জুমবাংলা ডেস্ক : ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার কর্পূরের মতো হাওয়া হয়ে যায়। আর এ ঘটনা কম-বেশি আমাদের সবার জানা। তবে ঘটনার তদন্তে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী সাবেক দুই মন্ত্রীর বলপ্রয়োগসহ কত কী যে হয়েছে, তা অনেকেরই অজানা।
গত ১০ সেপ্টেম্বর ছিল এই মামলার প্রতিবেদন দাখিলের ৭৯তম দিন। তবে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে আদালতে প্রতিবেদন জমা দিতে না পারলেও শিগগিরই প্রতিবেদন দাখিলের পরবর্তী দিনের জন্য আবেদন করা হবে বলে জানিয়েছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা।
এর আগে, ২০২০ সালের ১ নভেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ছোট সম্মেলন কক্ষে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের একটি সভার আয়োজন করা হয়। ওই সভায় তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক উপস্থিত ছিলেন। সেদিন আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ততদিনে ওই ঘটনার তদন্ত কার্যক্রম প্রায় শেষ করে এনেছে। কিন্তু ঠিক ওই মুহূর্তে তদন্তের গতিপথ বদলে দেওয়ার জন্য তদন্তকারী সংস্থাটির ওপর চাপ প্রয়োগ করেন এই দুই মন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক বিভাগের তৎকালীন দুই সচিব। তারা তদন্ত প্রতিবেদন থেকে দেশি অপরাধীদের নাম বাদ দেওয়ার নির্দেশ দেন।
তবে সিআইডির তদন্তকারীরা তখন জানান, প্রতিবেদন থেকে দেশি অপরাধীদের নাম কোনোভাবেই বাদ দেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, তাদের অনেকেরই সরাসরি সংশ্লিষ্টতার তথ্যপ্রমাণ ও আলামত এরই মধ্যে সংগ্রহ করা হয়েছে।
এরপরও থেমে থাকে না সংশ্লিষ্টদের চাপ প্রয়োগ। একপর্যায়ে মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেওয়া হয়। সিআইডির নেতৃত্বে আনা হয় পরিবর্তন। পাশাপাশি মামলার গুরুত্বপূর্ণ আলামত ফরেনসিক প্রতিবেদন ও অন্তর্বর্তী তদন্ত প্রতিবেদন বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের (বিএফআইইউ) হাতে তুলে দেওয়ার জন্যও নির্দেশ দেওয়া হয়।
আর এতে অসম্মতি জানাতেই বাধে বিপত্তি। তদন্তসংশ্লিষ্ট সিআইডির তিন কর্মকর্তাকে পর্যায়ক্রমে বদলি করে দেওয়া হয়। আর নতুন তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার মো. আব্দুল্লাহ আল ইয়াসিনকে।
তার ওপর দেশি অপরাধীদের নাম বাদ দিতে তৎকালীন সিআইডি প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়ার মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জোর চাপ প্রয়োগ করা হয়। একই সঙ্গে তদন্তের ফলাফলকে নিয়ন্ত্রণে আনতে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির মাধ্যমে তদন্তের ফরেনসিক ও অন্তর্বর্তী অগ্রগতি প্রতিবেদন তুলে দেওয়া হয় আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কাছে। পরে রিজার্ভ চুরির তদন্ত ও মামলার কার্যক্রম সেখানেই থমকে যায়।
এরপর কেবলই দীর্ঘসূত্রিতা। এ পর্যন্ত ৭৯ বার সময় নিয়েও আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি সিআইডি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালের অক্টোবরের মধ্যেই ফিলিপাইন ও ভারত থেকে বিদেশি অপরাধীদের নিয়ে তথ্য ও সাক্ষ্যপ্রমাণ হাতে পেয়ে যায় সিআইডি। সে অনুযায়ী অভিযোগপত্র প্রস্তুত করা হলেও তা জমা দিতে দেওয়া হয়নি। উল্টো দুই মন্ত্রীর নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের সভা করে দেশি অপরাধীদের নাম বাদ দিতে চাপ দেওয়া হয়। মামলার গুরুত্বপূর্ণ ফরেনসিক প্রতিবেদন নিয়ে যাওয়া হয় খোদ অভিযুক্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের হাতেই, যদিও ওই প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার এখতিয়ার ছিল শুধু আদালতেরই।
তৎকালীন তদন্তসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মামলার তদন্ত গুছিয়ে আনার শেষ পর্যায়ে এর গতিপথ বদলে দিতে তৎপর হয়ে উঠেছিলেন রিজার্ভ চুরিতে অভিযুক্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ১২ কর্মকর্তা ও সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান। এতে সহায়ক ভূমিকা নেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রী। তাদের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অ্যাটর্নি জেনারেলের দপ্তরের কিছু কর্মকর্তার পক্ষ থেকেও বাংলাদেশি অপরাধীদের নাম বাদ দিয়ে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়ার বিষয়ে চাপ প্রয়োগ করা হয়।
পরে এতে কাজ না হলে ২০২০ সালের ২৯ অক্টোবর বৃহস্পতিবার বিএফআইইউ থেকে সিআইডির তৎকালীন প্রধান ব্যারিস্টার মাহবুবুর রহমানকে জানানো হয়, ১ নভেম্বর রিজার্ভ চুরির তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে তদন্তসংশ্লিষ্টদের উপস্থিত থাকতে বলা হয়। তবে সে সময় সভাসংক্রান্ত কোনো লিখিত চিঠি সিআইডিকে দেওয়া হয়নি। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ফোন করে সিআইডি প্রধানকে উচ্চপর্যায়ের ওই সভায় অংশ নেয়ার নির্দেশনা দেন।
