জুমবাংলা ডেস্ক : আয়কর রিটার্ন দাখিল বাড়াতে চলতি অর্থবছরে বিশেষ একটি উদ্যোগ নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। যেসব করদাতার শনাক্তকরণ নম্বরের (টিআইএন) বিপরীতে আয়কর রিটার্ন জমা হয়নি, তাদের ২০২২-২৩ অর্থবছরে জরিমানা ছাড়াই রিটার্ন দাখিলের সুযোগ দিয়েছে এনবিআর।
অর্থাৎ যারা কয়েক বছর আগে জরুরি কাজে কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) নিয়েছেন, কিন্তু প্রতিবছর রিটার্ন জমা বাধ্যতামূলক হলেও কোনোবারই রিটার্ন দেননি, তারা এবার রিটার্ন দিলে কোনও জরিমানা গুনতে হবে না। চলতি অর্থবছরের বাজেটে সবাইকে সাধারণ ক্ষমার আওতায় আনা হয়েছে। এনবিআরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এত দিন টিআইএন নেওয়ার পর কেউ কোনও বছর রিটার্ন দাখিল না করলে, তাকে প্রতি বছরের জন্য সর্বনিম্ন ৫ হাজার টাকা করে জরিমানা গুনতে হতো। এছাড়া কর্মকর্তাদের হয়রানির ভয়ে মানুষ রিটার্ন দিতে আগ্রহী হতো না। কেননা, রিটার্ন দিলেই ডিসিটি থেকে জয়েন্ট কমিশনার হয়ে ওপরের স্তরে ওই ফাইল যেতেই থাকবে। একইসঙ্গে করদাতাকে প্রশ্নের মুখে পড়তে হতো।
বর্তমানে ৭৬ লাখ টিআইএনধারী রয়েছেন, তাদের মধ্যে মাত্র ২৬ লাখ টিআইএনধারী রিটার্ন জমা দেন। বাকি ৫০ লাখ টিআইএনধারীর জন্য এবার বিরাট সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
এনবিআরের এই সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক বলে মন্তব্য করছেন অর্থনীতিবিদরা।
এ প্রসঙ্গে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, ‘জরিমানা বাতিল করায় করদাতা ও রাজস্ব বিভাগ– উভয়েই উপকৃত হবেন।’ তিনি উল্লেখ করেন, টিআইএনধারী সবাইকে রিটার্ন দাখিল করাতে পারলে একদিকে সরকারের রাজস্ব বাড়বে। অপরদিকে করদাতার জন্য একটি সুখকর বিষয় তৈরি হবে। তিনি বলেন, ‘দেখা যায়, অনেকেই শুধু টিআইএন খুলে বেশকিছু সেবা নিচ্ছেন। কিন্তু ওই টিআইএনের বিপরীতে সরকার কোনও রাজস্ব পাচ্ছে না। আবার প্রতিবছর জরিমানা দেওয়ার ভয়ে টিআইএন খুলেও অনেকে রিটার্ন জমা দেন না।’ এ বছর জরিমানা বাতিল করাটা অনেক ভালো উদ্যোগ হয়েছে বলে জানান তিনি। এছাড়া ৩৮ ধরনের সেবা পেতে হলে রিটার্ন জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। রিটার্ন জমার স্লিপ অথবা প্রত্যয়ন পত্র জমা না দিলে সেবা পাওয়া যাবে না। এতেও ভালো ফল দেবে। তিনি মনে করেন, যে ৫০ লাখ টিআইএন করেও রিটার্ন জমা দিতেন না, জরিমানা বাতিল করায় তাদের মধ্যে একটি বড় অংশ এবার রিটার্ন জমা দেবেন।
প্রসঙ্গত, প্রতি বছর ১ জুলাই থেকে আগের আয় বছরের রিটার্ন দাখিল শুরু হয়। ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত জরিমানা ছাড়াই রিটার্ন দাখিল করতে পারেন করদাতারা। অর্থাৎ আগামী ৩০ নভেম্বর চলতি বছরের আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার শেষ দিন।
তবে যৌক্তিক কারণে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে দাখিল না করতে পারলে উপকর কমিশনারের কাছে আবেদন করে করদাতা সময় নিতে পারেন। কিন্তু আবেদন না করলে তাকে প্রদেয় করের ১০ শতাংশ বা ১ হাজার টাকার মধ্যে যা বেশি, ওই পরিমাণ অর্থ এবং প্রতিদিনের জন্য ৫০ টাকা করে জরিমানা দিতে হয়।
যাদের বছরে তিন লাখ টাকার বেশি আয় আছে, তাদের মধ্যে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সবার টিআইএন নেওয়া ও প্রতি বছর আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। ২০১৯ সাল থেকে টিআইএনধারীদের আয়কর রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
