঘরের ঝাড়বাতি। ময়লা-আবর্জনা তো নেই-ই, নেই গাড়িঘোড়ারও চেনা জট।
এই দৃশ্য বিদেশের কোনো শহরের রাস্তাঘাটের নয়, এটি পদ্মানগরী রাজশাহীরই পরিচিত পথের।
প্রায় দুই যুগ পর সম্প্রতি রাজশাহী গিয়েছিলেন আফছানা বেগম। নগরের বিভিন্ন রাস্তায় নেমে সমানে ছবি তুলেছেন তিনি। ছবি তোলার সময় অনেকেই অবাক চোখে দেখছিলেন তাঁকে। কিন্তু তিনি অবাক শহরের সুসজ্জিত রাস্তাঘাট দেখে।
আফছানার বিস্ময়, ‘পুরো শহর এত পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি! এ তো শুধু শহর নয়, যেন সাজানো এক বাগান বা পার্ক! যেখানে যাচ্ছি, সেখানেই ছবি তুলতে ইচ্ছে করছিল। এত সুন্দর শহর দেশে আর আছে?’
চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলা রেজিস্ট্রার হিসেবে কর্মরত আছেন আফছানা বেগম। পাশের শহরে পদায়ন হওয়ায় এক সময়ের স্মৃতির রাজশাহী ঘুরতে গিয়েছিলেন তিনি।
আফছানা জুমবাংলাকে বলেন, প্রায় ২৪ বছর পর রাজশাহী শহরে ঘুরতে গিয়ে অবাক হয়েছেন তিনি। এই দুই যুগে রাজশাহী শহর যেন খোলনলচে বদলে গেছে। কোথায় সেই ঘিঞ্জি রাজশাহী, আর কোথায় এই বাগানের শহর!
শুধু আফছানা বেগম নন, এখন রাজশাহী শহর দেখে মুগ্ধ হবেন যে কেউ-ই। শহরের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে নান্দনিকতার ছোঁয়া।
পরিচ্ছন্ন এই নগরী ঘুরে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, রাজশাহী নামের এই সাজানো বাগানের রূপকার সিটি মেয়র এ.এইচ.এম খায়রুজ্জামান লিটন। তিনি নগরপিতা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বদলে যেতে থাকে রাজশাহীর চেনা রূপ। এক সময়ের ঘিঞ্জি শহর বদলে যায় অপরূপ এক নগরীতে।
রাজশাহীকে নান্দনিক নগরীতে রূপান্তরের গল্প শুনতে চাইলে মেয়র লিটন বলেন, ‘নান্দনিকতার বিষয়টাকে আমি আমার মধ্যে ধারণ করি এবং প্রতি মুহূর্তে হৃদয়ে লালন করি-যার প্রতিফলন এখন নগরবাসী দেখতে পাচ্ছেন। এখানে প্রথম কথা হচ্ছে পরিকল্পনা আর দ্বিতীয় কথা হচ্ছে করবার ইচ্ছে। আমাদের অর্থ সীমিত হলেও এই দুইয়ের সমন্বয়ে নান্দনিক রূপ পাচ্ছে রাজশাহী নগরী।’
তিনি আরও বলেন, ‘দেশের বাইরে অনেক স্থানে আমি গিয়েছি। বড় বড় সিটির যা কিছু ভালো লাগতো সেসবের ছবি তুলে নিয়ে আসতাম। প্রথমবার মেয়র হওয়ার পর রাজশাহীকে একটা নান্দনিক নগরীতে রূপ দিতে কাজ শুরু করি। মাঝখানে একটা গ্যাপ হলেও বর্তমানে রাজশাহী শহরের রাস্তা, ড্রেন, কালভার্ট, স্ট্রিট লাইট, লিংক রোড, পার্কসহ নানা রকম নাগরিক সুবিধা উন্নত দেশের সিটির আদলে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।’
রাজশাহী শহরে প্রায় ২০ বছর আগে রিকশা চালাতে আসেন নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার রশিদ মিয়া। তিনিও বদলে যাওয়া রাজশাহী নগরীর সাক্ষী।
রশিদ মিয়া বলেন, আগে থেকেই রাজশাহী উত্তরাঞ্চলের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ শহর। কিন্তু সে অনুযায়ী শহরটি সাজানো ছিল না। এখন এ শহরে রিকশা চালাতেও ভালো লাগে।