এরই ধারাবাহিকতায় ১ নভেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ছোট সম্মেলন কক্ষে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা রায়হান উদ্দিন খান, তদন্ত তদারক কর্মকর্তা সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মোস্তফা কামাল এবং সিআইডি প্রধান ব্যারিস্টার মাহবুবুর রহমান সভায় অংশ নিতে যান। সভাকক্ষে তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মোস্তফা কামাল উদ্দিন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আসাদুল ইসলাম, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, বিএফআইইউ প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান, বিএফআইইউর সাবেক উপদেষ্টা দেবপ্রসাদ দেবনাথ, বিএফআইইউর যুগ্ম পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুর রব, পুলিশ মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদের প্রতিনিধি সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মইনুর রহমান চৌধুরী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পিএস দেওয়ান মাহবুব উপস্থিত ছিলেন।
রিজার্ভ চুরির মামলার শুরু থেকে ৭ বছর তদন্ত করেছেন রায়হান উদ্দিন খান। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রামে পুলিশ সুপার (অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, রিজার্ভ চুরির মামলা তদন্ত শুরুর পর দেশি-বিদেশি অপরাধীদের অপরাধসংশ্লিষ্ট সব তথ্য ধারাবাহিকভাবে সংগ্রহ করা হয়। বিশেষ করে ২০২০ সালেই বিদেশি প্রায় সব তথ্য আমাদের হাতে চলে আসে। সে সময়ই পুলিশ প্রতিবেদন দেওয়ার পূর্ণ প্রস্তুতি শুরু হয়। আমাদের সংগৃহীত সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতেই ফিলিপাইনের আদালতে রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের (আরসিবিসি) সাবেক শাখা ব্যবস্থাপক মায়া সান্তোস দেগুইতোর সাজা হয়েছিল। পাশাপাশি সে সময় রিজার্ভ থেকে চুরি যাওয়া ১০১ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে ৩৪ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলার উদ্ধার করা হয়। ওই সময়ই ফিলিপাইনের অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং কাউন্সিল (এএমএলএসি) আমাদের জানিয়েছিল, আমরা যদি বাংলাদেশের আদালতে দেশি-বিদেশি অপরাধীদের চিহ্নিত করে পুলিশ প্রতিবেদন দিতে পারি এবং আরসিবিসি ব্যাংকের বিষয়ে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করাতে পারি, তাহলে পুরো অর্থ উদ্ধার সহজ হয়ে যাবে। সে অনুযায়ী আমরা রিজার্ভ চুরি মামলার পুলিশ প্রতিবেদন দেওয়ার কাজ শুরু করি। কিন্তু স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায় থেকে আসা চাপ এবং ফরেনসিক প্রতিবেদনের অনুমোদন না পাওয়ায় সে কার্যক্রম স্তিমিত করে দেওয়া হয়।
রায়হান উদ্দিন খান আরও বলেন, পরে ২০২৩ সালে ফরেনসিক প্রতিবেদন অনুমোদন হলে আমরা চূড়ান্তভাবে রিজার্ভ চুরির পুলিশ প্রতিবেদন দাখিলের কার্যক্রম শুরু করি। কিন্তু সে সময়ও বাংলাদেশি অপরাধীদের নাম বাদ দিতে বলা হয়। তাতে সম্মতি না দিলে আমাকে বদলি করা হয়। সে পর্যন্ত রিজার্ভ চুরির তদন্তে সংগ্রহ করা সব আলামত ও তথ্য দুই স্তরের নিরাপত্তার মাধ্যমে সংরক্ষিত রেখে তদন্তভার নতুন কর্মকর্তার কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়।
কেন এভাবে দুই মন্ত্রীর নির্দেশে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির তদন্ত আটকে দেওয়া হয় তা জানা দরকার বলে মনে করেন সিনিয়র আইনজীবী আহসানুল করিম। তিনি বলেন, বাংলাদেশে সিআিইডি তদন্ত করেছে। এখন পর্যন্ত ৭৯বার সময় নিয়েছে কিন্তু চার্জশিট দেওয়া হয়নি। শোনা যায় তৎকালীন আইনমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চাপ দিয়েছিল যেনো কোনো চার্জশিট না দেওয়া হয় আর কোনো বাংলাদেশিকে যেন এখানে যুক্ত না করা হয়।
সিনিয়র এই আইনজীবী আরও বলেন, চার্জশিট জমা না দেওয়া কার স্বার্থে এটি আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। তাদের কাছেই জানতে হবে সিআইডি চার্জশিট তৈরির পরেও কেন দিতে পারেনি আর তাদের কেনো চাপ দেওয়া হয়েছে।
সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, এর জন্য দায়বদ্ধ বাংলাদেশের গভর্নর, ডেপুটি গভর্নর। তদন্ত হয়েছে, আর সেটি জনসম্মুখে দেখতে চাই। এবং অপরাধী যারা তাদের গ্রেপ্তার করে অতি শিগগিরিই বিচারের মুখোমুখি করা দরকার।
প্রসঙ্গত, রিজার্ভ চুরির মামলার তদন্ত অগ্রগতি নিয়ে সবশেষ গত ১৪ জুলাই সিআইডি সদর দপ্তরে বিশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে আজমালুল হোসেন কিউসি, বিএফআইইউর তৎকালীন প্রধান মাসুদ বিশ্বাস প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।