জুমবাংলা ডেস্ক : বাজারে ইলিশ কিনতে গেলে সবার আগে যেদিকে নজর যায় সেটি সম্ভবত মাছটির চোখ এবং পেট। চোখের ঔজ্জ্বল্য দিয়ে ইলিশটা টাটকা কিনা সেটা পরখ করার পর মাছে হাত বুলিয়ে বা একটু এদিক-ওদিক উল্টে দেখার চেষ্টা করা হয়, পেটে কী পরিমাণ ডিম আছে। অর্থাৎ বাজারের ইলিশগুলো যে স্ত্রী প্রজাতির তা একরকম ধরেই নেন সবাই। কিন্তু কখনো কি ভেবেছেন, পুরুষ ইলিশগুলো যায় কোথায়?
পুরুষ ইলিশ কীভাবে ‘অমাবস্যার চাঁদ’ হয়ে ওঠে?
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ‘ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন ব্যবস্থাপনা কৌশল’ শীর্ষক একটি প্রযুক্তি নির্দেশিকা প্রণয়ন করেছিল। এতে বলা হয়, ইলিশ মাছের গোনাডের হিস্টোলজিক্যাল বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়, সাধারণত ১+ বৎসর বয়সে ইলিশ মাছ পরিপক্বতা লাভ করে। তবে আবহাওয়ার তারতম্য ও অন্যান্য কারণে অনেক সময় ৮-১০ মাস বয়সেও ইলিশ মাছ পরিপক্ব হতে পারে।
এর আগপর্যন্ত যেসব ইলিশ ধরা পড়ে তার মধ্যে স্ত্রী এবং পুরুষের আনুপাতিক হারে খুব বেশি পার্থক্য থাকে না। তাহলে পরবর্তী সময়ে পুরুষ ইলিশ কেন এত দুর্লভ হয়ে ওঠে?
এই রহস্য উন্মোচনের জন্য কথা হয় দেশের স্বনামধন্য ইলিশ গবেষক ও মৎস্য বিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ আনিছুর রহমানের সঙ্গে।
ড. মোহাম্মদ আনিছুর রহমান: ইলিশ হলো মাছের মধ্যে উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ! তাকে কিন্তু সব জায়গায় দেখা যায় না। নদীতে ধরা পড়লেও সব নদীতে কিন্তু সমানভাবে পাওয়া যায় না। ইলিশ এখন বিরল না হলেও এই মাছ নিয়ে বহু রহস্য আছে! এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় রহস্য হলো ‘পুরুষ ইলিশ’।
শুরুতে ইলিশের মধ্যে স্ত্রী এবং পুরুষের আনুপাতিক হার প্রায় সমানই থাকে। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো: একটা বয়সের পর এই পুরুষগুলো স্ত্রী হয়ে যায় কি না, সেই রহস্যটা এখনও গবেষণার পর্যায়ে আছে।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, আমাদের দেশে ৩ প্রজাতির ইলিশ মাছ দেখা যায়। এর মধ্যে বেশি দেখা যায় টেনুয়ালোসা ইলিশ (Tenualosu ilisha); যেটা সাধারণভাবে ইলিশ নামেই পরিচিত। এর বাইরে সামান্য পরিমাণে চন্দনা ইলিশ (Tenualosu toli) এবং কালেভদ্রে হিলশা গণের হিলশা কেলি (Hilsa kelee/kanagurta) কানাগুর্তা বা গুর্তা প্রজাতির ইলিশ মাছ পাওয়া যায়।
ড. মোহাম্মদ আনিছুর রহমান: টেনুয়ালোসা টোলি, যেটাকে চন্দনা ইলিশ নামে ডাকা হয়, ইন্দোনেশিয়াসহ কয়েকটি জায়গায় দেখা গেছে তারা যখন ৪০ সেন্টিমিটারের চেয়ে একটু বড় হয় তখন তাদের অধিকাংশই নারী হয়। তারমানে, তারা স্ত্রী হয়ে যাচ্ছে। এই রকম একটা রহস্যময় তথ্য পাওয়া গেছে, যেটা নিয়ে আলোচনা চলছে।
কিন্তু টেনুয়ালোসা ইলিশা, যেটা পদ্মার ইলিশ, আমাদের অঞ্চলে আছে সেটার মধ্যে এই লিঙ্গ রূপান্তরের ঘটনা ঘটে কি না, সেটা আমরা নিশ্চিত নই। এটা নিয়ে এখনও রহস্য রয়ে গেছে।
একটা সময় সবাই প্রশ্ন করত: ইলিশ নাই কেন? তারপর জাটকা সংরক্ষণ এবং মা ইলিশ রক্ষার ফলে ইলিশ আসা শুরু হলো। গবেষণা করে যখন সাড়ে চার থেকে সাড়ে ছয় সেন্টিমিটার জালের ফাঁস নির্ধারণ করে দেয়া হলো, ফাঁস বড় করে দেয়া হলো, তখন অপেক্ষাকৃত ছোট ইলিশ জালে ধরা পড়ল না। তাদের জীবনচক্রে এক বছর সময় বেশি পেল, তাদের ডিম উৎপাদন ক্ষমতাও বেড়ে গেল। এখন ইলিশ শুধু বেড়েছে তাই নয়, অপেক্ষাকৃত বড় ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে।
সাত-আট বছর আগে বাজারে যে পরিমাণ ইলিশ পাওয়া যেত, তার বড় অংশই ছিল ছোট। আর এখন যে ইলিশ আসে তার বৃহৎ অংশ বড়। এখন বাজারে ছোট ইলিশের সংখ্যা কম।
তার বিশ্বাস, টেনুয়ালোসা ইলিশার মধ্যে এখনও পুরুষ এবং স্ত্রীর পরিমাণ অর্ধেক অর্ধেক আছে।
আসলেই কি পুরুষের চেয়ে নারী ইলিশের সংখ্যা বেশি?
