জুমবাংলা ডেস্ক : বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যাকাণ্ডের লোমহর্ষক বর্ণনা দিলেন তার রুমমেট অন্তিম। জানা গেছে, সেদিন শেরেবাংলা হলের নিজ কক্ষে (১০১১ নম্বর) ঘুমিয়ে ছিলেন আবরার ফাহাদ। এসময় ছাত্রলীগ কর্মী ও মেক্যানিক্যাল বিভাগের একই ব্যাচের শিক্ষার্থী মুনতাসির আল জেমি এবং সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের এহতেশামুল রাব্বি তানিম ওই কক্ষে এসে আবরারকে ঘুম থেকে ডেকে তোলেন। পাশের সিটেই আবরারের রুমমেট অন্তিম পড়ায় মগ্ন ছিলেন।
ঘুম ঘুম চোখে আবরার কিছু বুঝে ওঠার আগেই জেমি বলে, ‘ভাইরা তোকে ২০১১ নম্বর রুমে ডাকে। তোর মোবাইল ও ল্যাপটপ নিয়ে চল।’
সিনিয়র ভাইদের কথামতো আবরার ২০১১ নম্বর কক্ষে যায়। এর কিছুক্ষণ পর তার অপর দুই রুমমেট ১৬তম ব্যাচের মিজান ও ১৭ তম ব্যাচের রাফি রুমে আসলে। তাদের রুমে রেখে অন্তিম পলাশীতে কফি খেতে চলে যান।
ঘটনার বিবৃতি দিয়ে অন্তিম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আবরারের সঙ্গে আমার ওটাই ছিল আমার শেষ দেখা। ‘৯ টার দিকে আমাকে ঘুম থেকে তুলে দিস’ – এ কথাটাই ছিল বন্ধু আবরারের বলা শেষ কথা জানিয়ে কেঁদে ফেলেন অন্তিম।
আবরার সন্ধ্যায় কেন ঘুমাচ্ছিলেন প্রশ্নে অন্তিম বলেন, আমাদের পরীক্ষা চলছে। সবাই রাত জেগে পড়ি। তাই এনার্জি নিতে সন্ধ্যায় ঘুমিয়ে নিই আমরা। আবরারও রাতে পড়তে চেয়েছিল। তাই রাত ৯ টার দিকে তাকে ঘুম থেকে তুলে দিতে বলেছিল।’
অন্তিম বলেন, পলাশী থেকে কফি খেয়ে এসে দেখি রুম তালা দেয়া। রুমমেট রাফি ও মিজান রুমে নেই। সঙ্গে চাবি না থাকায় পাশের ২০১০ নম্বর কক্ষে বসে অপেক্ষা করতে থাকি আমি। কিছুক্ষণের মধ্যেই কোথা থেকে যেন মিজান ও রাফি কক্ষে এমে তালা খুলে।
অন্তিম যোগ করেন, ইতিমধ্যে ১০ টা বেজে যায়। তবুও আবরার ফেরে না। বিষয়টি নিয়ে ভাবতে থাকি আর এর মধ্যেই ফের জেমি রুমে এসে আবরারের একটি গ্রামীণ চেকের শার্ট ও একটা ট্রাউজার নিয়ে যায়।
অন্তিম বলেন, এ সময় আমি জেমিকে আবরার কোথায় আর কেন আসছে না জিজ্ঞেস করলে সে জানায়, ‘আবরার ঠিক আছে।’ পরবর্তীতে আবরারের লাশের গায়ে গ্রামীণ চেকের সেই শার্টটি দেখা যায়। সেটিও ছেঁড়া ছিল।
ছাত্রলীগ কর্মী ও মেক্যানিক্যাল বিভাগের ১৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মুনতাসির আল জেমি
কান্নারত কণ্ঠে অন্তিম জানায়, নিহত আবরারের গায়ে সেই চেক শার্টটি ছেঁড়া অবস্থায় দেখেছি। আমাদের সহপাঠী জেমিরা যে আবরারকে মেরে ফেলবে, এটা মাথায়ই আসেনি।’
এরপর রাত ২টা ২০ মিনিটে তিতুমীর হলে খেতে যান অন্তিম। রাত ৩ টার দিকে খেয়ে ফেরার পথে হলের গেটে প্রবেশ করেই স্ট্রেচারে আবরারের নিথর দেহ দেখতে পান। সেই নিথর দেহের পাশে দাঁড়িয়ে রুমমেট মিজান ও রাফি কান্না করছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, স্ট্রেচারে থাকা আবরারের লাশের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল, মুয়াজ, মেক্যানিক্যাল ১৫ ব্যাচের শিক্ষার্থী ও বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার, সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন।
