অতিথি আপ্যায়ন থেকে নাশতা, আড্ডা কিংবা অকারণ স্ন্যাকের নেশা তাড়ানো, মিলাদের তবারক কিংবা কোনো অনুষ্ঠানের নাশতার বাক্সে মিষ্টির সঙ্গী এই শিঙাড়া। বাইরে ময়দার মোড়ক, ভেতরে আলু–সবজি–বাদাম কিংবা কলিজা পুর। তারপর সেটাকে ফুটন্ত তেলে ডুবো করে ভেজে তোলা—এরই নাম শিঙাড়া; বাঙালির এক অকৃত্রিম ভালোবাসা।
কলিজা শিঙাড়া কিংবা বাদাম দেওয়া শিঙাড়া, যার যার স্বাদগ্রন্থি অনুযায়ী পুর পছন্দ হলেও, আস্ত শিঙাড়াকে এই অঞ্চলের সবচেয়ে জনপ্রিয় স্ন্যাক বলাই যায়। শিঙাড়া বাঙালি খাবার না হয়েও কী করে হলো এত জনপ্রিয়, সে ইতিহাস বেশ চমকপ্রদ। দশম শতাব্দীর ইরানি ইতিহাসবিদ আবুল ফজল বেহাগি তাঁর ‘তারিখ-ই-বেহাগি’তে প্রথম সামবুসাকের কথা উল্লেখ করেন। একদল ইতিহাসবিদের মতে, ফারসি শব্দ ‘সংবোসাগ’ থেকেই এই শিঙাড়া শব্দের উৎপত্তি।
অনেক খাদ্যবিশারদ বলেন, গজনবী সম্রাটের দরবারে একধরনের নোনতা মুচমুচে খাবার পরিবেশন করা হতো। যার মধ্যে মাংসের কিমা, শুকনো বাদামজাতীয় অনেক কিছু দেওয়া হতো। এটাকেই শিঙাড়ার আদি রূপ বলা যেতে পারে। সাম্বুসা থেকেই স্থান এবং সময়ভেদে সামোসা বা বাঙালির শিঙাড়া এসেছে বলে ধারণা করা হয়।
আজকের আলুর পুরভরা শিঙাড়ার চল শুরু হয় পর্তুগিজদের হাত ধরেই। তার আগে পর্যন্ত শিঙাড়া মানে ছিল মাংসের পুরভরা ত্রিকোণ বস্তু। সপ্তদশ শতকে ভারতের পশ্চিম উপকূলজুড়ে পর্তুগিজদের ব্যাপক আলু চাষের প্রভাব এসে পড়ে তিনকোনা এই খাবারটিতেও।
প্রচলিত আরেক ইতিহাসে জানা যায়, পশ্চিম উপকূল ধরে মহারাষ্ট্র বা গুজরাটে বর্ণ হিন্দু নিরামিষাশীদের এক বিশাল জনগোষ্ঠী বসবাস করে, যারা মাংসের স্বাদ স্বেচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় বর্জন করেছে। তাদের মধ্যেও আলুর মাখো মাখো ভালোবাসা ক্রমেই জনপ্রিয়তা লাভ করে।
তবে শিঙাড়ার পুর অথবা নাম যা–ই হোক না কেন, পৃথিবীর প্রায় সব জায়গাতেই শিঙাড়ার আকার কিন্তু হয় একরকমই—ত্রিকোণ। আর তারই পেটের মধ্যে ভরা থাকে পুর। অনেকেই এই বিষয়ে নানা যুক্তি দেখালেও কোনো প্রামাণ্য নথি মেলে না। ধারণা করা হয়, পুর ভরতে সুবিধার জন্য একে গোল বা লম্বা আকৃতির না করে তিনকোণা করা হয়েছিল।
এই ধারণার পাশাপাশি শিঙাড়ার এই ত্রিকোণাকৃতি নিয়ে আরও একটি গল্প শোনা যায়। ১৭৬৬ সালের ঘটনা, কৃষ্ণনগরের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভায় সে সময় রাজ-হালুইকর হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন কলিঙ্গ তথা বর্তমান ওডিশা থেকে আগত গুণীনাথ হালুইকরের ছেলে গিরীধারী হালুইকর। কথিত আছে, তাঁর স্ত্রী ধরিত্রী দেবীই নাকি আবিষ্কার করেছিলেন শিঙাড়া।
একদিন রাজ–হালুইকরের বানানো লুচি খেয়ে রেগে গেলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র। নেতানো লুচির স্বাদ মুখে লাগল না। প্রচণ্ড রেগে রাজা হুকুম দিলেন তাঁকে রাজ্য ছেড়ে দেবার।সে সময় তাঁর স্ত্রী একটা বুদ্ধি ফেঁদে বসলেন। রাজদরবারে গিয়ে বললেন সুযোগ পেলে সে এমন একটা লুচি তরকারি রান্না করে খাওয়াতে পারে, যা অনেকক্ষণ গরম থাকবে। এমনকি ভাজার সঙ্গে সঙ্গে খেলে রাজার জিবের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে বলেও জানান। এই ভেবেই তিনি ঠিক করেন এই আকারের মুখরোচক খাবার তৈরির কথা।
তিন পাটে ময়দার খোলস করে তার মধ্যে তরকারি ভরে ছ্যাঁকা তেলে ভাজা হয় বলেই ভেতর থেকে অনেকক্ষণ গরম থাকে। এই খাবার খেয়ে বেজায় খুশি হয়ে রাজা–হালুইকরের শাস্তি বাতিল করেন এবং ধরিত্রী দেবীকে মুক্তার মালা উপহার দেন। কথিত আছে, এই থেকেই এমন ত্রিকোণ শিঙাড়ার প্রচলন শুরু হয়। এবার ইতিহাস ছেড়ে বর্তমানে ফেরা যাক। ঢাকার ভোজনরসিকদের কাছ থেকে পাওয়া উপাত্তে থাকল কিছু মুখরোচক শিঙাড়ার সন্ধান।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।