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, স্থান-কাল-আকার ও প্রজাতিভেদে পুরুষ-স্ত্রী ইলিশ মাছের আনুপাতিক হার ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। জাটকা বা কিশোর বয়সে স্ত্রী-পুরুষ মাছের আনুপাতিক হার প্রায় সমান থাকে। এই হার ২৮-৩০ সে.মি. পর্যন্ত একইরকম থাকে।
অতঃপর স্ত্রী মাছের আনুপাতিক হার বৃদ্ধি পায় এবং ৪৪ সে.মি.-এর ঊর্ধ্ব আকারের সব মাছই স্ত্রী।
চন্দনা প্রজাতির (T. toli) ইলিশ মাছ লিঙ্গ পরিবর্তন করে পুরুষ মাছ স্ত্রী মাছে রূপান্তরিত হয়। এ প্রজাতির ২২.০ সে.মি. আকার পর্যন্ত সব মাছই পুরুষ, ২২.০ সে.মি. হতে ২৫/২৬ সে.মি. আকারের মাছের লিঙ্গ পরিবর্তন ঘটে এবং ২৬ সে.মি.-এর ঊর্ধ্ব আকারের সব মাছই স্ত্রী।
ড. মোহাম্মদ আনিছুর রহমান: স্থান এবং বয়সভেদে পুরুষ এবং স্ত্রী ইলিশের হার ভিন্ন ভিন্ন হয়। যদি বয়সভেদে হারের কথা বলি, ইলিশ যখন ১৬ সেন্টিমিটারের মতো হয় তখন বুঝতে হবে ইলিশটি পূর্ণাঙ্গ নারী বা পুরুষে পরিণত হতে যাচ্ছে। যখন সাইজটা বড় হাতে থাকে তখন ইলিশের লটে দেখা যায় স্ত্রীর সংখ্যাও বাড়তে থাকে। আর আকার যত ছোট হয় তার মধ্যে তত বেশি হারে পুরুষ দেখা যায়।
২০-২২ থেকে ২৬-২৮ সেন্টিমিটার সাইজের ইলিশ যেগুলো পূর্ণাঙ্গ ইলিশ হয়ে উঠেছে মাত্র সেগুলোর মধ্যে স্ত্রী-পুরুষের হার সাধারণত ১:১ থেকে ১:১.৫ থাকে।
তবে সাইজটা যখন একটু বড় হয়ে যায় তখন দেখা যায় প্রতি দুটি স্ত্রী ইলিশের বিপরীতে একটি পুরুষ ইলিশ বা তিনটি স্ত্রীর বিপরীতে দুটি পুরুষ পাওয়া যায়।
এখানে সৃষ্টিকর্তার হয়তো এভাবেই সৃষ্টি করছেন যে, দু-তিনটা নারীর উৎপাদনশীলতার জন্য একটা পুরুষ ইলিশই যথেষ্ট। মানে, নারীর সংখ্যা বেশি হলেই পরবর্তী প্রজন্ম বাড়বে।
সৌন্দর্যে কে এগিয়ে, স্ত্রী নাকি পুরুষ ইলিশ?
