অতিরিক্ত টাকা দেওয়ার ফলে শিশু নষ্ট হয়ে গেছে, অথবা বড় হওয়ার পরেও হিসেব করে টাকা খরচ করতে পারে না, অথবা টাকা দিলে যক্ষের ধনের মতো জমিয়ে রাখে, খরচ করতে চায় না, অথবা শিশু সঞ্চয় করতে শিখেনি, অথবা বাজারে গেলে যাচাই বাছাই না করেই হুট করে কোনো কিছু ক্রয় করে, অথবা অল্প বয়সেই টাকা পয়সার প্রতি অত্যাধিক লোভ- এই বিষয়গুলো অনেক শিশুর মধ্যেই দেখা যায়।
এসব বিষয় নিয়ে অনেক অভিভাবক শুধু যে দুশ্চিন্তায় ভোগেন তা নয়, কী করবেন সেটাও বুঝতে পারেন না। আসলে অর্থ ব্যবস্থাপনার কিছু মৌলিক জ্ঞান শিশুকে শেখানো হয় না বলেই, এই সমস্যাগুলো তৈরি হয়।
আয়, ব্যয়, সঞ্চয়, দান ইত্যাদি হচ্ছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক অর্থ ব্যবস্থাপনার মূল স্তম্ভ। অথচ এটা যে প্যারেন্টিং এর গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়, তা আমরা অনেকেই জানি না। শিশু যত বড় হতে থাকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ধীরে ধীরে সম্পৃক্ত হতে থাকে। একই সাথে মিডিয়া, বিজ্ঞাপন এবং বন্ধুবান্ধব দ্বারাও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়।
তাই অর্থ বিষয়ক ব্যবস্থাপনা যদি শৈশবে শেখানো না হয়, তাহলে হয় সে বন্ধুবান্ধবের পাল্লায় পড়ে অর্থ অপব্যয় করবে অথবা বিজ্ঞাপন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কনজিউমারিজমে আক্রান্ত হবে অথবা সম্পদ থাকা সত্ত্বেও ব্যবস্থাপনা না জানার কারণে অর্থকষ্টে ভুগবে।
এ কারণেই বয়সের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে শিশুকে ধাপে ধাপে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও ব্যবস্থাপনার সঠিক শিক্ষা দেওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষাটা শিশু মা-বাবার কাছ থেকেই পায়। মা-বাবা কীভাবে আয় ও ব্যয় করেন, আর্থিক বিষয়ে কীভাবে সিদ্ধান্ত নেন- এই বিষয়গুলো শিশুকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে।
তারপরেও শিশুকে যদি সঠিক শিক্ষা দিতে চান তাহলে অবশ্যই পরিকল্পনা থাকতে হবে। কোন বয়সে কতটুকু শেখাবেন, কতটুকু স্বাধীনতা দিবেন- অভিভাবক হিসেবে এই বিষয়গুলো আপনাকে জানতে হবে।
শিশুর মধ্যে অর্থ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক প্রজ্ঞা সঞ্চারের জন্য কিছু বিষয় খেয়াল রাখা জরুরি :
প্রথমত, চার বছরের আগে শিশুকে দান শেখানোর দরকার নেই। ১-৩ বছরের মধ্যে শিশুর মধ্যে মালিকানা বোধ (Ownership) জাগ্রত হয়। ‘এটা আমার’-এই ধারণাটি শিশুর মধ্যে বিকশিত হয়। এটা স্বার্থপরতা নয়, এক ধরনের দক্ষতা। এই দক্ষতাটি বিকশিত হওয়ার আগে শিশুকে কখনো দান করতে শেখাবেন না। চার বছরের ছোট শিশুর খেলনা অন্যকে দিতে অনুরোধ করবেন না। তবে শিশু যদি অন্যকে স্বেচ্ছায় দেয়, সেটা ভিন্ন বিষয়।
দ্বিতীয়ত, ছয় বছরের আগে শিশুর হাতে টাকা দিবেন না। যদি কোন কিছু দিতে হয়, আপনি কিনে দিবেন। ছয় বছর পর থেকে সীমিত পরিমাণে টাকা দেওয়া শুরু করবেন। এক্ষেত্রে অবশ্যই দিকনির্দেশনা (কীভাবে খরচ করবে?) এবং নজরদারি- দুটোই থাকতে হবে। তারপর বয়সের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আস্তে আস্তে টাকার পরিমাণ এবং খরচের স্বাধীনতা দুটোই বাড়াবেন।
তৃতীয়ত, সঞ্চয়, দান এবং প্রয়োজনীয় ব্যয়- এই তিনটি বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা অবশ্যই দিবেন। হাত খরচ হিসেবে যে টাকাটা দিবেন, সেটা থেকে প্রথমেই একটি অংশ সঞ্চয় করতে উদ্বুদ্ধ করুন। একটি অংশ যেন সে অন্যের জন্য ব্যয় করে সেই শিক্ষাও দিন। সেটা হতে পারে ছোট ভাই-বোনের জন্য কিছু কিনে দেওয়া অথবা অভাবী বিপন্ন মানুষকে সহায়তা করা। এর মধ্যে দিয়ে তার মধ্যে দানের মানসিকতা গড়ে উঠবে। বাকী অংশটা তাকে নিজের মতো খরচ করতে দিন। শুধু খেয়াল রাখবেন অনৈতিক কিছু যেন না করে।
