রক্তের গ্রুপ লোহিত রক্তকণিকায় নির্দিষ্ট অ্যান্টিজেনের (মানে, প্রোটিন) উপস্থিতির ওপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ কোনো অ্যান্টিজেন আছে কি নেই—এর ওপর নির্ভর করে নির্ধারিত হয় গ্রুপ কী হবে। রক্তের চারটি প্রধান গ্রুপ এ, বি, এবি এবং ও। গ্রুপ নির্ধারণের এ পদ্ধতির নাম ‘এবিও (ABO) সিস্টেম’।
দুটি অ্যান্টিজেন আছে—এ (A) ও বি (B)। লোহিত রক্তকণিকার পৃষ্ঠে এ অ্যান্টিজেন থাকলে সেটাকে বলে এ গ্রুপ, বি অ্যান্টিজেন থাকলে বি গ্রুপ, দুটোই একসঙ্গে থাকলে এবি (AB) গ্রুপ আর কোনোটাই না থাকলে সেটা ও (O) গ্রুপ। এই ‘ও’ মানে আসলে শূন্য (ব্রিটিশরা শূন্যকে ‘ও’ বলেন)।
পজিটিভ নাকি নেগেটিভ, তা রেসাস বা আরএইচ (Rh) ফ্যাক্টরের ওপর। এটিও বিশেষ একধরনের প্রোটিন। এই প্রোটিন থাকলে বলা হয় পজিটিভ (আছে), আর না থাকলে বলা হয় নেগেটিভ (নেই)। তার মানে দাঁড়াল, যার রক্তে এ অ্যান্টিজেন ও রেসাস ফ্যাক্টর রয়েছে, তার রক্তের গ্রুপ এ পজিটিভ।
রক্ত দেওয়া-নেওয়া বা কোনো বিপদ ঘটার আগেই রক্তের গ্রুপ জেনে রাখা জরুরি। কারণ, গ্রুপ নির্ধারণ করা থাকলে নিরাপদে রক্ত দেওয়া বা নেওয়া যায় প্রয়োজনের সময়। যেমন যাঁর রক্তের গ্রুপ এ, তিনি নিরাপদে এ বা ও গ্রুপের কারও কাছ থেকে রক্ত গ্রহণ করতে পারেন। কিন্তু বি বা এবি গ্রুপের কারও কাছ থেকে রক্ত নিতে পারেন না। জরুরি রক্ত সঞ্চালনের প্রয়োজন হলে রক্তের গ্রুপ জানা থাকতেই হবে। এই সাধারণ তথ্য জরুরি প্রয়োজনে জীবন বাঁচিয়ে দিতে সাহায্য করে।
আগেই বলেছি, রক্তের লোহিত রক্তকণিকার পৃষ্ঠে নির্দিষ্ট অ্যান্টিজেনের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি দিয়ে গ্রুপ নির্ধারিত হয়। এই অ্যান্টিজেন আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে বাবা-মার কাছ থেকে পাই। কিছু রক্তের গ্রুপ খুব সাধারণ, অনেকেরই থাকে। যেমন বি পজিটিভ। অন্যান্য গ্রুপের তুলনায় এটি সহজলভ্য। আবার ও নেগেটিভ গ্রুপের রক্ত অনেকটাই বিরল। কিন্তু সাধারণ হোক বা দুর্লভ, রক্তের গ্রুপ পরিবর্তন করা বা বদলে যাওয়া অসম্ভব (এখানে অবশ্য একটা ‘কিন্তু’ আছে)।
কারও যদি রক্তের প্রয়োজন হয়, তাহলে তাঁর গ্রুপের রক্তই তাঁকে দেওয়া হয়। জরুরি পরিস্থিতিতে ও গ্রুপের রক্ত সরবরাহের প্রয়োজন হতে পারে। তবে এটি শুধু তখনই করা হয়, যখন অন্য কোনো বিকল্প পাওয়া যায় না এবং রোগীর জীবন ঝুঁকির মধ্যে থাকে।
একটু আগে ‘কিন্তু’র কথা বলেছি। সেটা একটু খুলে বলি এবার। রক্তের গ্রুপ বদলে যেতে পারে, তবে সেটা খুবই দুর্লভ ঘটনা। অস্থিমজ্জা (অস্থি বা হাড়ের ভেতরে থাকে) প্রতিস্থাপনের পর রক্তের ধরন বদলে যাওয়ার উদাহরণ আছে। অস্থিমজ্জা থেকে তৈরি হয় লোহিত রক্তকণিকা, শ্বেত রক্তকণিকা ও অণুচক্রিকা। লিউকেমিয়ার মতো কিছু রোগের চিকিৎসায় অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হয়। অসুস্থ রোগীর অস্থিমজ্জা সুস্থ দাতার মজ্জা দিয়ে প্রতিস্থাপন করা যেতে পারে। যদি রোগী আর দাতার রক্তের ধরন ভিন্ন হয়, তাহলে সফলভাবে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের পর দাতার রক্তের গ্রুপ পরিবর্তিত হতে পারে।
