স্পোর্টস ডেস্ক: দক্ষিণ আমেরিকার অন্যান্য দেশ ব্রাজিল, কলম্বিয়া, বলিভিয়া, এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ উরুগুয়ের ফুটবল দলে কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড় যেরকম চোখে পড়ে, আর্জেন্টিনায় কি কখনো সেরকম পড়েছে?
ব্রাজিলের কালো মানিক ‘পেলে’ থেকে শুরু করে রিভালদো, রোনালদিনহো কিংবা নেইমার, কেউই শ্বেতাঙ্গ নন। চিলির ভিদাল কিংবা কলম্বিয়ার হামেস রদ্রিগেজের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি তাই। একই চিত্র চোখে পড়বে লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশেও।
তবে আর্জেন্টিনার ফুটবল দলে কেমন এমনটি নয়? আর্জেন্টিনায় কি কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী নেই? আর থাকলেও কেন আর্জেন্টিনায় কৃষ্ণাঙ্গদের সংখ্যা কম?
একটি জরিপে দেখা যায়, আর্জেন্টিনায় ৪ থেকে ৬ শতাংশ ব্যক্তির দেহে আফ্রিকান জিন রয়েছে। আর্জেন্টিনা সরকারের ২০১০ সালের জরিপ অনুসারে, দেশটিতে কালো মানুষের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৪৯ হাজারের কিছু বেশি—যা কিনা মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশেরও কম।
কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগ পর্যন্তও আর্জেন্টিনার জনসংখ্যার বেশ বড় অংশ ছিল কৃষ্ণাঙ্গ। কোথায় হারিয়ে গেল তারা? এর উত্তর: যুদ্ধ আর মহামারি। তবে এর সাথে জড়িয়ে আছে আর্জেন্টিনার লজ্জাজনক ইতিহাসও। নিয়ম করে আর্জেন্টিনা থেকে নির্মূল করা হয় কৃষ্ণাঙ্গদের।
রাজধানী বুয়েনোস আইরেস থেকে এক হাজার কিলোমিটার উত্তরের শহর করিয়েন্তেস-এ দুইশ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রতিবছর উদযাপন করা হয় এক বিশেষ উৎসব, স্যান বালতাজার। এই উৎসবের সবকিছুই এসেছে কৃষ্ণাঙ্গদের সংস্কৃতি থেকে, আফ্রিকা থেকে। কিন্তু সেখানে চিরুনি দিয়ে খুঁজলেও কোনো কৃষ্ণাঙ্গকে চোখে পড়বে না। কারণ? কারণ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে কৃষ্ণাঙ্গদেরকে আর্জেন্টিনার ইতিহাস থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে।
করিয়েন্তেস শহরের কামা কুয়া কুয়া এলাকার বিশাল অংশজুড়ে এক স্প্যানিশ জমিদার থাকতেন, নাম রাইমুন্দো মোলিনা। এই জমিদারের অধীনে প্রচুর কৃষ্ণাঙ্গ দাস ছিল। নৃতত্ত্ববিদ মারিয়া বেলেন জানিনোভিচ এই বাড়ি থেকেই প্রচুর আফ্রিকা থেকে উদ্ভূত জিনিস পেয়েছেন, যার সাথে মিশে রয়েছে উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত বাড়িটিতে কাজ করা কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের ইতিহাস।
জানিনোভিচ জানান, ‘করিয়েন্তেস শহরের সবাই শ্বেতাঙ্গে পরিণত হয়েছে, কিন্তু এখনো কারও কারও কোঁকড়া চুল আর কানের গোড়া দেখলে বোঝা যায় তাদের পূর্বপুরুষদের কেউ কেউ কৃষ্ণাঙ্গ ছিলেন।’
এরকমই একজন স্যান বালতাজার উৎসব আয়োজনের সাথে যুক্ত অসভালদো কাবায়েরো। উরুগুয়ে ও প্যারাগুয়েতে পাঠিয়ে দেওয়া দাসদের বংশধর হিসেবে নিজেকে দাবি করেন তিনি।
