নিজস্ব প্রতিবেদক : নবান্ন উৎসব হলো নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে প্রস্তুত চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব। এই উৎসবটি বাঙালি লোক সংস্কৃতির পুরনো ও গ্রামবাংলার হাজার বছরের প্রাচীনতম উৎসব হলেও সময়ের সাথে সাথে হারাতে বসেছে তার অতীতের রূপ ও আভিজাত্য।
নবান্ন উৎসবকে তাই নাগরিক জীবনে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পরিচিত করতে প্রতিবছরের মতো এবারও রাজশাহী বিভাগীয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমি আয়োজন করেছে।
শনিবার (৩০ নভেম্বর) সকালে একাডেমি চত্বরে ‘এসো মিলি সবে, নবান্নের উৎসবে’ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে এই উৎসবের আয়োজন করা হয়। সকাল সাড়ে ১০টায় একাডেমি প্রাঙ্গনে গান-নাচ আর বাঁশির সুরের মূর্ছনায় শুরু হয় আয়োজন।
পিঠাপুলি, বাহারি পোশাক, রঙিন সজ্জায় বাঁশির মায়াবী ধ্বনি, নাচ, গান আর আবৃত্তিতে অগ্রহায়ণের প্রথম সকালে একাডেমির চত্বর মুখর হয়ে উঠে। এ উৎসবে আদিবাসী সঙ্গীতশিল্পী, নৃত্য শিল্পীগণ একক ও দলীয় লোক সঙ্গীত-নৃত্য পরিবেশন করেন। একইসাথে ছিলো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর পরিবেশনাও। দিনভর নানা সংগীত, নৃত্যের একের পর এক আয়োজনে উৎসবমুখর ছিলো একাডেমি চত্বর। শহুরে মানুষের মনে নবান্নের আমেজ দিতে খৈ, মুড়কি, মোয়া, মুরালি, বাতাসা নিয়ে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেন আয়োজকেরা।
নবান্ন উৎসব অনুষ্ঠানের উদ্বোধন ঘোষণা করেন একাডেমির নির্বাহী সদস্য আকবারুল হাসান মিল্লাত। একাডেমির ইন্সট্রাক্টর মানুয়েল সরেনের সঞ্চালনায় শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সভাপতি একাডেমির (অ.দা.) উপপরিচালক বেনজামিন টুডু।
এই উৎসবের আয়োজন নিয়ে কথা হয় আকবারুল হাসান মিল্লাত সঙ্গে। তিনি জানান, নবান্ন শব্দের অর্থ ‘নতুন অন্ন’। তাই নবান্ন উৎসব হলো নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে প্রস্তুত চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব। সেই দিক বিবেচনায় নবান্ন বাঙালি কৃষকের খাদ্যোৎসব। হতদরিদ্র কৃষকের জীবনে সমবেত উৎসবের আনন্দে মেতে উঠার দিন। সাধারণত বাংলা অগ্রহায়ণ মাসে অর্থাৎ হেমন্তকালে আমন ধান পাকার পর এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। কোথাও কোথাও মাঘ মাসেও নবান্ন উদ্যাপনের প্রথা রয়েছে।
তিনি আরো জানান, আমাদের নতুন প্রজন্মকে শেকড়ের সন্ধান, আমাদের উৎস মূলের সন্ধান-আত্মিক সম্পর্কের সন্ধান দেবার জন্য আমাদের এই প্রয়াস। সেই সাথে আমাদের কৃষক সম্প্রদায় যারা রাতদিন অপরিসীম পরিশ্রম করে রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে আমাদের অন্ন যোগান দেন তাদের যথাযোগ্য মর্যাদা ও স্বীকৃতি প্রদানও আমাদের অন্যতম লক্ষ্য। এটি আমাদের একান্ত অভিলাষ।
নবান্নোৎসবের বিষয়ে একাডেমির (সাবেক) সদস্য ও প্রেমতলী ডিগ্ৰী কলেজের সহকারী অধ্যাপক যোগেন্দ্র নাথ সরেন বলেন, এ উৎসব মানে আনন্দের সঙ্গে সমৃদ্ধিও। কৃষক ও কৃষি ব্যবস্থার সঙ্গে নগরের মানুষের সংযোগ তৈরি করে দেওয়া এবং নিজেদের সংস্কৃতির সঙ্গে নতুন প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করাই এ আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য।
এসময় কথা হয় একাডেমির (ভারপ্রাপ্ত) উপপরিচালক বেনজামিন টুডু’র সঙ্গে। তিনি বলেন, নবান্ন উৎসব বাংলাদেশের মূলধারার সংস্কৃতির উৎসব। বছর ঘুরে নবান্ন উৎসব আসে ঠিকই, তবে পুরানো সে আভিজাত্য এখন আর নেই গ্রাম বাংলার প্রতিটি ঘরে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম তো জানে না, নবান্ন কি। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আমাদের সংস্কৃতিটাকে পৌঁছে দেওয়া, নবান্ন উৎসবকে নাগরিক জীবনে পরিচিত করাই আমাদের আয়োজনের মূল উদ্দেশ্যে।
এই উৎসবের বিষয়ে একাডেমির নির্বাহী সদস্য সুশেন কুমার সেমদুয়ার জানান, আজকে এই অনুষ্ঠানে এসে মনে হয়েছে সত্যি সত্যিই ধানের খেত থেকে উঠে আসা মানুষ। আমাদের ধানের ফলন বেড়েছে। যারা ধানের খেতে কাজ করে তারাই আসল কৃষি বিজ্ঞানী। আমাদের সমৃদ্ধির জন্য তারা সবচেয়ে বেশি কাজ করে। তাদের নিয়ে আজকে আমাদের এই আয়োজন।
একাডেমি প্রাঙ্গণেই কথা হয় রাজশাহী কলেজের ম্যানেজার বিভাগের আদিবাসী শিক্ষার্থী শিশির বিশ্বাস সঙ্গে। তিনি বলেন, কোলাহলের এই নগরীতে একাডেমির চত্বরে বসে পিঠা আর মুড়ি-মুড়কি খেতে খেতে ঢোলের তালে লোক সঙ্গীত শোনার মধ্যে দিয়ে মনের মধ্যে এক অন্য রকম শান্তি বিরাজ করছে।
কসবা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির আদিবাসী ছাত্রী সোনালী বিশ্বাস জানান, নবান্নোৎসব আদিবাসীদের জন্য প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী উৎসবের দিন। এই দিনটি আমরা নতুন পোশাক পরে, নাচ-গান ও আনন্দ উৎসবের আমেজে উদযাপন করে থাকি। তাই এই একাডেমির প্রাঙ্গনে এসেছি নাচ ও গানের মাধ্যমে দিনটি উদযাপন করা জন্য।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।