দুটো মহাজাগতিক বস্তুর দূরত্ব কখনো এক থাকে না, সময় সাপেক্ষে এই দূরত্ব পরিবর্তনশীল। এই আপেক্ষিক অবস্থান পরিবর্তনের ব্যাপারটা খুব সহজেই পরীক্ষা করা যায়। আমরা যদি নাকের ঠিক ডগায় একটি আঙুল খাড়া করে ধরে একবার বাঁ চোখ আরেকবার ডান চোখ দিয়ে (প্রতিবার অপর চোখ বন্ধ করে) সেটিকে দেখতে চাই, তবে একেকবার আঙুলটাকে একেক অবস্থানে দেখব। মহাজাগতিক দুটি বস্তুর ক্ষেত্রেও বিষয়টা অনেকটা সে রকম।
এই কারণেই শুধু আলোকবর্ষ বা অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিটের মতো সরল পরিমাপ একক দিয়ে দুটি মহাজাগতিক বস্তুর দূরত্ব মাপা অসম্ভব একটি কাজ। সরল গড় দূরত্বের সঙ্গে কৌণিক দূরত্ব এবং কিছু জ্যামিতিক পরিমাপ মিলিয়ে একধরনের যৌগিক একক তৈরি করা হয়েছে, যার নাম পার্সেক (Parsec)। এক পারসেক হলো ৩.২৬ আলোকবর্ষ বা ৩০.৮ ট্রিলিয়ন কিলোমিটার। যাঁদের ত্রিকোণমিতি সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান আছে, তাঁরা নিচের ছবিটা দেখলে পারসেক এককটি আরও ভালো করে বুঝতে পারবেন।
আকারে সূর্য পৃথিবীর তুলনায় মোটামুটি ১০৯ গুণ বড়। তারপরও সূর্যকে আমরা একটি পিরিচের আকারেই দেখি, এর কারণ, পৃথিবী আর সূর্যের মধ্যবর্তী দূরত্ব। মহাবিশ্বের অন্যান্য নক্ষত্রের আকারও কিন্তু বিশাল। যেমন সূর্যের সবচেয়ে নিকটবর্তী নক্ষত্র প্রক্সিমা সেন্টাউরি আকারে সূর্যের চেয়ে প্রায় ৩৩ গুণ বড়।
তারপরও তারাটি খালি চোখে পৃথিবী থেকে দেখা যায় না। কারণ, এটির আলো বিকিরণ করে অনেক কম এবং সূর্য থেকে এর দূরত্ব ৪.২৪ আলোকবর্ষ। কাজেই বোঝা যাচ্ছে, কোনো বস্তু দেখার জন্য সেই বস্তু থেকে আমাদের চোখ পর্যন্ত পরিমাণ আলো আসা আবশ্যক। আর যদি আলোর পরিমাণ কম হয়, তবে সেই বস্তুকে ভালোভাবে দেখার জন্য প্রাপ্ত আলোকে কোনো উপায়ে বিবর্ধন করে নিতে হবে।
যেকোনো বস্তু থেকে প্রতিফলিত বা উৎসরিত আলো যত বিবর্ধিত হয়ে আমাদের চোখে আসবে, সেই বস্তুকে আমরা ততটাই স্পষ্টভাবে দেখতে পাব। এই বিবর্ধনের কাজটা কিন্তু কৃত্রিমভাবেও করা যায়। বিবর্ধনের সবচেয়ে সোজা উপায় হলো একটি আতশি কাচ বা লেন্সের মাধ্যমে বস্তুকে দেখা। আতশি কাচ বা উত্তল লেন্স প্রতিসরণের মাধ্যমে কোনো বস্তুকে বিবর্ধন করে দেখাতে পারে। আবার বস্তুকে ছোট করে দেখানোর জন্য ব্যবহৃত হয় অবতল লেন্স।