শহর ঘুরে দেখা যায়, নগরীর কোর্ট থেকে তালাইমারী এবং তালাইমারী থেকে ঐতিহ্য চত্ত্বর পর্যন্ত দুটি সড়কই সুপ্রশস্ত। দুটি রাস্তারই সড়কদ্বীপে লাগানো হয়েছে নানা বাহারি ফুলের গাছ। কোথাও ফুটে আছে নীল অপরাজিতা, কোথাওবা কসমস-ক্যামেলিয়া। এই সড়কে বসানো হয়েছে ঝলসাঘরের মতো ঝাড়বাতি।
কোর্ট এলাকার বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম বললেন, ওই দুটি সড়ক এ শহরের গুরুত্বপূর্ণ। আগে এ দুটি সড়কে যানজট লেগেই থাকত। কিন্তু সড়ক সম্প্রসারণের ফলে এ শহরের মানুষ যানজট ভুলে গেছে। আর রাতে যখন সড়কবাতি জ্বলে ওঠে মনে হয় যেন জলসাঘর ঝলমলিয়ে উঠল।
শহর ঘুরে আরও দেখা যায়, নগরীর আলিফ-লাম-মীম ভাটার মোড় থেকে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি) পর্যন্ত রাস্তাটিও সুপ্রশস্ত। এ রাস্তাটিতেও সৌন্দর্যবর্ধন করা হয়েছে। এ রাস্তায় বসানো হয়েছে প্রজাপতি-বাতি।
আলিফ-লাম-মিম ভাটার মোড় এলাকার বাসিন্দা আবুল কালাম বলেন, প্রজাপতি-বাতি এ সড়কের সৌন্দর্য বাড়িয়েছে বহুগুণ। যখন এ রাস্তায় বাতি জ্বালানো হয়, মনে হয় প্রজাপতির পাখনায় জ্বলছে আলো। সে আলোয় আলোকিত হচ্ছে চারপাশ।
এ নগরে জীবিকার টানে ২০০৭ সালে আসেন বেসরকারি কোম্পানির কর্মকর্তা রিপন মন্ডল। তাঁর বাড়ি গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার কুমারগাড়ী গ্রামে। তিনি এখন রাজশাহী শহরের স্থায়ী বাসিন্দা। চোখের সামনে এ নগরকে পালটে যেতে দেখেছেন তিনি।
রিপন বলেন, প্রথম দিকে এ শহর তাঁর ভালো লাগেনি। উত্তরাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ এ শহরটি তখন ছিল অবহেলার আরেক নাম। ছিল ঘিঞ্জি, আবর্জনাময়। এরপর লিটন ভাই মেয়র হওয়ার পর বদলে যেতে থাকে এ শহর। এখন আর এ শহর ছেড়ে যেতেই ইচ্ছে হয় না।
বন্ধুদের কাছে গল্প শুনে সম্প্রতি ঢাকা থেকে রাজশাহী শহরে ঘুরতে গিয়েছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তা মাজেদুল হক প্রিন্স। তিনি জুমবাংলাকে বলেন, ‘শহরটির পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, প্রশস্ত রাস্তা, উন্নত ড্রেনেজ ব্যবস্থা, সবুজায়ন, আলোকায়ন, দৃষ্টিনন্দন সড়ক বিভাজক ও বিনোদন কেন্দ্র আমাকে মুগ্ধ করেছে। এ শহর ঘুরে দেখলে যে কাউকে চোখের প্রশান্তি দেবে।’
সিটি মেয়র এ.এইচ.এম খায়রুজ্জামান লিটন নগরবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, নগরবাসী সহযোগিতা না করলে এই শহরকে নান্দনিক শহরে রূপান্তরের কাজ আমার পক্ষে কঠিন হয়ে যেতো। আমি ইতোমধ্যে দুই লেইনের সড়কগুলোকে ভেঙে চার লেইন করেছি। রাস্তা প্রশস্তকরণের জন্য নাগরিকদের যখন যে অনুরোধ করেছি তখন তারা সেটা সানন্দে মেনে নিয়েছে, কোনও প্রতিবাদ করেনি।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।