নিজস্ব প্রতিবেদক, গাজীপুর: কাঠফাটা রোদ কিংবা মুষলধারে বৃষ্টি- বিলে গিয়ে শাপলা তাদের তুলতেই হবে। না হলে সংসার চলবে কী করে? এ মৌসুমে বিলের শাপলাই তাদের অন্ন জোগায়। বলছি, গাজীপুরের তিন উপজেলার বিলপাড়ের মানুষের কথা। বর্ষা শুরুর পর শ্রাবণ থেকে অগ্রহায়ণ পর্যন্ত এসব গ্রামের অন্তত ৪০০ পরিবার শাপলা বিক্রির সঙ্গে যুক্ত। জেলার কালীগঞ্জ শ্রীপুর, কাপাসিয়া উপজেলার নলগাঁও, প্রহলাদপুর, ডুমনী, টোকনয়ন বাজার, দুবার্টি, মোহানীসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের মানুষ শাপলা বিক্রি করে বছরের এ সময়ে জীবিকা নির্বাহ করে। বিল থেকে সংগ্রহ করেন পরিবারের পুরুষরা। আর প্রক্রিয়াজাতের সিংহভাগ কাজ করেন নারীরা।
বিলের কালচে পানির ওপর সবুজের ফাঁকে ফুটে আছে লাল শাপলা। সাদা শাপলা স্থানীয় বাজারগুলোতে সবজি হিসেবে বিক্রি হয়। লাল শাপলা বিশেষ উপায়ে প্রক্রিয়াজাত করে ঢাকার বিভিন্ন ক্রেতার কাছে বিক্রি করা হয়।
বর্ষা মৌসুমে উপজেলার কৃষক ও দিনমজুররা বিল থেকে শাপলা তুলে বিক্রি করে। শাপলা বিক্রি করে একজন ব্যক্তি দিনে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা আয় করেন। কোনো পুঁজির প্রয়োজন না হওয়ায় বর্ষাকালে বিভিন্ন বয়সের মানুষ এ কাজে যুক্ত হয়। শাপলা ফুল সাধারণত জ্যৈষ্ঠ থেকে শুরু করে কার্তিক পর্যন্ত পাওয়া যায়। তবে মৌসুমের শেষ অর্থাৎ কার্তিক মাসে তেমন বেশি পাওয়া যায় না।
শ্রীপুর লাগোয়া গাজীপুর সদরের লক্ষ্মীপুর গ্রামের গৃহিণী অঞ্জনা দাস জানান, পুঁজি বলতে ৪ হাজার টাকার একটি নৌকা। শাপলা তুলে বিক্রি করে প্রতি মৌসুমে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করে থাকেন। দুটি ছেলের পড়াশোনার খরচসহ সংসার চলে শাপলা বিক্রির টাকায়।
একই গ্রামের গৃহিণী দিপালী রানী জানান, নৌকা দিয়ে নদী থেকে শাপলা তুলে এনে কেটে রোদে শুকিয়ে বিক্রি করেন। ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি করতে পারেন। বৃষ্টিতে ভিজে বা পচে গেলে দাম কম পান। গত বছর সর্বোচ্চ ১২০ টাকা কেজি দরে ১৬০ কেজি বিক্রি করেছেন।
গৃহিণী রীনা রানী জানান, তার ছেলে-স্বামী ভোর থেকেই বিলে শাপলা ওঠানোর কাজ শুরু করেন। শুকনো শাপলা সর্বোচ্চ ১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছেন। ১০ বছর ধরে তারা শাপলা বিক্রি করে আসছেন। একজন নারী প্রতি মৌসুমে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারেন। বিলের জায়গা মালিকানা থাকলেও কেউ শাপলা ওঠাতে বাধা দেন না।