অপটিক্যাল টেলিস্কোপ বা দূরবীক্ষণ যন্ত্র মূলত এই লেন্স দিয়েই তৈরি করা হয়। ১৬০৯ সালে হ্যান্সের আমল থেকে গত শতকের শুরু পর্যন্ত তা–ই করা হতো। তবে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে রেডিও কমিউনিকেশন নিয়ে যখন ব্যাপক গবেষণা শুরু হলো, তখন বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করতে থাকলেন মহাকাশ থেকে প্রতিমুহূর্তে পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়া মহাজাগতিক রশ্মি বিশ্লেষণ করতে।
১৯৩১ সালে বিশ্বখ্যাত বেল কমিউনিকেশনসের মার্কিন প্রকৌশলী কার্ল জ্যানস্কি মতবাদ দিলেন, এসব মহাজাগতিক রশ্মিকে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করতে পারলে সুদূর নক্ষত্র বা মহাকাশের বিভিন্ন বস্তুর নিখুঁত ‘ছবি’ তৈরি করা সম্ভব। এরপরের বছরই তিনি অনেকগুলো অ্যান্টেনার সমন্বয়ে একটি অ্যারে (ছবি দ্রষ্টব্য) তৈরি করেন এসব মহাজাগতিক রশ্মি গবেষণার জন্য। যেহেতু দূর মহাকাশেরই ছবি তুলছে রেডিও অ্যান্টেনার এই দল, একেও তাই টেলিস্কোপ বলা যায়। টেলিস্কোপের এই নতুন ধারার নাম দেওয়া হলো রেডিও টেলিস্কোপ।
ভূপৃষ্ঠে বসানো রেডিও টেলিস্কোপের কাজ অপটিক্যাল টেলিস্কোপের তুলনায় নিখুঁত হলেও চর্মচক্ষে দেখার আলাদা আবেদন, সহজ ব্যবহার প্রণালি ও অপেক্ষাকৃত কম মূল্যের কারণে শৌখিন মহাকাশপ্রেমীদের কাছে অপটিক্যাল টেলিস্কোপ অনেক বেশি প্রিয়।
অপটিক্যাল টেলিস্কোপ আবার মূলত তিন ধরনের। প্রথমটা হলো প্রতিসরণকারী টেলিস্কোপ—এ টেলিস্কোপ আলোর প্রতিসরণ ধর্মকে ভিত্তি ধরে তৈরি করা হয়। প্রথম যুগে হ্যান্স বা গ্যালিলিওর তৈরি করা টেলিস্কোপগুলো এই জাতের। জাহাজের দুরবিনও একধরনের প্রতিসরণকারী টেলিস্কোপ। প্রতিফলনকারী টেলিস্কোপ—এ টেলিস্কোপ মূলত স্যার আইজ্যাক নিউটনের আবিষ্কৃত টেলিস্কোপ।
এতে ব্যবহৃত মূল লেন্সটি একটি আয়না হিসেবে কাজ করে এবং আলোর প্রতিফলন ধর্ম ব্যবহার করে বিবর্ধনের কাজটি করে। তৃতীয়টি হলো যৌগিক টেলিস্কোপ—প্রতিসরণ ও প্রতিফলনকারী টেলিস্কোপের সমন্বয়ে গঠিত একধরনের টেলিস্কোপ এটি। ১৮২০ সালে ফরাসি পুরকৌশলী ও পদার্থবিদ অগাস্টিন জ্যাঁ ফ্রেনেল প্রথম তৈরি করেন যৌগিক প্রতিফলক। আর এই যৌগিক প্রতিফলক দিয়েই পরবর্তী সময়ে যৌগিক অণুবীক্ষণ ও দূরবীক্ষণ যন্ত্র তৈরি করা হয়।
যৌগিক টেলিস্কোপের মূল সুবিধা হলো ছোট আকারের, তবে অনেক বেশি বিবর্ধন ক্ষমতা। বর্তমানে মহাকাশ দেখার জন্য শৌখিন থেকে পেশাদার, মোটামুটি সবাই এই ধরনের টেলিস্কোপই ব্যবহার করেন। অপটিক্যাল টেলিস্কোপের মতো রেডিও টেলিস্কোপের অনেক রকমফের আছে। এর কোনোটি দেখতে রেডিও ওয়েভ, কোনোটি এক্স–রে, কোনোটি ইনফ্রারেড আবার গামা রশ্মিতে ক্রিয়া করে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।