আবার কারও প্রচুর রক্তক্ষরণ হলে যদি তার দেহে প্রচুর রক্ত সঞ্চালন করা হয়, তাহলে অস্থায়ীভাবে একটি ভিন্ন রক্তের গ্রুপ দেখা দিতে পারে। একজন এবি রোগীকে যথেষ্ট পরিমাণ ও গ্রুপের রক্ত দিলে প্রায় সব লোহিত কণিকাকে ও গ্রুপ হিসেবে দেখা যেতে পারে। কয়েক মাসের মধ্যে অবশ্য রোগীর অস্থিমজ্জা নিজ গ্রুপের রক্ত তৈরি করে দাতার গ্রুপ আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে পারে।
আরেক ক্ষেত্রে গ্রুপ পরিবর্তন দেখা যায়। এটা শুধু এ গ্রুপের ক্ষেত্রেই ঘটে। এটি অবশ্য খুব অস্বাভাবিক ও বিরল ঘটনা। এ গ্রুপের বাহকের অন্ত্রে যখন একটি নির্দিষ্ট ব্যাকটেরিয়া (বৈজ্ঞানিক নাম: Akkermansia muciniphila) সংক্রমণ ঘটিয়ে বিশেষ একধরনের এনজাইম তৈরি করে। এই এনজাইম এ গ্রুপের রক্তের অণুকে বি গ্রুপের রক্তের অণুর সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ করে তোলে। সাধারণত কোলন ক্যানসার, অন্ত্রে সংক্রমণ বা সেপসিসে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে এ ঘটনা ঘটতে পারে। তবে যেমনটা বললাম, এটা খুবই বিরল।
রক্তের গ্রুপ পজিটিভ থেকে নেগেটিভ হয়েছে, এমন কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। তবে কিছু মানুষ এমন দাবি করেন। নিয়মিত রক্ত দান করেন, এমন কেউ কেউ দাবি করেন যে তাঁরা বেশ কবার রক্ত দেওয়ার পর রক্তের গ্রুপ (পজিটিভ নাকি নেগেটিভ, তা) পরীক্ষা করে দেখেছেন, আগে তাঁদের যে গ্রুপ ছিল বলে জানতেন, তা বদলে গেছে। মনে করা হয় যে রক্তের গ্রুপ যাচাইয়ের পরীক্ষার ভুলে এমন হতে পারে। তবে আগে যে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন বা বিশেষ পরিস্থিতিতে সাময়িকভাবে রক্তের গ্রুপ (পজিটিভ নাকি নেগেটিভ, তা) বদলাতে পারে।
তবে আসলেই রক্তের গ্রুপ পজিটিভ থেকে নেগেটিভ হতে পারে কি না, তা নির্ধারণের জন্য আরও গবেষণা প্রয়োজন। কিছু বিরল ঘটনা আছে, যেখানে একজনের রক্তের গ্রুপ পজিটিভ থেকে নেগেটিভ বা উল্টোটা হয়েছে। এমন ঘটনা এবি এবং ও রক্তের গ্রুপ নির্ধারণ করে, এমন জিনের মিউটেশনের কারণে ঘটতে পারে, তবে এ বিষয়ে এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
প্রচলিত একটি ভুল ধারণা হলো, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে রক্তের গ্রুপে পরিবর্তন হতে পারে। এ ধারণা সঠিক নয়। কারও রক্তের গ্রুপের পরিবর্তন হতে পারে না, কিছু বিরল ব্যতিক্রম ছাড়া। তবে একজন ব্যক্তির দুটি ভিন্ন রক্তের গ্রুপ থাকা সম্ভব। এটি কাইমেরিজম নামে পরিচিত। সাধারণত এ ঘটনা ঘটে যখন একজন ব্যক্তির রক্ত বা অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করা হয় অন্য দুজন দাতা থেকে। এ ক্ষেত্রে ভিন্ন রক্তের গ্রুপ একই ব্যক্তির মধ্যে কোনো সমস্যা সৃষ্টি না করেই সহাবস্থান করতে পারে।
খাবার, অসুস্থতা, ওষুধসহ অনেক কারণে মানুষের রক্তের গ্রুপ প্রভাবিত হতে পারে। তবে রক্তের গ্রুপ পরিবর্তন একটি দুর্লভ ঘটনা। সাধারণভাবে আসলে রক্তের গ্রুপে পরিবর্তন হয় না।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।