রহস্যময় চ্যাটজিপিটি: চাকরির হুমকি নাকি নতুন এক সম্ভাবনা!
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ডেস্ক: বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো চ্যাটজিপিটি (চ্যাট জেনারেটিভ প্রি-ট্রেইনড ট্রান্সফরমার)। বিশ্বব্যাপী সবাই চ্যাটজিপিটি সম্পর্কে কথা বলছে। ওপেনএআই-এর সবচেয়ে শক্তিশালী নতুন উদ্ভাবিত এআই (আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স) চ্যাটবট যা লেখা এবং লেখা সম্পর্কিত কাজ এমনকি কোডিং লিখতেও সাহায্য করে।
প্রযুক্তিবিদ বা প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সান ফ্রান্সিসকো-ভিত্তিক ওপেনএআই-এর রহস্যময় নতুন এআই-চালিত চ্যাটবট চ্যাটজিপিটি সম্পর্কে জানা প্রয়োজন।
চ্যাটজিপিটি কী?
চ্যাটজিপিটি হলো একটি ন্যাচারাল বা স্বাভাবিক ভাষা প্রক্রিয়াকরণ টুল। যা এআই প্রযুক্তি দ্বারা তৈরি হয়েছে। এটি মানুষের মতো কথোপকথনের অভিজ্ঞতা দেবে। চ্যাটবটের সাথে প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি ভালো উত্তর পাওয়া সম্ভব। চ্যাটজিপিটি ভাষার নির্ধারিত মডেলের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে, এটি আপনাকে যেকোনো ধরনের লেখা, ইমেল, প্রবন্ধ, কোড এবং আরও অনেক কিছুসহ যেকোনো ধরনের লেখা তৈরি করার মতো কাজে সহায়তা করতে পারে।
বর্তমানে এটি বেটা ভার্সনে আছে। তবে যে কেউ চাইলে বিনামূল্যে চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করতে পারবেন। অবাক করার মতো ব্যাপার হলো এই বেটা সফটওয়্যার ভার্সনই মাত্র ৫ দিনে ১০ লক্ষ বার ডাউনলোড করা হয়েছে।
কীভাবে কাজ করে চ্যাটজিপিটি?
চ্যাটজিপিটি বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার সবচেয়ে বড় মডেল যা মানুষের মতোই বিভিন্ন বিষয়ে লিখতে পারদর্শী। ইন্টারনেটের সুবিশাল ডাটার মধ্য থেকে তথ্য সংগ্রহ করে সেটা দিয়েই লেখে চ্যাটজিপিটি।
প্রোগ্রামটি ‘ট্রান্সফরমার আর্কিটেকচার’ নামক একটি ডিপ লার্নিং মেথড ব্যবহার করে যা প্রশ্নের উত্তর তৈরি করতে বিলিয়ন শব্দ ধারণ করে বেশ কয়েকটি টেরাবাইট ডেটার মাধ্যমে পরীক্ষা করে।
চ্যাটজিপিটি’র আগের ভার্সনের মধ্যে রয়েছে GPT-3. এটি অত্যন্ত দ্রুত কাজ করে। অ্যাপটি মানুষের মতো করে মানুষের চাওয়া বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর তৈরি করতে সক্ষম। রিইনফোর্সমেন্ট লার্নিং ব্যবহার করে GPT-3.5-এর উপরে চ্যাটজিপিটি সূক্ষ্ম-টিউন করা হয়েছে। উভয় পদ্ধতিই এই মডেলের কর্মক্ষমতা উন্নত করতে সহায়তা করেছে। চ্যাটজিপিটি’র লার্নিং মডেলগুলি মাইক্রোসফ্টের Azure সুপারকম্পিউটিংয়ের সহযোগিতায় প্রশিক্ষিত করেছে। এটি ওপেন এআই চ্যাটজিপিটি ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে ডেটা সংগ্রহ করে চলেছে। এতে চ্যাটজিপিটি আরও সূক্ষ্ম কাজ করতে সক্ষম হবে।
কারা চ্যাটজিপিটি ব্যাবহার করতে পারবে
যে কেউ চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করতে পারবে। আপনি যদি OpenAI এর সাথে একটি অ্যাকাউন্ট সেট আপ করেন, তাহলে আপনি ChatGPT ব্যবহার করতে পারবেন।
চ্যাটজিপিটি কখন এবং কোথা থেকে এলো?
