জুমবাংলা ডেস্ক: শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলকে ‘বিক্রি করে’ বিপুল টাকা কামিয়েছেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) এক কর্মচারী। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বদলির আবেদনে সুপারিশ লিখে ‘উপমন্ত্রীর সই’ করতেন তিনি। বিনিময়ে নিতেন কয়েক লাখ টাকা। এভাবে তিনি ঢাকায় কিনেছেন বিলাসবহুল ফ্ল্যাট!
ওই কর্মচারীর নাম মো. জুয়েল। তিনি মাউশির মহাপরিচালকের পিয়ন। উপমন্ত্রীর সুপারিশ ও সই জাল করার ঘটনা ধরা পড়ায় ৬ নভেম্বর তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। গঠন করা হয়েছে তদন্ত কমিটি। একই সঙ্গে জালিয়াতিতে জড়িত থাকার অভিযোগে সরকারি হাই স্কুলের দু’জন সহকারী শিক্ষককে দূরবর্তী স্থানে বদলি করা হয়েছে।
জাতীয় দৈনিক সমকালের আজকের সংখ্যায় প্রকাশিত সাংবাদিক সাব্বির নেওয়াজের করা একটি বিশেষ প্রতিবেদনে উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরীর স্বাক্ষর জাল করে মাউশির কর্মচারী জুয়েলের বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার বিস্তারিত তথ্য উঠে এসেছে।
শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী গতকাল দৈনিকটিকে বলেন, ‘আমার স্বাক্ষর জাল করে ঢাকায় শিক্ষক বদলি করে আনার ঘটনা ঘটেছে। এসব সই ও লেখা- কোনোটিই আমার নয়। এ পর্যন্ত এমন ছয়টি ঘটনা আমার কাছে ধরা পড়েছে। একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট এর পেছনে কাজ করছে বলে আমার ধারণা। আমি এগুলো পিবিআইকে (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) তদন্তের জন্য দিয়েছি। তারা তদন্ত করে দেখবে কতগুলো এমন ঘটনা ঘটেছে।’
উপমন্ত্রী বলেন, ‘মজার বিষয় হলো, অনেক সময় আমি এমন নির্দেশনা দু’একটি দিয়েছি বটে। সেই বদলি কিন্তু হয়নি।’ স্বাস্থ্যের ডিজির গাড়িচালকের মতোই অবস্থা। তদন্তে সব বের হয়ে আসবে বলে জানান উপমন্ত্রী।
উপমন্ত্রী ছয়টি ঘটনা ধরা পড়ার কথা বললেও জুয়েল যার পিয়ন সেই মহাপরিচালক ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক সমকালকে বলেন, ‘দুটি ঘটনা ধরা পড়েছে। আমরা জুয়েলকে সাময়িক বরখাস্ত করেছি। তদন্ত চলছে।’
মাউশি সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর আজিমপুর গভর্নমেন্ট গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী শিক্ষক (গণিত) কেএম মাহমুদুল হাসান রাজধানীর গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলে বদলির জন্য সম্প্রতি মহাপরিচালক বরাবরে আবেদন করেন। এ আবেদনে মহাপরিচালকের প্রতি শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের স্ব্বাক্ষর সংবলিত নির্দেশনা ছিল। একইভাবে কুমিল্লা দাউদকান্দির বেগম আমেনা সুলতান সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে রাজধানীর তেজগাঁও সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় অথবা শেরেবাংলা নগর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসতে আবেদন করেন সহকারী শিক্ষক (ইংরেজি) ফাতেমা আক্তার। তার আবেদনেও উপমন্ত্রীর স্ব্বাক্ষর সংবলিত নির্দেশনা ছিল। এ আবেদন দুটি উপমন্ত্রীর স্ব্বাক্ষর দেখে মাউশির মাধ্যমিক শাখার কর্মকর্তাদের সন্দেহ হয়। তারা আবেদন দুটির স্বাক্ষর যাচাই করতে উপমন্ত্রীর একান্ত সচিবের কাছে পাঠান। উপমন্ত্রীর দপ্তর থেকে এ স্বাক্ষর উপমন্ত্রীর নয় বলে মাউশিকে নিশ্চিত করা হয়। স্বাক্ষর জালিয়াতির এ ঘটনা ধরা পড়ায় গত মাসে মাউশি দুই সদস্যবিশিষ্ট এক তদন্ত কমিটি গঠন করে। মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা নাজমুন নাহার শাহীনকে প্রধান করে গঠিত এ কমিটির অপর সদস্য তেজগাঁও সরকারি বিজ্ঞান স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা রহিমা খাতুন। কমিটির তদন্তকালে এ ঘটনার সঙ্গে মাউশি মহাপরিচালক প্রফেসর ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুকের পিয়ন মো. জুয়েলের নাম উঠে আসে।
তদন্ত কমিটির জেরার মুখে সংশ্নিষ্ট শিক্ষক দু’জন জানান, তারা নিজেরা আবেদন মাউশিতে জমা দেননি। পরিচিতজনদের দিয়ে তারা আবেদন জমা দিয়েছেন। তাদের আবেদনে কীভাবে উপমন্ত্রীর স্বাক্ষর এলো, তা তারা জানেন না। শিক্ষক কেএম মাহমুদুল হাসান এ ঘটনায় তদন্ত কমিটির কাছে ঝালকাঠি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক বাবুল আক্তার এবং ভোলার নিজাম উদ্দিন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা শাখার সহকারী শিক্ষক মুজাহিদের নাম বলেন। তবে তদন্ত কমিটির কাছে বাবুল আক্তার ও মুজাহিদ মাহমুদুল হাসানকে চেনেন বলে জানালেও তার বদলির আবেদনের বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে জানান।