এছাড়াও হল কর্তৃপক্ষের মধ্যে বুয়েটের ডাক্তার মাসুক এলাহী, প্রভোস্ট ড. জাফর ইকবাল, সহকারী প্রভোস্ট শাহিনুর রহমান, সহকারী প্রভোস্ট ড. ইফতেখার ও ছাত্রকল্যাণ পরিচালক ড. মিজানুর রহমান স্ট্রেচারের পাশে ছিলেন।
অন্তিম জানান সে সময় উপস্থিত বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল স্ট্রেচারে আবরারের নিথর দেহকে নির্দেশ করে ডাক্তার মাসুক এলাহীকে বলেন, ‘ওকে (আবরার) ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেই।’
জবাবে ডাক্তার মাসুক এলাহী বলেন, ‘১০ থেকে ১৫ মিনিট আগে মারা গেছে ছেলেটা। ওকে হাসপাতালে পাঠিয়ে কী হবে?’
আবরারের নিথর দেহ সিঁড়িতে পড়ে থাকতে দেখেছিলেন আহনাব নামে ১৭ তম ব্যাচের মেকানিক্যাল বিভাগের এক শিক্ষার্থী।
তিনি বলেন, ‘আমি অনেক রাত পর্যন্ত পড়ছিলাম। রাত ২ টার দিকে আমি পানি আনার জন্য বোতল নিয়ে বের হই। সিঁড়ি দিয়ে নামতেই দেখি দোতলা ও নিচতলার সিঁড়ির মাঝামাঝি জায়গায় তোষকের ওপর আবরারের নিথর দেহ পড়ে আছে। আমি দ্রুত রুমে চলে যাই। আমার হাত-পা অবশ হয়ে যায়। বুঝতে পারছিলাম না কী করব। এরপর আবার আসি। তখন দেখি কেউ তাকে স্ট্রেচারে তুলে রেখেছে।’
এদিকে আবরার হত্যা মামলায় রিমান্ডে থাকা ১০ আসামি গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হত্যায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে বলে জানিয়েছেন ডিবির ঢাকা দক্ষিণের এডিসি রাজিব আল মাসুদ।
তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে তারা যেটা বলেছে, যে হত্যার মোটিভ টি আসলে হত্যার জন্য ছিল না। মরাপিট করতে করতে এক পর্যয়ে ভিকটিম মারা যায়। যাদেরকে আমরা ধরেছি, তারা মারপিটি অংশ গ্রহণ করেছে, এরকমটা স্বীকার করেছে।
‘এজাহারের নাম থাকলে যে কেউ আসামি হবে। বিষয়টা এমন না। বিষয়টা তদন্ত সাপেক্ষে বের করতে হবে। এর ঘটনার সাথে যারা জড়িত ছিল, প্রাথমিক ভাবে তারা ধরা পড়েছে। আমরা তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি, যাদের নাম পেয়েছি, তাদের নাম নোট করেছি। সে ক্ষেত্রে অমিত শাহ কেনো অন্য কেউ যদি থাকে তাদেরকেও ধরা হবে।’
প্রসঙ্গত, রোববার মধ্যরাতে বুয়েটের সাধারণ ছাত্র ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আবরারকে শেরেবাংলা হলের দ্বিতীয় তলা থেকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে যায়। সোমবার সকাল সাড়ে ৬টার দিকে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এই ঘটনায় নিহতের বাবা মো. বরকত উল্লাহ ১৯ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত কয়েক জনকে অভিযুক্ত করে চকবাজার থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় ১০ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
এদিকে মঙ্গলবার বেলা পৌনে ১১টায় নিজ বাসার সামনে আবরারের তৃতীয় জানাজা শেষে স্থানীয় রায়ডাঙ্গা কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।