অল্লু অর্জুন এবং রেশ্মিকা মন্দানা অভিনীত ‘পুষ্পা: দ্য রাইজ’ ইতিমধ্যেই গোটা দেশে শোরগোল ফেলে দিয়েছে। রক্তচন্দন কাঠের পাচার নিয়ে এই ছবির কাহিনি। কেন্দ্রীয় চরিত্র পুষ্পা কী ভাবে এই কাঠ পাচার করে নিজের সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন ছবির ছত্রে ছত্রে সেই দৃশ্যই ফুটিয়ে তুলেছেন পরিচালক। যা দর্শকদের হৃদয় জয় করেছে। যে রক্তচন্দন পাচার নিয়ে এই ছবির কাহিনি, সেই কাঠের এত চাহিদা কেন? এই কাঠের বিশেষত্বই বা কী?
‘পুষ্পা: দ্য রাইজ’ একটি সাধারণ কাহিনি মনে হলেও আদতে এটা কিন্তু অনেকটা সত্য ঘটনার উপরই আধারিত। রক্তচন্দনকে এ দেশে ‘লাল সোনা’ বলা হয়। সোনার মতোই মূল্যবান এই গাছ। এই গাছ খুবই বিরল প্রজাতির। ‘পুষ্পা’ ছবিতে যে শেষাচলম জঙ্গলের কথা বলা হয়েছে রক্তচন্দন ওই শেষাচলম পাহাড়ের ঘন জঙ্গলেই পাওয়া যায়। তামিলনাড়ু লাগোয়া অন্ধ্রপ্রদেশের চার জেলা— নেল্লোর, কুর্নুল, চিতোর এবং কাডাপ্পা জেলাতে এই গাছ মেলে। পূর্বঘাট পর্বতের আবহাওয়ায় এই গাছ খুব ভাল হয়। এক একটি গাছের উচ্চতা ৮-১২ মিটার।
দু’ধরনের চন্দনকাঠ পাওয়া যায়। সাদা এবং লাল। সাদা চন্দনে সুন্দর গন্ধ থাকলেও লাল বা রক্ত চন্দনে কোনও গন্ধ নেই। কিন্তু এই কাঠের বিশেষ গুণের জন্যই বিশ্ব জুড়ে বিপুল চাহিদা। আর সেই চাহিদার কারণেই এই কাঠ পাচার হয়। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সঙ্ঘ (আইইউসিএন) ২০১৮-য় এই গাছকে ‘প্রায় বিলুপ্ত’ শ্রেণির তালিকাভুক্ত করেছে। এই কাঠ এত বিপুল পরিমাণে কাটা এবং পাচার হয়েছে যে, আর মাত্র পাঁচ শতাংশ গাছ পড়ে রয়েছে।
কেন এত চাহিদা রক্তচন্দন কাঠের?
আয়ুর্বেদিক ওষুধ হিসেবে এই কাঠের বিপুল ব্যবহার হয়। হজম, ডায়েরিয়া-সহ বেশি কিছু রোগের চিকিৎসায় এই কাঠ কাজে লাগে। রক্ত শুদ্ধিকরণের গুণও রয়েছে এই কাঠের। ওষধি গুণ ছাড়াও মদ তৈরিতে এই কাঠের বিপুল চাহিদা। এ ছাড়া পূজা-আর্চা, প্রসাধনী দ্রব্য তৈরিতেও এই কাঠ ব্যবহার করা হয়।
আন্তর্জাতিক বাজারে কেজি প্রতি তিন হাজার টাকা থেকে এই কাঠ বিক্রি শুরু হয়। ভারতে এই গাছ কাটা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ। তার পরেও পাচার হয়। পাচার রোখার জন্য ‘রেড স্যান্ডলার্স অ্যান্টি-স্মাগলিং টাস্ক ফোর্স’ও গঠন করা হয়েছে। ২০২১ সালে ৫০৮ কোটি টাকার রক্তচন্দন বাজেয়াপ্ত করেছে এই স্পেশাল টাস্ক ফোর্স। গ্রেফতার হয়েছে ৩৪২ জন পাচারকারী।
চিন, জাপান, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এবং অস্ট্রেলিয়ায় এই কাঠের বিপুল চাহিদা। তবে সবচেয়ে বেশি চাহিদা চিনে। তাই পাচারও বেশি হয় ওই দেশে। আসবাব, ঘরসজ্জা এবং বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র তৈরিতে এই কাঠের চাহিদা খুব বেশি চিনে।
রক্তচন্দন কাঠের ১৫টি বহুবিধ ব্যবহার ও ঔষধি গুণাগুণ
