বিনোদন ডেস্ক : মের্ল ওবেরন, ভারতে জন্ম নেওয়া সাদাকালো যুগের এই হলিউড তারকা জন্মভূমিতেই বিস্মৃত।
হলিউডের স্বর্ণযুগের এই তারকা নিজের ভারতীয় পরিচয়কে কখনও সামনে আনেননি, জীবনভর নিজেকে তুলে ধরেছেন ‘সাদা’ হিসেবে।
এই ব্রিটিশ-মার্কিন অভিনেত্রী জীবদ্দশায় তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা আড়ালে সরিয়ে রেখেছিলেন সাংবাদিকের দুর্নিবার কৌতূহলের মধ্যেও। অভিনেত্রী হিসেবে খ্যাতি পেয়ে অস্ট্রেলিয়ায় তাসমানিয়াকে বেছে নেন জন্মস্থান হিসেবে।
জন্মভূমে বিস্মৃত এই হলিউড অভিনেত্রীর জীবনগাথা তুলে এনেছে বিবিসি।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক লেখক ও শিক্ষাবিদ ময়ূখ সেন ওবেরনে নিয়ে প্রধম ধন্দে পড়েন ২০০৯ সালে, যখন তিনি জানতে পারেন ওবেরন দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত প্রথম অভিনেত্রী, যিনি মনোনীত হয়েছেন অস্কারের জন্য।
ওবেরন অভিনীত সিনেমা দেখে এবং তার অতীত জীবন সম্পর্কে ধীরে ধীরে জানতে পরে লেখক ময়ূখ সেনের মুগ্ধতা বেড়ে যায়। একটি প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকাতে নিজের পরিচয়ের একটি অংশ লুকিয়ে রাখার যে লড়াই ওবেরন করেছেন তার প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন ময়ূখ সেন। তিনি বর্তমানে ওবেরনের জীবনী নিয়ে কাজ করছেন।
এমিলি ব্রনটির সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘ওয়াদারিং হাইটস’ এর সিনেমায় প্রধান চরিত্রে অভিনয় করে তুমুল পরিচিতি পাওয়া এই অ্যাংলো ইন্ডিয়ান অভিনেত্রীর জন্ম ১৯১১ সালে মুম্বাইয়ে।
ব্রিটিশ বাবা এবং সিংহলি ও মাওরি মিশেল মায়ের মেয়ে ওবেরনের পুরো নাম এস্টেল মের্ল ও’ব্রায়েন থম্পসন। মাত্র তিন বছর বয়সে বাবাকে হারান ওবেরন, এর পর ১৯১৭ সালে তার পরিবার মুম্বাইয়ের পাট চুকিয়ে চলে যান কলকাতায়। তার অভিনয় জীবন শুরু জন্মদেশ ভারতে, কলকাতার অ্যামেচার থিয়েট্রিক্যাল সোসাইটিতে ১৯২০ সালে কাজ শুরুর মধ্য দিয়ে।
ময়ূখ সেন জানতে পেরেছেন, ওবরেনকে অভিনেত্রী হতে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন ‘দ্য ডার্ক অ্যাঞ্জেল’ নামের একটি নির্বাক চলচ্চিত্রের অভিনেতা ভিলমা বাঙ্কি, যা মুক্তি পেয়েছিল ১৯২৫ সালে।
অভিনয়ের প্রতি আকাঙ্ক্ষায় ওবেরন দেশ ছেড়ে ফ্রান্সে পাড়ি জমান ১৯২৮ সালে। একজন সেনা কর্মকর্তা পরিচালক রেক্স ইনগ্রামের সঙ্গে ওবেরনের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, ওই পরিচালক ওবেরনকে তার সিনেমার একটি বড় কাজের জায়গায় সুযোগ করে দেন।
অভিনয়ে ওবরেনের বড় সুযোগ আসে চলচ্চিত্র নির্মাতা স্যার আলেকজান্ডার কোর্দার কাছ থেকে, যাকে পরবর্তীতে জীবনসঙ্গী করেছিলেন ওবেরন। ১৯৩৩ সালে দি প্রাইভেট লাইফ অব হেনরি এইট সিনেমাটিকে অ্যানি বোলনের চরিত্র রূপায়ন করেন তিনি।
তাসমানিয়ার ওবেরনের নতুন জন্মস্থান হিসেবে বেছে নিতে হয়, কারণ এটি যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ থেকে অনেক দূরে। সাধারণ এটির মূল অংশ ব্রিটিশ বলে সে সময় বিবেচিত হত।
ওবেরনকে নিয়ে তৈরি তথ্যচিত্র ‘দ্য ট্রাবল উইথ মের্ল’ এ পরিচালক মারি ডেলোফস্কি এই বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন।
তাতে আরও জানা যায়, ফ্রান্সে পাড়ি জমানোর সময় ওবেরনের সঙ্গে তার মা হিসেবে যে শার্লট সেলবি ছিলেন, তিনি আসলে তার মা ছিলেন না, তিনি ছিলেন নানি। কিশোরী বয়সে সেলবির মেয়ে কনস্ট্যান্স মেয়ের জন্ম দেন। তখন কনস্ট্যান্স ও ওবেরনকে দুই বোন হিসেবে দেখিয়ে বড় করছিলেন সেলবি।