চ্যাটজিপিটি Open AI দ্বারা তৈরি করা হয়েছে। ২০২২ সালের নভেম্বরে এটি চালু হয়েছে। OpenAI হল একটি সংস্থা যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গবেষণা এবং বিকাশের জন্য কাজ করে। চ্যাটজিপিটির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে এলনমাস্ক আংশিকভাবে জড়িত। তবে ওপেন এআইয়ের আরও অনেক বিনিয়োগকারী রয়েছে। যেমন- বিলিয়নেয়ার পিটার থিয়েল, যিনি প্রথমবার অর্গানাইজেশন স্থাপন করার সময় সংস্থাটিকে যথেষ্ট পরিমাণ আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছিলেন। ওপেনএআই পরিচালনা করেন সিইও স্যাম অল্টম্যান, যিনি প্রতিষ্ঠানের একজন প্রতিষ্ঠাতাও। এখন মাইক্রোসফটও চ্যাটজিপিটিতে অর্থ বিনিয়োগ করছে।
চ্যাটজিপিটি এবং সার্চ ইঞ্জিনের মধ্যে পার্থক্য কী?
চ্যাটজিপিটি একটি ভাষার মডেল যা এন্ড ইউজারের সাথে কথোপকথনের উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহারকারী যদি চ্যাটজিপিটির কাছে কোন প্রশ্ন করে তবে চ্যাটজিপিটি তার সঠিক উত্তর ইন্টারনেটের তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ব্যবহারকারীর সামনে উপস্থাপন করে।
অপরদিকে একটি সার্চ ইঞ্জিন ইন্টারনেটে ওয়েব পৃষ্ঠাগুলিকে সূচি করে, যা ব্যবহারকারীকে তার জিজ্ঞাসা করা তথ্য খুঁজে পেতে সহায়তা করে।
চ্যাটজিপিটি দিয়ে যেসব কাজ সহজেই করা সম্ভব
প্রোগ্রামিং : চ্যাটজিপিটি আপনার পছন্দের যেকোনো ভাষায় সম্পূর্ণ প্রোগ্রাম লিখতে সাহায্য করতে পারবে। উদাহরণস্বরূপ, যখন এটিকে ‘পাইথন ভাষায় কাউন্টডাউন টাইমার অ্যাপ’-এর জন্য একটি প্রোগ্রাম লিখতে দেবেন, তখন সেটি অত্যন্ত দ্রুততার সাথে প্রোগ্রামিংটা লিখে দেবে এবং এই প্রোগ্রামিং লেখার পিছনে যে যুক্তি বা লজিক সেটিও উপস্থাপন করবে।
একাডেমিক লেখাপড়া : চ্যাটজিপিটি শিক্ষাবিদদের জন্য বড় ধরনের উন্নয়ন বয়ে আনতে পারে এবং কলেজের ছাত্ররা তাদের অ্যাসাইনমেন্ট, হোমওয়ার্ক, প্রকল্প, গবেষণাপত্র ইত্যাদি লেখার জন্য সাহায্য নিতে পারবে।
কপিরাইটিং : বর্তমান সময়ে কপিরাইটিংয়ে চ্যাটজিপিটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এটি ইমেল, বিজ্ঞাপন, পণ্যের বিবরণ, ল্যান্ডিং পৃষ্ঠার অনুলিপি ইত্যাদি লেখা ও খসড়া তৈরি করতে সহায়তা করবে।
পারস্পারিক কথোপকথন : চ্যাটজিপিটি মানুষের মতোই খুব স্বাভাবিকভাবে আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে। এটি এমনকি আপনার পূর্ববর্তী অনুভূতি প্রকাশ ও প্রতিক্রিয়াগুলো মনে রাখতে পারে। ফলে ফলোআপের পাশাপাশি ব্যবহারকারীদের সাথে গভীরভাবে কথোপকথন চালাতে সক্ষম চ্যাটজিপিটি।
