মুমিনের ধ্বংস ও মুক্তির ছয় বৈশিষ্ট্য
জাফর আহমাদ : হজরত আবু হোরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘তিনটি বস্তু মুক্তিদানকারী ও তিনটি বস্তু ধ্বংসকারী। মুক্তিদানকারী তিনটি বস্তু হলো- ১. গোপনে ও প্রকাশ্যে আল্লাহকে ভয় করা; ২. সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টিতে সত্য কথা বলা; ৩. সচ্ছলতা ও অসচ্ছলতায় মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা। আর ধ্বংসকারী তিনটি বস্তু হলো- ১. প্রবৃত্তি পূজারী হওয়া; ২. লোভের দাস হওয়া এবং ৩. আত্ম অহঙ্কারী হওয়া। আর এটিই হলো সবচেয়ে মারাত্মক’ (মিশকাত-৫১২২)।
তাকওয়া : তাকওয়া অর্থ আল্লাহকে ভয় করা। তাকওয়া একজন মুমিনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। একজন মুমিন তার জীবন চলার পথে ভালো-মন্দ যাচাইয়ের অনুপ্রেরণা জোগায় তাকওয়া। এই তাকওয়া অর্জনে বিশ্ব মুসলিম প্রতি বছর এক বিশেষ প্রশিক্ষণে অবতীর্ণ হয়। এক মাসের এই প্রশিক্ষণের নাম রমজানুল কারিমের রোজা। এই রোজা তাকে একমাস জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাঁটি সোনায় রূপান্তর করে। এই প্রশিক্ষণ কর্মশালা থেকে বের হয় মুত্তাকি নামক সোনার মানুষ। এই প্রশিক্ষণ তার মধ্যে এমন কতগুলো বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করে দেয় যা নিম্নোল্লিখিত আয়াতে আল্লাহ বিবৃত করেছেন- ‘প্রকৃতপক্ষে যারা মুত্তাকি, তাদেরকে যদি কখনো শয়তানের প্রভাবে অসৎ চিন্তা স্পর্শও করে যায় তাহলে তারা তখনই সতর্ক হয়ে উঠে তারপর তারা নিজেদের সঠিক কর্মপদ্ধতি পরিষ্কার দেখতে পায়। আর তাদের (শয়তানের) ভাই-বন্ধুরা তো তাদেরকে তাদের বাঁকা পথেই টেনে নিয়ে যেতে থাকে এবং তাদেরকে বিভ্রান্ত করার ব্যাপারে তারা কোনো ত্রুটি করে না’ (সূরা আরাফ : ২০১-২০২)।
তাকওয়া মানুষকে প্রবৃত্তির তাড়না থেকে সংযত রাখে। কারণ তাকওয়াধারী তথা মুত্তাকিদের সহায়ক শক্তি হলো বিবেক আর তাদের প্রধান শত্রু হলো নফস তথা প্রবৃত্তি। যারা মুত্তাকি তাদের নফস থেকে বিবেক শক্তিশালী হয় বিধায় তারা কখনো নফস তথা প্রবৃত্তির পূজারী হয় না। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘যে ব্যক্তি তার প্রভুর সামনে দণ্ডায়মান হওয়ার ভয় করে এবং নিজেকে প্রবৃত্তির গোলামি থেকে বিরত রাখে জান্নাত তার ঠিকানা হবে’ (সূরা নাচিয়াত : ৪০-৪১)।
সদা সত্য কথা বলা : আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সাথে থাকো’ (সূরা তাওবা-১১৯)। আব্দুল্লাহ রা: থেকে বর্ণিত- নবী সা: বলেছেন, ‘সত্য নেকির দিকে পরিচালিত করে আর নেকি জান্নাতে পৌঁছায়। আর মানুষ সত্যের ওপর কায়েম থেকে অবশেষে সিদ্দিকের দরজা লাভ করে। আর মিথ্যা মানুষকে পাপের দিকে নিয়ে যায়। পাপ তাকে জাহান্নামে নিয়ে যায়। আর মানুষ মিথ্যা কথা বলতে বলতে অবশেষে আল্লাহর কাছে মহা মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন হয়ে যায়’ (বুখারি-৬০৯৪)।
সচ্ছলতা ও অসচ্ছলতায় মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা : ‘তোমার চাল-চলনে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করো এবং কণ্ঠস্বর খাটো করো’ (সূরা লোকমান-১৯)। ইসলাম কৃপণতার পাশাপাশি অপচয় বা মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়কেও অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে। অপচয়কারীকে শয়তানের ভাই হিসেবে সম্বন্ধযুক্ত করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আর সীমা অতিক্রম করো না। কারণ সীমা অতিক্রমকারীদেরকে আল্লাহ পছন্দ করেন না’ (সূরা আনয়াম-১৪১)। ‘অপব্যয় করো না। অপব্যয়কারী শয়তানের ভাই, আর শয়তান হচ্ছে তার প্রভুর প্রতি অকৃতজ্ঞ’ (সূরা বনি ইসরাইল : ২৬-২৭)।