ড. মোহাম্মদ আনিছুর রহমান: সব প্রাণীরই শ্রেষ্ঠ সময় হলো যৌবন। সেটা মানুষের ক্ষেত্রে যেমন ইলিশের ক্ষেত্রেও তেমন। মানুষের উদাহরণ যদি দিই, ১৭-১৮ বছর বয়সে একটা ছেলে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।
এক বছরের কাছাকাছি যখন বয়স হয় তখন পুরুষ এবং স্ত্রী ইলিশ দুটিরই সৌন্দর্য অতুলনীয় হয়ে ওঠে।
তবে স্ত্রী ইলিশের ঔজ্জ্বল্য বেশি থাকে, দেখতেও সুন্দর হয়।
স্বাদে কে সেরা, স্ত্রী নাকি পুরুষ ইলিশ?
ড. মোহাম্মদ আনিছুর রহমান: ২৫ সেন্টিমিটারের নিচে সাইজ হলে তাকে আমরা জাটকা বলি। সাইজ যখন ২৮ সেন্টিমিটার অতিক্রম করে তখন যদি তার স্বাস্থ্যটা ঠিক থাকে তাহলে যে অঞ্চলেই চলাচল করুক, বিশেষ করে যদি পদ্মা-মেঘনায় চলাচল করে তাহলে ওদের শরীরে চর্বি জমে, দেখতেও নাদুসনুদুস হয়। সে ক্ষেত্রে পুরুষ এবং স্ত্রী দুই ধরনের ইলিশেরই খুব স্বাদ হয়।
ইলিশের পেটের দিকে যখন চাপ দেবেন তার পায়ুপথের জায়গাটা দিয়ে সাদা দুধের মতো যদি বেরিয়ে আসে তাহলে বোঝা যাবে এটা পুরুষ। আর যদি ঘিয়ে রঙের অর্থাৎ তার ডিমের রঙের কিছু বেরিয়ে আসে তাহলে বুঝবেন এটা স্ত্রী।
যখন ইলিশের সাইজ এক কেজির কাছাকাছি হয় তখন পুরুষ হোক কিংবা স্ত্রী দুটোরই কাছাকাছি রকম ভালো স্বাদ থাকে।
পদ্মার ইলিশ, একটু বেঁটে, একটু মোটা। এদের স্ত্রী ইলিশের ক্ষেত্রে যখন পেটের দিকে চকচক করে তখন তার স্বাদ সবচেয়ে বেশি থাকে।
ইলিশ মাছে ২১ লাখ পর্যন্ত ডিম পাওয়া যায়। এই ডিম ছয়টি ধাপে পরিপক্বতা পায়। স্ত্রী ইলিশের পেটে যখন কেবল অল্পখানি ডিম হয় এবং সেই ডিম দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্টেজে থাকে এরকম ইলিশের চেয়ে স্বাদ আর কোনোটার হতে পারে না।
ডিম যখন পঞ্চম বা ষষ্ঠ ধাপ অর্থাৎ শেষ দিকে চলে আসে তখন শরীরের যত চর্বি, ওমেগা-থ্রি, ফ্যাটি অ্যাসিড অর্থাৎ স্বাদের যে অংশগুলো ডিমের দিকে চলে যায়। তখন আপনি ডিম খেলে ভালো স্বাদ পাবেন কিন্তু মাছের স্বাদ যেমন পাওয়ার কথা তা পাবেন না।
ইলিশ বড় হলেও স্বাদ বাড়ে। একটা ইলিশ সর্বোচ্চ সাত বছরের মতো বাঁচে। তবে যেসব বড় ইলিশ বাজারে পাওয়া যায় তার বয়স সাধারণত দুই বছর বা তিন বছর। তিন বছর বয়সী ইলিশই খুব কম ধরা পড়ে বলে জানান তিনি।
গবেষকরা বলেন, ইলিশ যৌনকর্মে লিপ্ত হয় না। পুরুষ ইলিশ পানিতে তাদের ফোমের মতো শুক্রাণু ছাড়ে। আর নারী মাছ ওই ফোম-সদৃশ ব্রথের ওপর তাদের ডিম্বাণু ছাড়লে সেগুলো নিষিক্ত হয়।
চাঁদপুরের মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের ড. আনিসুর রহমান একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘‘নারী ইলিশের মাঝে যে দীপ্তি দেখা যায়, পুরুষ ইলিশে তা থাকে না। তারা দেখতে কদাকার না হলেও কিছুটা অনাকর্ষণীয় তো বটেই। গতানুগতিক মাছের বাজারে তাই এসব পুরুষ ইলিশের ঠাঁই হয় না। জেলেরা সেগুলোকে আলাদা করেন এবং পাঠিয়ে দেন লবণ মাখিয়ে শুকানোর জন্য। স্থানীয় কৌশলে সংরক্ষিত এসব ইলিশকে বলা হয় ‘নোনা ইলিশ’।’’ সূত্র : সময় সংবাদ
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।