ক্রিয়েটিভ আইডিয়া তৈরি : চ্যাটজিপিটি আপনাকে ক্রিয়েটিভ আইডিয়া তৈরিতে সাহায্য করতে পারবে। কাউকে কিছু উপহার দেওয়া, নতুন ব্যবসায়িক ধারণা বা ব্যবসা এক্সটেনশনের ধারণা, পণ্যের নাম এবং আরও অনেক কিছু করতে চ্যাটজিপিটি সাহায্য করতে পারবে।
ব্লগিংয়ের জন্য চ্যাটজিপিটি : যারা ব্লগ বা কন্টেন্ট বানায়, তাদের জন্য চ্যাটজিপিটি দারুণ কাজে আসবে। এটি ক্রিয়েটিভ ব্লগ ধারণা প্রদান করতে পারে। ব্লগের জন্য প্লানিং বা ব্লু প্রিন্ট তৈরি করতে পারে এবং এমনকি প্রতিটি উপশিরোনামের অধীনে পূর্ণাঙ্গ তথ্যসমৃদ্ধ কনটেন্ট তৈরি করতে পারে। এটি যেকোনো লেখার ব্যাকরণগত ত্রুটিও সংশোধন করতে পারে।
তবে এখনই বলা সম্ভব না যে, চ্যাটজিপিটি দ্বারা উপস্থাপনকৃত সমস্ত তথ্যই নির্ভুল এবং আমাদের কাজের জন্য সম্পূর্ণ সঠিক। তবে এটি যেভাবে এগিয়ে চলেছে তাতে আমরা খুবই আশাবাদী, হয়তো শিগগিরই এটি নির্ভুল তথ্য উপাত্ত উপহার দিতে চলেছে।
সম্ভাবনা ও সমস্যা
ওপেনএআই ভবিষ্যতের সাফল্যের জন্য বেশ ভাল অবস্থানে রয়েছে। মাইক্রোসফট সম্প্রতি ঘোষণা করেছে- এআই কেন্দ্রিক সংস্থায় তাদের ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার পরিকল্পনা রয়েছে। মাইক্রোসফট আরও ঘোষণা দিয়েছে যে, তারা নিজেদের সার্চ ইঞ্জিন বিং-এর জন্য একটি চ্যাটজিপিটি ইন্টিগ্রেশন চালু করতে পারে।
চ্যাটজিপিটি’র ব্যাপারে বিশ্ববাসীর আগ্রহ দেখে আমরা এটা বলতে পারি যে, শিগগিরই চ্যাটজিপিটি একটি ভালো অবস্থানে যাবে এবং মানুষের উপকারে অনেক ধরনের কাজে আসবে। তবে এটি সত্য যে, এই সহজলভ্য অথচ দুর্দান্ত কাজের অ্যাপটির কারণে বহু মানুষ নিজেদের চাকরি হারাবে। কন্টেন্ট রাইটিংয়ের কাজে নিয়োজিত বহু মানুষ বেকার হয়ে পড়বে।
তবে আমি বিশ্বাস করি যে, প্রতিটি পরিবর্তনই নতুন কাজের ক্ষেত্র তৈরি করে এবং সেইভাবে নতুন নতুন কর্মসংস্থানসহ সম্ভাবনাও বয়ে আনে। এই সম্ভাবনাগুলোকে খুঁজে বের করে কাজে লাগাতে পারলেই পরিবর্তিত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তার সুবিধাটুকু আমরা নিতে পারব।
লেখক : এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর, ব্রাইটস্কিলস। কো-চেয়ারম্যান, এডু-টেক, স্ট্যান্ডিং কমিটি, ই-ক্যাব।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।