লকডাউন উঠলে ভয়ংকর বিপদ

সংক্রমণ ও মৃত্যুর হারে কিছুটা অবনমন দেখে লকডাউন তুলে নেওয়া হলে করোনার ভয়াবহ বিস্তার ঘটতে পারে বলে সতর্ক করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও)। সংস্থার প্রধান টেড্রোস আধানম গ্রেব্রিয়েসাস বলেছেন, বিশ্বের দেশগুলো যদি সামাজিক দূরত্বের বিধি-নিষেধ খুব তাড়াতাড়ি তুলে নেয়, তবে পরিস্থিতি ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। এমনকি অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়লেও বিধি-নিষেধ শিথিল করার ক্ষেত্রে দেশগুলোকে সতর্ক হতে হবে।

লকডাউন অব্যাহত থাকলেও ইউরোপের দেশ ইতালি ও স্পেন বেশ কিছু পদক্ষেপ শিথিল করেছে। এ অবস্থায় গত শুক্রবার জেনেভায় ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে টেড্রোস বলেন, খুব দ্রুত বিধি-নিষেধ প্রত্যাহার করে নেওয়া হলে করোনাভাইরাস ভয়ংকর হয়ে ফিরে আসতে পারে। মানুষের জীবনযাপনের ওপর থেকে কড়াকড়ি তুলে নেওয়ার ক্ষেত্রে দেশগুলোকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আরো কৌশল নিতে হবে।

ডাব্লিউএইচওর প্রধান বলেন, অন্য সবার মতো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও কড়াকড়ির অবসান চায়। কিন্তু একই সময়ে এটিও মনে রাখতে হবে, খুব তাড়াতাড়ি এসব বিধি-নিষেধ তুলে নেওয়া হলে ভাইরাসের আবার ভয়াবহ বিস্তার দেখা দেবে। তখন হয়তো পরিস্থিতি এতই ভয়াবহ হবে যে তা আর সামলা দেওয়া যাবে না।

তিনি আরো বলেন, অন্য অনেক দেশে ভাইরাসটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। আফ্রিকার প্রত্যন্ত অঞ্চলেও পৌঁছে গেছে করোনাভাইরাস।

স্পেনে আগামীকাল সোমবার থেকে নির্মাণ খাত ও বেশ কিছু কারখানার শ্রমিকদের কাজে ফেরার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। বিধি-নিষেধ শিথিল করা হলেও দেশটির সরকার সবাইকে এখনো ‘সামাজিক দূরত্বের’ নির্দেশনা মেনে চলতে বলেছে। ইতালির প্রধানমন্ত্রী জুজেপ্পে কোন্তে তাঁর দেশে লকডাউনের মেয়াদ ৩ মে পর্যন্ত বাড়িয়েছেন। লকডাউনের সময়সীমা বাড়ালেও দেশটি ছোটখাটো কিছু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে মঙ্গলবার থেকে খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্যে বই ও বাচ্চাদের পোশাকের দোকান আছে বলে জানিয়েছেন কোন্তে। করোনাভাইরাস সংক্রমণের হার কমিয়ে আনতে আয়ারল্যান্ডও লকডাউনের মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী লিও ভারাদকার ৫ মে পর্যন্ত লকডাউন থাকবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন। ইস্তাম্বুল, আংকারাসহ ৩১টি শহরে ৪৮ ঘণ্টার কারফিউ জারি করেছে তুরস্ক। পর্তুগালের প্রেসিডেন্ট মার্সেলো রেবেলো দে সুজা জরুরি অবস্থার মেয়াদ ১ মে পর্যন্ত বাড়িয়েছেন।

যুক্তরাজ্য সরকার জানিয়েছে, তারা লকডাউন বহাল রেখেই কিছু বিধি-নিষেধ তুলে নেওয়ার কথা ভাবছে। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা গত বৃহস্পতিবার লকডাউনের মেয়াদ আরো দুই সপ্তাহ বাড়ানোর ঘোষণা দিলেও বিরোধীরা এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে।

বৈশ্বিক পরিস্থিতি : ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন কভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসের চিকিৎসা নিয়ে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট ত্যাগ করার প্রায় ২৪ ঘণ্টা পরে গত শুক্রবার হাসপাতালে হেঁটেছেন। এদিকে করোনাভাইরাস মহামারিতে দেশটিতে প্রথমবারের মতো দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা এক হাজারের কাছাকাছি পৌঁছেছে।

ডাউনিং স্ট্রিটের এক মুখপাত্র বলেছেন, স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য বিশ্রামের মাঝে প্রধানমন্ত্রী ছোট পদক্ষেপে হাঁটতে সক্ষম হয়ে উঠছেন। এই ভয়ংকর রোগে আক্রান্তদের নিয়েও তিনি চিন্তা করছেন।

ব্রিটেনের সর্বশেষ পরিসংখ্যানে বলা হয়, গত শুক্রবার ২৪ ঘণ্টায় দেশটিতে করোনায় ৯৮০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই সংখ্যা দৈনিকের হিসাবে সর্বোচ্চ।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রে করোনার কেন্দ্রস্থল নিউ ইয়র্কের গভর্নর অ্যান্ড্রু কুয়োমো গত শুক্রবার বলেছেন, রাজ্যটি ফের খুলে দেওয়ার আগে সেখানকার লাখ লাখ লোকের অবশ্যই করোনাভাইরাস পরীক্ষা করাতে হবে। এদিকে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার মন্থরগতি অব্যাহত রয়েছে বলেও তিনি জানান।

