জুমবাংলা ডেস্ক : ২০১৭ সালে বাংলাদেশে ঘুরে যাওয়া রোবট ‘সোফিয়া’কে আমরা দেখেছি। হংকংয়ের ডেভিড হ্যানসন উদ্ভাবিত রোবট মানুষের মতো কথা বলতে, চিন্তা করতে এবং বিভিন্ন অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে পারে। সাংহাইয়ের আকাশের ড্রোনগুলো কিউআর কোডের পাশাপাশি প্রিন্সেস কানেক্ট ভিডিওচিত্রের কয়েকটি চরিত্রের ছবিও আকাশে এঁকেছে। রোবটিক্সবিষয়ক আন্তর্জাতিক ফেডারেশনের এক রিপোর্টে জানা গেছে, ২০১৮ ও ’১৯ সালের মধ্যবর্তী সময়ে পেশাদার কাজে সহযোগিতায় সক্ষম রোবটের বিক্রি বিশ্বজুড়ে ৩২ শতাংশ বেড়েছে।
অ্যামাজন, নাইকি, আলিবাবার মতো বৃহৎ কোম্পানির একেকটি গুদামে হাজার হাজার রোবট কাজ করছে। হংকংয়ের একটি ওয়্যারহাউসে নতুন এক দল রোবট কাজ শুরু করেছে, যেগুলো স্বয়ংচালিত। চীনের ‘গিকপ্লাস’ নামক একটি প্রতিষ্ঠান এই স্বচালিত রোবট উদ্ভাবন করেছে। সিএনএনের এক রিপোর্টে বলা হয়, রোবটের পাল দারুণ কাজ দেখিয়েছে। হংকংয়ের সে ওয়্যারহাউস গত চার মাসে ১০ লাখের বেশি বিভিন্ন ধরনের পণ্য সরবরাহ করতে পেরেছে। একইভাবে দক্ষিণ-পূর্ব লন্ডনের অনলাইন সুপার মার্কেট ওকাডোতে তিন হাজার রোবট অর্ডার অনুযায়ী পণ্য সরবরাহের কাজ করে চলেছে।
জাপানি কোম্পানির তৈরি সাত ফুট উঁচু মডেলের রোবট টোকিওর দুটি বৃহত্তম ওয়্যারহাউসে পণ্য সাজিয়ে রাখার কাজ করে থাকে। মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের এমআইটি একটি কোম্পানির সঙ্গে মিলে এমন এক রোবট বানিয়েছে, যেটি মেঝে পরিষ্কারের কাজ করে। এটি ১০-২০ জন মানুষের কয়েক ঘণ্টার কাজ একাই করে দেয় মাত্র আধঘণ্টায়। ওয়াবট ১-কে বলা হয় প্রথম ফুল স্কেল হিউম্যানয়েড রোবট, ১৯৭৩ সালে জাপানের ওয়াসেডা বিশ্ববিদ্যালয় এটি তৈরি করেছিল। এটি হাঁটতে পারত, জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করতে পারত, এমনকি কথাও বলতে পারত। এটির উত্তরসূরিও (ওয়াবট-২) অনেক উন্নতি করেছিল।
মানুষকে অনেক সময় ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে হয়। দুর্ঘটনাবশত অনেকের প্রাণও চলে যায়। যেসব জায়গায় বিপদের শঙ্কা রয়েছে, সেখানে রোবটকে কাজে লাগালে বিপদের শঙ্কা আর থাকবে না। বিভিন্ন শিল্পকারখানায় রোবটকে কাজে লাগিয়ে প্রোডাকশনের স্পিড অনেকাংশে বাড়ানো যায়। তাদের বিশ্রামের প্রয়োজন হয় না। তাদের কাজের গতি কখনোই কমে আসবে না। রোবটের কাজে কখনোই মনোযোগের ব্যাঘাত ঘটে না। কেউই তাদের অ্যাটেনশন কেড়ে নিতে পারবে না। কম্পিউটার এইডেড ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে রোবটিক্স ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। বিশেষ করে যানবাহন কারখানায় রোবট ব্যবহৃত হয়। চিকিৎসক, নার্স বা রোগীদের কাছে প্রয়োজনীয় জিনিস, ওষুধ দ্রুত পৌঁছাতে স্বাস্থ্য খাতে রোবটের ব্যবহার হচ্ছে। এরই মধ্যে আয়ারল্যান্ডের এক দল চিকিৎসক মস্তিষ্কের অস্ত্রোপচারে রোবটের সফল ব্যবহার করেছেন। অঙ্গহানির ফলে ব্যবহৃত হচ্ছে রোবটিক হাত-পায়ের মতো অঙ্গ।
পারফেক্ট প্রডাকশন দেওয়ার জন্য রোবটের সুনাম রয়েছে। রোবটগুলো সাধারণত কখনও ভুল করে না। বিস্ফোরক নিষ্ক্রিয়করণ, ডুবে যাওয়া জাহাজের অনুসন্ধান, বিভিন্ন খনিতে রোবটিক ডিভাইস ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। পারমাণবিক কেন্দ্রে ক্ষতিকর তেজস্ক্রিয়তার মধ্যে যেসব শ্রমিক কাজ করে, তাদের অনেক ঝুঁকি থাকে। এসব ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় রোবট কাজ করতে পারে। অনেক হোটেল-রেস্টুরেন্টেও খাবার আনা-নেওয়া ও পরিবেশনের কাজ করছে রোবট।