কাবায়েরোর মতে, ‘পূর্বপুরুষ কৃষ্ণাঙ্গ দাস ছিল এমন পরিচয় এখানে কেউ প্রকাশ করতে চায় না, কারণ এটি সামাজিক মর্যাদা কমিয়ে দেবে। এ কারণে কৃষ্ণাঙ্গদের বংশধররা তাদের পূর্বপুরুষদের ইতিহাস গোপন রাখতে চায়।’
ইতিহাসবিদ ফেলিপে পিগনা বলেন, করিয়েন্তেসের কৃষ্ণাঙ্গদের বিশেষ ব্যবস্থা করে নির্মূল করে দেওয়া হয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কৃষ্ণাঙ্গদের জোর করে সেনাবাহিনীতে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হতো। আর সবার আগে তাদেরকেই সম্মুখ সমরে পাঠিয়ে দেওয়া হতো। ফলে যুদ্ধে বিপুলসংখ্যক কৃষ্ণাঙ্গ মারা যায়।
একই ধারা চলতে থাকে গৃহযুদ্ধের সময়ও এবং ছয় বছর ধরে চলা প্যারাগুয়ের সঙ্গে যুদ্ধের সময়েও। তারপর কৃষ্ণাঙ্গদেরকে শহরের সীমানা ছাড়িয়ে বনের দিকে চলে যেতে বাধ্য করা হয়, যেখানে তারা কলেরা ও বসন্তের শিকার হয়।
মহামারির কবলে পড়ে কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী কমে আসে আরও। নারী-পুরুষের অনুপাতের ব্যবধান বেড়ে যায় অনেক। প্যারাগুয়ে, উরুগুয়ে, বলিভিয়াতেও পাঠিয়ে দেওয়া হয় অনেক দাসকে।
এছাড়াও আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের জন্মহারও ছিল তুলনামূলক কম। দাসমালিকরা তাদের দাস-দাসিদের বিয়ে করতে অথবা বাচ্চা নিতে দিত না, কারণ গর্ভবতী হয়ে পড়লে নারীরা কাজ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তাছাড়া গর্ভধারণের সময় মৃত্যুঝুঁকিও অনেক, যার ঝুঁকি দাসমালিকরা নিতে চাইত না। এসব কারণে কৃষ্ণাঙ্গদের সংখ্যা প্রায় শূন্য হয়ে যায়।
এছাড়া আর্জেন্টিনার সাদা নেতারাও—যেমন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোমিঙ্গো ফস্টিনো সারমিয়েন্তো—কৃষ্ণাঙ্গদের ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দিতে ভিন্ন বয়ান তৈরি করেছেন। কারণ তাদের কাছে ‘সাদা রং’ আধুনিকতার ধারক-বাহক। আর্জেন্টিনার বহু শ্বেতাঙ্গ নেতার বিশ্বাস ছিল, জার্মানি, ফ্রান্স, ইংল্যান্ডের মতো ইউরোপের উন্নত দেশগুলোর সমমর্যাদায় উন্নীত হতে চাইলে সব উপায়েই কালো মানুষদের হাত থেকে তাদের ‘নিস্তার’ পেতে হবে।
১৮৫০-এর দশকে আর্জেন্টাইন রাজনৈতিক তাত্ত্বিক ও কূটনীতিক হুয়ান বাতিস্তা আলবার্দিও দেশে শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয়দের অভিবাসনের পক্ষে প্রচারণা চালাতেন।
স্যান বালতাজার উৎসব, উৎসবের ট্যাঙ্গো নাচ কিংবা জেম্বা ঢোল, সবই এসেছে আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ সংস্কৃতি থেকে। কিন্তু সংস্কৃতির উপাদান থেকে গেলেও কৃষ্ণাঙ্গরা সেখান থেকে উচ্ছেদের শিকার হয়েছে।
বর্তমানে আর্জেন্টিনায় যাদেরকে ‘নিগ্রো’ বলা হয়, তারা মূলত শংকর। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে তারাও নিজেদেরকে সাদা বানানোর চেষ্টা করেছে। কারণ সামান্য কৃষ্ণাঙ্গ জিনও তাদের সামাজিক মর্যাদা কমিয়ে দিতে পারে কয়েকগুণ।
সূত্র: এলপাইস ও নিউ ইয়র্ক টাইমস
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।