কুয়োমো বলেন, গত মাসে এ সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে তাঁদের আইসিইউয়ে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা সর্বনিম্ন পর্যায়ে এসেছে। তবে তিনি নগরীর বাসিন্দাদের ফের কাজে যোগদানের আগে করোনাভাইরাস পরীক্ষার গতি বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন।

নিউ ইয়র্কে প্রায় এক লাখ ৬০ হাজার লোক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। এ সংখ্যা ইউরোপের সবচেয়ে বেশি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত দেশ স্পেন, ইতালিসহ যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের যেকোনো দেশের চেয়ে অনেক বেশি।

ইউরোপের দেশ ফ্রান্সে গত শুক্রবার আরো ৯৮৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে হাসপাতালে মারা গেছে ৫৫৪ জন আর বৃদ্ধনিবাসে ৪৩৩ জন। তবে দেশটিতে ঝুঁকিপূর্ণ রোগীর সংখ্যা কমার কথা জানিয়েছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জেরেমি সলোমন। বৈশ্বিক পরিসংখ্যানভিত্তিক ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটারের হিসাব অনুযায়ী, গতকাল শনিবার বাংলাদেশ সময় রাত ৯টা পর্যন্ত বিশ্বের ২১০টি দেশ ও অঞ্চলে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। মোট শনাক্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে সোয়া ১৭ লাখ। এ সময়ের মধ্যে মারা গেছে প্রায় এক লাখ পাঁচ হাজার মানুষ। সুস্থ হয়েছে প্রায় চার লাখ মানুষ।

বর্তমানে চিকিৎসাধীন সোয়া ১২ লাখ কভিড-১৯ রোগীর মধ্যে মৃদু থেকে মাঝারি অসুস্থতায় ভুগছে পৌনে ১২ লাখ মানুষ, যা বর্তমান রোগীর ৯৬ শতাংশ। বাকি ৪ শতাংশ বা ৫০ হাজার মানুষের অবস্থা গুরুতর।

যুক্তরাষ্ট্রে ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যুর রেকর্ড : নভেল করোনাভাইরাসের বর্তমান কেন্দ্রস্থল যুক্তরাষ্ট্রে গত শুক্রবার দুই হাজার ১০৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। ভাইরাসটি মহামারি আকার ধারণ করার পর এই প্রথম কোনো দেশে ২৪ ঘণ্টায় মৃতের সংখ্যা দুই হাজার ছাড়াল। জনস হফকিন্স ইউনিভার্সিটির বরাতে এ তথ্য জানিয়েছে বার্তা সংস্থা এএফপি। অন্যদিকে শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রে আক্রান্তের সংখ্যা ৩৫ হাজার ৯৮ জন বেড়ে সংক্রমিতের সংখ্যা পাঁচ লাখ ছাড়িয়েছে। যে হারে যুক্তরাষ্ট্রে মৃতের সংখ্যা বাড়ছে, তাতে দু-এক দিনের মধ্যে ইতালিকে ছাপিয়ে যেতে চলেছে দেশটি।

এক দিনে রেকর্ড মৃত্যু হলেও হোয়াইট হাউসের কভিড-১৯ সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লকডাউন ও নানা বিধি-নিষেধের ফলে দেশটিতে আক্রান্তের হারের ঊর্ধ্বগতি ঠেকানো সম্ভব হয়েছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, করোনাভাইরাসের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে মৃতের সংখ্যা আগের ধারণার চেয়ে অনেক কম হবে। শুরুর দিকে প্রাণঘাতী এই ভাইরাসে যুক্তরাষ্ট্রে এক থেকে আড়াই লাখ মানুষের মৃত্যু হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়েছিল।

ভারতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ২৩৯ : করোনাভাইরাসে ভারতে গতকাল মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩৯-এ। মোট আক্রান্ত হয়েছে সাত হাজার ৪৪৭ জন।

ভারতের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আক্রান্তদের মধ্যে ৬৪২ জন সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ত্যাগ করেছে। গত শুক্রবার সন্ধ্যার পর থেকে নতুন করে ৩৩ জন মারা গেছে। তাদের ১৭ জন মধ্য প্রদেশে, ১৩ জন মহারাষ্ট্রে, দুজন গুজরাটে এবং একজন আসামে মারা গেছে।

আমাজনের সেই কিশোরের মৃত্যু : আমাজন বনে এক আদিবাসী কিশোরের শরীরে করোনাভাইরাস ধরা পড়ার কথা জানিয়েছিল ব্রাজিল। গত শুক্রবার মার্কিন সম্প্রচার মাধ্যম সিএনএন জানিয়েছে, ওই কিশোর মারা গেছে। বৃহস্পতিবার উরারিকোইরা নদীর পারে রিহেবে গ্রামে ইয়ানোমামি গোষ্ঠীর ১৫ বছর বয়সী ছেলেটি মারা যায়। গহিন আমাজনে খনি শ্রমিকদের অনুপ্রবেশের মাধ্যমে এই ভাইরাস আদিবাসীদের মধ্যে ছড়িয়েছে বলে আশঙ্কা করছে দ্য সোসিও এনভায়রনমেন্টাল ইনস্টিটিউট (আইএসএ)। গতকাল পর্যন্ত ব্রাজিলে প্রায় ২০ হাজার মানুষের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে; যার মধ্যে অন্তত এক হাজার ৫৬ জনের প্রাণহানি ঘটেছে।

সূত্র : বিবিসি, এএফপি।