একই উপজেলার প্রহলাদপুরের কৃষক লিটন দাস বলেন, ১০ বছর ধরে এসব এলাকায় লাল শাপলা সংগ্রহ ও বিক্রি করা হচ্ছে। সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত একজন ব্যক্তি অনেক শাপলা সংগ্রহ করতে পারেন, যেগুলো শুকানোর পর অন্তত পাঁচ কেজি হয়। পুরুষেরা শাপলা সংগ্রহ করেন। শুকানোর প্রক্রিয়া করেন নারীরা। বর্তমানে বাজারমূল্য বেশি হওয়ায় অনেকেই শাপলা সংগ্রহের কাজ করেন। কমপক্ষে ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা যায়।
গাজীপুর মহানগরীর চতর বাজারের সবজি বিক্রেতা আব্দুল জব্বার জানান, এক কেজির আঁটি সাদা শাপলা প্রতি মুড়ি (আঁটি) ৭ টাকায় কিনে ১০ টাকায় বিক্রি করেন। একদিন পরপর স্থানীয়রা শাপলা তুলে বাজারে নিয়ে আসেন। শুকনো শাপলা পাইকাররা ওষুধ বানানোর জন্য বাড়ি থেকে কিনে নিয়ে যান। ১ মণ ৮ হাজার টাকায় বিক্রি করি। বারো পাইয়া বিল, পারুলী নদীর চারপাশ থেকে স্থানীয়রা শাপলা তোলেন।
গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার নিম্নাঞ্চলগুলো বৃষ্টির পানিতে এখন টইটম্বুর। বিশেষ করে উপজেলার বিলগুলোতে এখন ভরা যৌবন। এ উপজেলায় ছোট-বড় ৪-৫টি বিল রয়েছে। এসব বিলে শোভা পাচ্ছে সাদা ও লাল রঙের শাপলা। জাতীয় ফুল শাপলা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন উপজেলার দুই ইউনিয়নের ৫ গ্রামের ৩ শতাধিক পরিবার।
কাপাসিয়ার পাঁচুয়া বাজার ব্যবসায় কমিটির সভাপতি আফতাব উদ্দিন জানান, সাধারণত বর্ষায় খাল-বিল, ডোবায় যখন পানি টইটম্বুর করে, তখন
জলে ভাসতে দেখা যায় শাপলা। কাপাসিয়া উপজেলার নাইঘর, নাগাইশ, শিদলাই ও দুলালপুর পশ্চিম বিলে অপরূপ শোভা ছাড়াচ্ছে অগণিত শাপলা ফুল। দূর-দূরান্ত থেকে প্রকৃতিপ্রেমীদের অনেকেই বিস্তীর্ণ জলাভূমির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসছেন প্রায় প্রতিদিনই।
লাল শাপলা দেখতে আসা শিক্ষার্থী তন্ময় হাসান বলেন, ফেসবুক ও ইউটিউবে লাল শাপলার অনেক ছবি ও ভিডিও দেখেছি। তাই দেখতে এলাম। খুবই ভালো লেগেছে। এত শাপলা আগে কখনও একসঙ্গে দেখিনি।
পাঁচুয়া বাজারসংলগ্ন বিলে কথা হয় মাঝি কাজল মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, আগে এখানে কোনো নৌকা ছিল না। দর্শনার্থীদের ঘুরে দেখার জন্য নৌকার ব্যবস্থা করি। প্রতিদিন অনেক মানুষ আসে। ঢাকা, নরসিংদী, গাজীপুর থেকে দল বেঁধে লোকজন আসে। তাদের বিল ঘুরিয়ে প্রতিদিন আমার প্রায় ৬০০-৭০০ টাকা আয় হয়।
বিলের পাশের বাসিন্দা কলেজ শিক্ষার্থী নাজমুল আলম বলেন, ভোরে বিলের জলে ফুটন্ত শাপলার আসল সৌন্দর্যের দেখা যায়। সূর্য ওঠার পর থেকে ফুটন্ত শাপলাগুলো আস্তে আস্তে মুখ গুটিয়ে নেয়। এই সময়টিতেই শাপলার শোভা দেখতে আসা মানুষের ভিড় থাকে বেশি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।