১. প্রবল জ্বরের দহে: অকৃত্রিম রক্তচন্দনের গুড়া বা চেলি ১০ থেকে ১২ গ্রাম এক পোয়া আন্দাজ গরম জলে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা ভিজিয়ে সেই জল অল্প মাত্রায় সমস্ত দিন খেলে দাহ ভাল হয়; গুঁড়ার অভাবে রক্তচন্দন ঘষে গরম জলে গুলে নিলেও হবে।
২. রক্ত প্রবাহের জ্বালায়: উপরিউক্ত পদ্ধতিতে রক্তচন্দনের জল তৈরী করে ২ থেকে ৩ বার খেলে জ্বালা কমে যায় ও রক্ত পড়া বন্ধ হয়।
৩. রক্তপিত্তে: যেখানে ঝলকে ঝলকে রক্ত উঠছে, তার সঙ্গে শরীরের জ্বালাও আছে এ ক্ষেত্রেও ঐ পদ্ধতিতে জল তৈরী করে খেলে গায়ের জ্বালা ও রক্তবমন নিশ্চিত প্রশমিত হবে। বৃদ্ধ বৈদ্যেরা এরই সঙ্গে ৪ থেকে ৫ গ্রাম পাতা সমেত শালপানি (Desmodium gangeticum) গাছ থেতো করে ভিজিয়ে খেতে বলেন।
৪. অনিয়মিত রক্তস্রাবে: যাঁদের ঋতুধর্ম অনিয়মিত হয় সে ক্ষেত্রে এই রক্তচন্দন উপরিউক্ত মাত্রায় প্রস্তুত করে কিছুদিন খেলে স্বাভাবিক হয়ে যায়।
৫. নাক কানের রক্তস্রাব: শরীরের এই দু’টি দ্বার দিয়ে রক্ত ঝরতে থাকলে রক্তচন্দন সিন্ধ বা ভিজানো জল খাওয়ার ব্যবস্থা আছে।
৬. চষিপোকা লাগায়: এটা সাধারণত হাতের তালুতে হয়। এটাকে ক্ষুদ্রকুষ্ঠের মধ্যে ধরা হয়ে থাকে এ ক্ষেত্রেও রক্তচন্দনের কাঠ সিদ্ধ করে সেই জল খেতে হয় এবং তার সঙ্গে রক্তচন্দন ঘষা হাতের তালুতে লাগাতে হয়।
৭. কর্ণমুলের শোথ (Mumps): এ রোগে আক্রান্ত হলে রক্তচন্দন ঘন করে ঘষে কর্ণমূলে লাগাতে হয়, এর দ্বারা ব্যথা, ফুলা ও জ্বালা তিনটিই কমে যায়।
৮. ঘামাচি: শুকিয়ে চামড়া উঠে যাওয়ার মতো সর্বাঙ্গে এক প্রকার রোগ হয়। বাংলার কোনো কোনো অঞ্চলে একে ‘নুনছাল ওঠা’ রোগ বলে। এ ক্ষেত্রে রক্তচন্দন ঘষে গায়ে লাগালে ওটা সেরে যায়।
৯. দাদে (Ringworm): এ রোগের প্রথমাবস্থায় রক্তচন্দন ঘষে লাগালে প্রায় ক্ষেত্রেই সেরে যায়।
১০. বাতরক্তে: যেসব ক্ষেত্রে কোনো আঘাত না লেগে গায়ে লাল দাগ হয়, অনেকের আবার এর সঙ্গে ওইগুলিতে একটু ফুলা ও চুলকানি থাকে, সেখানে এই কাঠ ঘষে লাগালে এটা উপশম হয়।
১১ দাঁতের মাড়ির রক্ত পড়া: এই কাঠসিদ্ধ জল দিয়ে কুলকুচো করলে বন্ধ হয়। এমনকি ঘুমলে যাঁদের মাড়ি থেকে রক্ত পড়ে, এর দ্বারা তারাও নিস্কৃতি পাবেন।
১২. মাথার যন্ত্রণায়: এই যন্ত্রণা যদি কোনো বিশিষ্ট কারণে না হয়, তাহলে রক্তচন্দন কাঠ ঘষে কপালে লাগালে কমে যায়।
১৩. স্তনের ফোড়ায় (একে আমরা ঠুনকোও বলি): এ ক্ষেত্রে এই কাঠ ঘষা (ঘন করে) দিনে-রাতে ৩/৪ বার লাগাতে হয়।
১৪. বিষ ফোড়ায়: ঘষা রক্তচন্দন ও গোলমরিচ ঘষে ফোঁড়ায় লাগালে একদিনেই বিষুনি কেটে যায়।
১৫. দুষিত ঘায়ে (ক্ষতে) : রক্তচন্দনের ক্বাথ দিয়ে ধুলে ক্ষতের দোষ কেটে যায়।
রাসায়নিক গঠন:
(a) Glycosides. (b) Colouring matter. (c) marsupium.
সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।
তথ্যসূত্রঃ
১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ১, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৩, পৃষ্ঠা,১৭৭-১৭৮।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।