বোমা চিহ্নিতকরণ, মাইন অপসারণ ও বোমা নিষ্ক্রিয়করণ রোবট, ড্রোন, চালকহীন রোবট বিমানসহ রোবটিক্সে অত্যাধুনিক কিছু আবিষ্কার সামরিক ও যুদ্ধক্ষেত্রে কাজ করছে। বিভিন্ন উন্নত দেশে বিপজ্জনক পরিস্থিতি মোকাবিলায় রোবটকে ব্যবহার করা হয়। যেমন জিম্মি মুক্ত করা, গোলাগুলির পরিস্থিতি, ক্যামেরার সাহায্যে জানালায় নজর রাখতে ঘটনাস্থলে রোবটকে ব্যবহার করা হয়। উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থাপনায় নিরাপত্তার জন্য রোবট ব্যবহৃত হয়। মাইক্রোওয়েভ ভিশনের সাহায্যে যে কোনো অধাতব দেয়ালের অপর পাশে কী রয়েছে তা দেখতে পারে, অন্ধকারে কয়েকশ ফুট দূর থেকেও আগন্তুককে দেখতে পায় নিরাপত্তার জন্য তৈরি করা রোবট। মঙ্গল গ্রহে যুক্তরাষ্ট্রের নাসা ‘কিউরিসিটি’ নামে একটি রোবট পাঠিয়েছে, যেটি মঙ্গলের পরিবেশ, প্রকৃতি ইত্যাদি থেকে তথ্য সংগ্রহ করে সেগুলোকে বিশ্লেষণ করে পৃথিবীতে পাঠাচ্ছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় বিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের জন্য রোবট শিক্ষক ব্যবহার করা হচ্ছে, যাদের ‘টেলি-প্রেজেন্স’ রোবট বলা হয়। মঙ্গল গ্রহে পাঠানো মার্স রোভার থেকে নাসার রোবট পৃথিবীর গণ্ডি পেরিয়ে মহাকাশেও বিচরণ করছে।
বিভিন্ন সুবিধা থাকা সত্ত্বেও রোবটের কিছু অসুবিধা রয়েছে। সব জায়গায় রোবটের ব্যবহার বাড়লে মানুষ চাকরি হারাবে। ফলে মানুষ বেকার হয়ে পড়বে। রোবটের ভিন্ন সত্তা বা বুদ্ধিমত্তা না থাকায় এর কোনো সৃজনশীলতা নেই। প্রোগ্রামের বাইরে তাদের কিছু করার ক্ষমতা নেই। তাই রোবট কখনও মানুষের বিকল্প হতে পারে না। মানুষের বিকল্প হিসেবে রোবট প্রতিস্থাপন করা কিন্তু অনেক খরচের বিষয়। তাদের প্রাথমিক খরচ, রক্ষণাবেক্ষণসহ সবকিছুতে যথেষ্ট খরচ প্রয়োজন। রোবটের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেলে টেকনোলজির ওপর নির্ভরশীলতা অনেকাংশে বেড়ে যাবে। একজন মানুষ বিভিন্ন প্রকার কাজ করার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু একেকটা রোবট শুধু নির্দিষ্ট কাজ করতে সক্ষম। মানুষের মতো সব রোবট পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে না, যদি তার প্রোগ্রাম পরিবর্তন করা না হয়। রোবটনির্ভর শিল্পকারখানায় রক্ষণাবেক্ষণ খরচ, দক্ষ টিম ও বিদ্যুৎ প্রয়োজন। রোবট এবং এ সম্পর্কিত যন্ত্রপাতির দাম এখনও মানুষের হাতের নাগালে আসেনি। তাই রোবট ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়বহুল।
পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশে রোবটের ব্যবহার এবং এ নিয়ে গবেষণা হচ্ছে বহুদিন ধরে। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম আগ্রহী হচ্ছে রোবটিক্স শিক্ষা ও গবেষণায়। এ আগ্রহ ধরে রাখতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে হবে। রোবটিক্স যন্ত্রপাতি সহজলভ্য করতে হবে। বাংলাদেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রোবটিক্স বিভাগ চালু হয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন জেলায় যেসব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় নির্মিত হচ্ছে, সেগুলোতে রোবটিক্স বিভাগ চালুর ব্যাপক প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কারণ বঙ্গবন্ধুর যে সোনার বাংলা গঠনের স্বপ্ন এবং সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশের পথে যে স্বপ্নযাত্রা; তার সঠিক ও যুগোপযোগী বাস্তবায়নে রোবটিক্স শিক্ষায় জ্ঞান অর্জন এবং এর ব্যাপকভিত্তিক গবেষণা ও ব্যবহার জরুরি।
ড. মো. মোরশেদুল আলম: শিক্ষক,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।