কখনো প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা দিবেন না। এতে করে শিশুর মধ্যে বিলাসিতা ও অপব্যয়ের অভ্যাস গড়ে উঠতে পারে। সীমিত সম্পদ ব্যবহার করে কীভাবে সর্বোচ্চ উপযোগ পাওয়া যায়- এই দক্ষতাটিও তার মধ্যে তৈরি হবে না।
ঘরের যে কাজগুলো শিশু প্রতিদিন করে, তার বিনিময়ে টাকা দিবেন না। প্রথমদিকে উৎসাহিত করার জন্য দু-একবার দিতে পারেন, তবে সবসময় নয়। পরিবারের সদস্য হিসেবে এই কাজগুলো যে তার দায়িত্ব, এই উপলদ্ধিটুকু তাকে দিতে হবে। তা না হলে সে নিজেকে পরিবারের অংশ মনে করবে না। এছাড়াও একবার বিনিময় পেয়ে অভ্যস্ত হয়ে গেলে পরবর্তীতে সে টাকা ছাড়া এই কাজগুলো করতে চাইবে না।
আপনার কাজ হলো সন্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক প্রজ্ঞা সঞ্চারের চেষ্টা করা। মানুষের জীবনে কেন সঞ্চয় প্রয়োজন- সেটা তাকে বুঝিয়ে বলুন। ভবিষ্যতে পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে অথবা দুর্ঘটনা ঘটলে অথবা অন্য কোন জরুরি প্রয়োজনে অর্থের প্রয়োজন হলে, তখন সঞ্চয়ই একমাত্র ভরসা। অন্যের কাছে যেন হাত পাততে না হয়- এই আত্মমর্যাদাবোধটুকু শিশুর মধ্যে জাগ্রত করার চেষ্টা করবেন।
পরিবারে অভাব থাকলেও তা শিশুর সামনে প্রকাশ করার দরকার নেই। শিশুর জন্য আপনারা কষ্ট করছেন- একথা কখনো বলতে যাবেন না। এর ফলে শিশু বাড়তি একটি চাপ অনুভব করে হীনমন্যতায় ভুগতে পারে। এছাড়াও যে শিশুরা ছোটবেলায় অর্থনৈতিক সমস্যার মধ্য দিয়ে বড় হয়, তাদের মধ্যে সাধারণত অর্থের প্রতি লোভ এবং অসততার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।
কিছু বিষয়ে আপনাকে বরাবরই সচেতন থাকতে হবে। ছোট শিশুকে নিয়ে ঘন ঘন মার্কেটে যাওয়ার দরকার নেই। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে বাজারে নিতে পারেন। কিন্তু বিলাস দ্রব্য কেনাকাটার জন্য তাকে সঙ্গে রাখবেন না। এর ফলে শিশু কনজিউমারিজমে আক্রান্ত হতে পারে। যদি নিতেই হয়, নিয়ন্ত্রণ অবশ্যই আপনার হাতে থাকতে হবে। যদি মনে করেন মার্কেটে গেলে শিশু বায়না ধরবেই- তাকে নেওয়ার দরকার নেই।
আর যদি নিতেই হয়, তাহলে সর্বোচ্চ কত টাকা খরচ করতে পারবে তা আগে থেকে বলে রাখবেন অথবা ‘কোনো কিছু দাবি করতে পারবে না’- এই শর্তে নিয়ে যাবেন। বাজারে গেলে শিশু কী নিয়ে জেদ ধরতে পারে? এবং এই পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দিবেন- এর পূর্ব প্রস্তুতি আপনার মধ্যে থাকতে হবে।
কেনাকাটার ক্ষেত্রে আপনি নিজে মিতব্যায়ী হওয়ার চেষ্টা করবেন। আপনি ঊড়নচণ্ডি হলে শিশুও অর্থকে মূল্যায়ন করতে শিখবে না, অপচয় করবে। বাকী বা ঋণ করে কেনাকাটাকে পুরোপুরি বর্জন করবেন এবং শিশুদেরকে নিরুৎসাহিত করবেন। ক্রেডিট কার্ডের ফাঁদ সম্পর্কে শিশুকে বারবার সতর্ক করবেন। আশেপাশের পরিচিত মানুষজন ঋণগ্রস্থ হয়ে কীভাবে নিঃস্ব হয়েছেন? কেন হয়েছেন? এবং বর্তমানে কী দুর্দশা ভোগ করছেন? –এই উদাহরণ শিশুর সামনে তুলে ধরবেন। যাতে সে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।
অর্থনৈতিক ব্যাপারে আপনাকে যথেষ্ঠ বাস্তববাদী হতে হবে। অর্থের প্রয়োজন নেই এই ধরনের শিক্ষা শিশুকে দিবেন না, আবার অর্থের বিনিময়ে সব কিছু কেনা যায় না- এটাও শিশুকে বুঝিয়ে দিন। সন্তান যেন লটারি, গুপ্তধন কিংবা অন্যের আশায় যেন বসে না থাকে- এ বিষয়ে সন্তানকে আগে থেকেই সতর্ক করবেন। পরিশ্রম ছাড়া যারা টাকা অর্জন করতে চায় এবং যারা বেশি লোভ করে, তারাই প্রতারণার ফাঁদে পড়ে।
সব সময় অপচয়, বাহুল্য, ফুটানি ও বিলাসী জীবনযাপনকে নিরুৎসাহিত করবেন। আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দান ও সঞ্চয় করাকে উৎসাহিত করবেন। আপনি যদি এই বিষয়গুলো মেনে চলতে পারেন, তাহলে সম্ভাবনা হচ্ছে আপনার সন্তান এটাকেই জীবনাদর্শ হিসেবে গ্রহণ করবে। আপনার দৃষ্টিভঙ্গি-ই শিশুকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।