ডেলোফস্কি বলেন, শিকার করার সময় দুর্ঘটনায় ওবেরনের বাবা মারা যাওয়ার পর তারা ভারত ছেড়েছিলেন।
মের্ল ওবেরন আজীবন নিজের ভারতীয় পরিচয় লুকিয়ে রেখেছিলেন।মের্ল ওবেরন আজীবন নিজের ভারতীয় পরিচয় লুকিয়ে রেখেছিলেন।
ওবেরন ধীরে ধীরে তাসমানিয়ার সঙ্গে মিশে যান এবং বাকী কর্মজীবনে অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়া তাকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়। এমনকি তিনি তাসমানিয়াকে নিজের শহর হিসেবেও স্বীকার করেছেন, অথচ কলকাতার কথা খুবই কম শোনা গেছে তার মুখে।
কিন্তু কলকাতা ওবেরনকে মনে রেখেছে। সাংবাদিক সুনন্দা দত্ত রায় বলেছেন, ১৯২০ এবং ৩০ এর দশকে অনেক ইংরেজের স্মৃতিচারণে ওবেরনের নাম শোনা গেছে।
অভিনয় জগতে ওবেরন শক্তপোক্ত একটি জায়গা তৈরি করেন ১৯৩৯ সালে ওয়াদারিং হাইটস দিয়ে, কিংবদন্তি লরেন্স অলিভিয়ারের বিপরীতে তার অভিনয় সবার নজর কাড়ে।
নিউ ইয়র্ক টাইমস ছবিটির রিভিউয়ে বলেছিল, ওবেরন নায়িকা ক্যাথরিনের চরিত্রটি পুরোপুরি ধরে ফেলতে পেরেছিলেন।
ময়ূখ সেন বলছেন, ১৯৩০ সালের শেষ দিক থেকেই ওবেরন তথাকথিত বড় জগতে পা রাখে। সে সময়ের নামীদামী মিউজিক কম্পোজার কোল পোর্টার এবং নাট্যকার নোয়েল কাওয়ার্ডের মতো ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে তার ওঠাবসা ছিল।
স্বামী চিত্রপরিচারক কোর্ডা এবং প্রবীণ প্রযোজক স্যামুয়েল গোল্ডউইন ওবেরনকে অভিনয়ে আত্মস্থ হতে সহযোগিতা করেছিলেন বলেও ময়ূখ সেন জানান। বিশেষ করে তার উচ্চারণকে পরিশীলিত করার কাজটিতে। পর্দায় ‘সাদা’ অভিনেত্রী হতে কাজে দিয়েছিলে ওবেরনের মিশ্র বর্ণ।
এমনকি এখনও জাতিগত ‘মিশ্রতা’ প্রসঙ্গে নিয়ে আলোচনা বন্ধ করার প্রয়োজন অনুভব করেন বলে জানান ময়ূখ সেন।
কেউ কেউ দাবি করেন ত্বক সাদা করতে ব্লিচিং-চিকিৎসায় ওবরেনের ত্বক আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এছাড়া ১৯৩৭ সালে গাড়ি দুর্ঘটনায় মুখে আঘাত পান। এরপর চিত্রগ্রাহক ল্যুসিয়েন ব্যালার্ড এমন কৌশলে কাজ করেছিলেন যে দুর্ঘটনা পরবর্তী সিনেমাগুলোয় ওবেরনের মুখের দাগগুলো স্পষ্ট দেখাত না।
এর পরে কোর্ডাকে ছেড়ে ১৯৪৫ সালে চিত্রগ্রাহক ল্যুসিয়েন ব্যালার্ডকে বিয়ে করেন ওবেরন।
ওবরেনের পক্ষে তার পূর্বজীবন অন্তরালে রাখা দিনকে দিন কঠিন হয়ে পড়ে। এ সম্পর্কে স্থানীয় সাংবাদিকদের কৌতূহল আছে জানার পর ওবেরন একটি অনুষ্ঠান বাতিল করেন এবং অস্ট্রেলিয়া সফর সংক্ষিপ্ত করেন। ১৯৭৮ সালে তাসমানিয়ায় তার শেষ সফরের সময় তাকে ঘিরে ঘুরপাক খেতে থাকা প্রশ্ন এবং কৌতূহলের জন্য যথেষ্ট বিরক্ত ছিলেন এই অভিনেত্রী।
আমৃত্যু এই অভিনেত্রী নিজের অতীত জীবন নিয়ে গোপনীয়তা বজায় রাখেন, জনসম্মুখে কখনই বিষয়টি নিয়ে মুখ খোলেননি। এই অভিনয়শিল্পীর মৃত্যু হয় ১৯৭৯ সালে।
১৯৮৩ সালে জীবনীগ্রন্থ ‘প্রিন্সেস মের্ল; দ্য রোমান্টিক লাইফ অব মের্ল’ এ তার অ্যাংলো ইন্ডিয়ান জীবনের কথা প্রকাশ পায়। মুম্বাইয়ে তার জন্মের রেকর্ড, প্রশংসাপত্র ও ভারতীয় আত্মীয়দের চিঠি ও ছবি খুঁজে পান লেখকরা।
ময়ূখ সেন মনে করেন, যে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ওবেরন চলেছিলেন সেটি সহজ ছিল না। এই লেখক আশা করছেন, ওবেরনকে নিয়ে তার লেখা বইয়ে, একজন দক্ষিণ এশীয় নারী হিসেবে অভিনয় জীবনে যোগ্যতা প্রমাণ এবং লড়াই করার বিশাল চাপের মুখোমুখি হওয়া ওবেরনকে ফুটিয়ে তুলতে পারবেন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।