শিক্ষিকা ফাতেমা আক্তার জানান, তিনি বদলির আবেদন জমা দিয়েছেন ধানমন্ডি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের অফিস সহকারী আবু সালেকের মাধ্যমে। আবু সালেক তদন্ত কমিটিকে জানান, ফাতেমার আবেদন তিনি মাউশির মহাপরিচালকের পিয়ন মো. জুয়েলের কাছে দিয়েছিলেন। জুয়েলই তা জমা দেন।
আবু সালেক জানান, ধানমন্ডি কামরুন্নেসা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মিজানুর রহমানের মাধ্যমে ফাতেমা আক্তারের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। মহাপরিচালকের পিয়ন মো. জুয়েল ও মিজানুর রহমানকে তদন্ত কমিটি জিজ্ঞাসাবাদ করে। তারা দু’জনই উপমন্ত্রীর সই জাল করার বিষয়টি অস্বীকার করেন।
আজিমপুর গভর্নমেন্ট গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ হাছিবুর রহমান ও দাউদকান্দির বেগম আমেনা সুলতান সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দেলোয়ার হোসেন তদন্ত কমিটিকে জানান, সংশ্নিষ্ট শিক্ষকদের বদলির আবেদনের বিষয়ে তারা কিছুই জানেন না। যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে তারা আবেদন করেননি।
তদন্ত কমিটি তদন্তে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্নেষণে বলেছে, কেএম মাহমুদুল হাসান ও ফাতেমা আক্তারের বদলির আবেদনে উপমন্ত্রীর স্বাক্ষর (জাল) ও সিল থাকলেও কোনো ডকেট নম্বর নেই। যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে তারা বদলির আবেদন করেননি। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, তারা নিজেরা সরাসরি বদলির আবেদন জমা দেননি, অন্যের মাধ্যমে দিয়েছেন। বদলির আবেদনে এই শিক্ষকদের স্বাক্ষর যাচাই করে তা সঠিক প্রমাণিত হয়েছে।
মাউশি সূত্র জানায়, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর ৬ অক্টোবর মাউশি মহাপরিচালকের পিয়ন মো. জুয়েলকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। আর এর আগেই শিক্ষক কেএম মাহমুদুল হাসানকে ঢাকা থেকে নেত্রকোনার দুর্গাপুরের এমকেসিএম পাইলট গভ. হাই স্কুল ও ফাতেমা আক্তারকে হবিগঞ্জের মাধবপুরের গোবিন্দপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে বদলি করা হয়।
উপমন্ত্রীর স্বাক্ষর জাল করার সঙ্গে সুনির্দিষ্টভাবে কে কে জড়িত তা খুঁজে বের করতে দুই সদস্যের আরেকটি তদন্ত কমিটি গত বুধবার গঠন করেছে মাউশি। মাউশির ঢাকা অঞ্চলের উপপরিচালক নূরে আলম সিদ্দিকী ও প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক (ফিন্যান্স অ্যান্ড প্রকিউরমেন্ট) মহিউদ্দিন আহমেদকে এ কমিটিতে রাখা হয়েছে। নূরে আলম সিদ্দিকী জানান, শিগগিরই তারা তদন্ত কাজ শুরু করবেন।
মাউশির মাধ্যমিক শাখার পরিচালক বেলাল আহমেদ সমকালকে জানান, উপমন্ত্রীর স্বাক্ষর ও নির্দেশ সংবলিত একের পর আবেদন মাউশিতে আসতে থাকলে তাদের সন্দেহ হয়। তারা সেগুলো উপমন্ত্রীর নজরে আনেন। এর পরই এ ঘটনা ধরা পড়ে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, জাল স্বাক্ষরে কী পরিমাণ বদলি করা হয়েছে তা তাদের জানা নেই। তবে উপমন্ত্রীর স্বাক্ষর থাকা আরও ২১টি বদলির আবেদন তারা যাচাইয়ের জন্য সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন।
মাউশির একটি সূত্র জানায়, পিয়ন জুয়েল বেছে বেছে ঢাকায় শুধু গণিত ও ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষকদের বদলি করে আনতেন। বদলিপ্রতি তিনি চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা নিতেন।
কে এই জুয়েল
মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া থানার গোসাইর চর গ্রামে জুয়েলের বাড়ি। ২০১৬ সাল থেকে মাউশি মহাপরিচালকের পিয়ন হিসেবে কাজ করছেন। তার বাবা ধানমন্ডি গভর্নমেন্ট বয়েজ হাই স্কুলের বেসরকারি শাখার পিয়ন।
জুয়েলের সহকর্মীরা জানান, মোহাম্মদপুরে আলিশান ফ্ল্যাট কিনেছেন জুয়েল। আর তার বাবা স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ধানমন্ডি গভর্নমেন্ট বয়েজ স্কুলের ফিডার শাখার দুই রুম নিয়ে বিনা অনুমতিতে থাকছেন।
জুয়েলের বিরুদ্ধে সরকারি হাই স্কুলের শিক্ষক ও কর্মচারী বদলি, সদ্য সরকারীকরণ স্কুল শিক্ষকদের সনদ ও তথ্য বদলে দেওয়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। শিক্ষা অধিদপ্তরের নিয়োগ বাণিজ্যেও জড়িয়ে আছে তার নাম। জালিয়াতি করে এমপিও পাইয়ে দেওয়া, টাকার বিনিময়ে ফাইল গায়েব করাসহ বিভিন্ন অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে মো. জুয়েলের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তাকে পাওয়া যায়নি। মোবাইল ফোনে বারবার ফোন করেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। তদন্ত শুরুর খবরে তিনি পালিয়ে গেছেন বলে জানিয়েছেন তার সহকর্মীরা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।