এই দুই প্রান্তিক চরিত্রের মাঝামাঝি ইসলাম মধ্যমপন্থা অবলম্বনের জন্য জোর তাগিদ দিয়েছে। একটি ভারসাম্যপূর্ণ জাতির নেতা হিসেবে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর রাসূল সা:-কে এ ধরনের নির্দেশই দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘তোমার হাত গলার সাথে বেঁধে রেখো না, (অর্থাৎ ব্যয়ের বেলায় কৃপণ হয়ো না) আর একেবারে খোলা ছেড়েও দিও না (অর্থাৎ নিজের সব কিছু উজাড় করে দিয়ে খালি হাতে বসে থেকো না) অন্যথায় তুমি তিরস্কৃত ও অক্ষম হয়ে যাবে’ (সূরা বনি ইসরাইল-২৯)। এর অর্থ হলো- লোকদের মধ্যে এতটুকু ভারসাম্য থাকতে হবে যাতে তারা কৃপণ হয়ে অর্থের আবর্তন রুখে না দেয় এবং অপব্যয়ী হয়ে নিজের অর্থনৈতিক শক্তি ধ্বংস না করে ফেলে। এ দু’টির মাঝামাঝি তাদের মধ্যে ভারসাম্যের এমন সঠিক অনুভূতি থাকতে হবে যার ফলে তারা যথার্থ ব্যয় থেকে বিরত হবে না। আবার অযথা ব্যয়জনিত ক্ষতিরও শিকার হবে না।
ধ্বংসকারী তিনটি বস্তু
প্রবৃত্তি পূজারী হওয়া : যাদের বিবেক দুর্বল এবং নফস সবল তারাই কেবল প্রবৃত্তি পূজারী হয়ে থাকে। আল্লাহ বলেন- ‘তুমি কাফেরদের বলে দাও যে, আল্লাহকে ছেড়ে তোমরা যাদের ডাকো, তাদের ইবাদত করতে আমাকে নিষেধ করা হয়েছে। বলে দাও যে, আমি তোমাদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করব না। তাতে আমি পথভ্রষ্ট হয়ে যাব এবং সুপথপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত থাকব না’ (সূরা আনআম-৫৬)। আল্লাহ বলেন, ‘তুমি কি তাকে দেখেছ, যে তার প্রবৃত্তিকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করেছে? তুমি কি তার জিম্মাদার হবে’ (সূরা ফুরকান-৪৩)? রাসূলুল্লাহ সা: দোয়া করে বলতেন, ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে আশ্রয় চাই অন্যায় চরিত্র, কর্ম ও প্রবৃত্তি পূজা হতে’ (তিরমিজি)। হজরত আলী রা: বলেন, ‘আমি তোমাদের ব্যাপারে সবচেয়ে ভীত হই দু’টি বিষয়ে। দীর্ঘ আকাক্সক্ষা ও প্রবৃত্তি পূজা। দীর্ঘ আকাক্সক্ষা মানুষকে আখিরাত ভুলিয়ে দেয়। অতঃপর প্রবৃত্তি পূজা মানুষকে সত্য থেকে বিরত রাখে’ (ইমাম আহমাদ)।
লোভের দাস হওয়া : আল্লাহ তায়ালা ইহুদিদের সম্পর্কে বলেন, ‘তুমি তাদেরকে পাবে পার্থিব জীবনের প্রতি অন্যদের চেয়ে অধিক আসক্ত, এমনকি মুশরিকদের চেয়েও। তাদের প্রত্যেকে কামনা করে যেন সে হাজার বছর বেঁচে থাকে। অথচ এরূপ দীর্ঘ আয়ু তাদেরকে শাস্তি থেকে দূরে রাখতে পারবে না। বস্তুত তারা যা করে, সবই আল্লাহ দেখেন’ (সূরা বাকারা-৯৬)। আব্দুল্লাহ ইবনে অব্বাস রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘যদি আদম সন্তানকে এক ময়দান ভর্তি স্বর্ণ দেয়া হয়, তাহলে সে দুই ময়দান ভর্তি স্বর্ণের আকাক্সক্ষা করবে। আর তার মুখ কখনোই ভরবে না মাটি ছাড়া। বস্তুত আল্লাহ তওবাকারীদের তওবা কবুল করে থাকেন’ (বুখারি-৬৪৩৯)। আনাস রা: উবাই ইবনু কাব থেকে বর্ণনা করেন- তিনি বলেছেন, আমরা ধারণা করছিলাম এটি কুরআনেরই অন্তর্গত। অবশেষে তাকাসুর নাজিল হলো’ (বুখারি-৬৪৪০)।
আত্ম অহঙ্কারী হওয়া : আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘লোকদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে কথা বলো না, আর গর্বভরে জমিনে হাঁটা-চলা করো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো আত্ম-অহঙ্কারী, দাম্ভিক লোককে পছন্দ করেন না’ (সূরা লোকমান-১৮)। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘ওই ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না যার অন্তরে কণা পরিমাণ অহঙ্কার রয়েছে। জনৈক ব্যক্তি প্রশ্ন করল, লোকেরা চায় যে, তার পোশাক সুন্দর হোক, তার জুতা সুন্দর হোক। জবাবে তিনি বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ সুন্দর। তিনি সৌন্দর্যকে পছন্দ করেন। অহঙ্কার হলো, সত্যকে দম্ভের সাথে পরিত্যাগ করা এবং মানুষকে তুচ্ছ জ্ঞান করা’ (মুসলিম-১৬৬)।
মানুষকে তিনটি জিনিস মুক্তি দান করে। তাকওয়া, সত্য কথা বলা ও মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা। এই তিনটি বিষয় মুমিন জীবনকে সফলতার দিকে নিয়ে যায়। পক্ষান্তরে তিনটি জিনিস তথা প্রবৃত্তি পূজা, লোভ-লালসা ও আত্ম অহঙ্কার মানুষকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। দুনিয়াতেই সে তার চার দিকে বিপর্যয় ছড়িয়ে দেয় এবং অবশেষে এই বিপর্যয়ের মধ্যেই তার সমাধি রচিত হয়।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।