৩৭ ধরনের সেবা নেওয়ার ক্ষেত্রে টিআইএন বাধ্যতামূলক। এর মধ্যে কেবল জমি বিক্রি করতে এবং ক্রেডিট কার্ড নিতে যারা টিআইএন নিয়েছেন, তাদের রিটার্ন দেওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই। এছাড়া বাংলাদেশে স্থায়ী ভিত্তি নেই— এমন অনিবাসীদের রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক নয়।
আয়কর বিভাগের হিসাব মতে, প্রতিটি কর অঞ্চল থেকে ই-টিআইএনধারী ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে রিটার্ন দাখিল করতে নোটিশ দেওয়া হয়। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ই-টিআইএন-এ দেওয়া ঠিকানায় সেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে খুঁজে পাওয়া যায় না। আবার খুঁজে পাওয়া গেলেও তারা রিটার্ন দেয় না। তাদের অনেকে ভয়ে ও অনেকে ঝামেলায় এড়াতে রিটার্ন দাখিল থেকে বিরত থাকে। অনেকে মনে করেন, একবার রিটার্ন দাখিল করলে প্রতিবছর রিটার্ন দাখিল করতে হবে। কেউ কেউ মনে করেন, রিটার্ন দাখিল করলে দৈবচয়নের নামে এনবিআরের কর্মকর্তারা নানা কায়দায় ঘুষ দাবি করবেন। আইনজীবীকে টাকা দিতে হবে। অহেতুক ঝামেলায় পড়তে হবে। এসব কারণে একাধিক নোটিশ দেওয়া হলেও বেশিরভাগ মানুষ কর্ণপাত করে না। গত দুই বছর কর অঞ্চল থেকে ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের ই-টিআইএন-এ দেওয়া মোবাইল ফোন নম্বরে এসএমএস দিয়ে রিটার্ন জমা দেওয়ার জন্য তাগিদ দেওয়া হয়। এরপরও বেশিরভাগ টিআইএনধারী রিটার্ন জমা দিচ্ছেন না। যদিও ২০১৯ সাল থেকেই প্রত্যেক টিআইএনধারীর জন্য রিটার্ন জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করেছে সরকার। জানা গেছে, টিআইএনধারীদের মধ্যে ২৬ লাখের কোনও হদিসই পাওয়া যাচ্ছে না, যা ‘ফাইল্ড কেস’ হিসেবে রাখা হয়েছে।
ব্যক্তি করদাতা ছাড়াও প্রায় পৌনে ২ লাখ নিবন্ধিত কোম্পানি রয়েছে, যার মধ্যে রিটার্ন জমা দেয় ৩০ হাজারের কম।
জিডিপিতে করের অবদান বিবেচনায় বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম পিছিয়ে থাকা একটি দেশ। দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশই ট্যাক্স টু জিডিপি রেশিওতে বাংলাদেশের ওপরে অবস্থান করছে। ধীরে ধীরে এতে বাংলাদেশের অবনমন হচ্ছে। একসময় ট্যাক্স টু জিডিপি রেশিও ১০ শতাংশ থাকলেও সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরের হিসাব অনুযায়ী, তা ৮ শতাংশের নিচে নেমে গেছে।
রিটার্ন জমা ছাড়া সেবা মিলবে না
এ বছর ৩৮ ধরনের সেবা পেতে হলে রিটার্ন জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। রিটার্ন জমার স্লিপ অথবা প্রত্যয়ন পত্র ছাড়া যেসব প্রতিষ্ঠান এই সেবা দেবে, তাদের ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা হবে। যেমন পাঁচ লাখ টাকার বেশি ব্যাংক ঋণ পাওয়া, পাঁচ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কেনা, ক্রেডিট ব্যবহার, অনলাইনে বেচাকেনার ব্যবসা, রাইড শেয়ারিংয়ে মোটরগাড়ি দেওয়া— এমনকি সন্তানকে ইংরেজি সংস্করণে (ইংলিশ ভার্সন) পড়াশোনা করালেও রিটার্ন জমা দিতে হবে। তাই ভবিষ্যতে এসব সেবা পেতে এবার রিটার্ন দিতেই হবে। আশা করা যাচ্ছে, যাদের পুরনো টিআইএন করা আছে, তারা এবার জরিমানা ছাড়াই রিটার্ন জমা দেবেন। এ ছাড়া গাড়ির মালিক, অভিজাত ক্লাবের সদস্য, কোম্পানির পরিচালক, ব্যবসায়ী সংগঠনের সদস্য, পৌরসভা থেকে জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত প্রার্থী হতে চাইলেও রিটার্ন দিতে হবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।