স্পোর্টস ডেস্ক: মুম্বাইয়ের আজাদ ময়দানের তাঁবু। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হচ্ছে, আঁধার বাড়ছে। নিভু নিভু আলোয় তাঁবুতে ঢুকলেন ক্লান্ত শ্রান্ত এক কিশোর। ঢুকেই অবশ্য বিশ্রামের জোঁ নেই। তাঁবুতে থাকা মাঠকর্মী ও মালিদের কড়া হুকুম, রান্না করতে হবে।
ভারতের বেনারস থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরের প্রত্যন্ত এলাকা ভাদোহি। এখানেই ছেলেটার জন্ম। নাম তার যশস্বী জয়সাল। বাবা ভূপেন্দ্র পেশায় ছিলেন রং বিক্রেতা। মা কাঞ্চন বেসরকারি স্কুলে পড়াতেন। চার সন্তানসহ ছয়জনের সংসার।
সংসার চালাতে হিমশিম খেতেন ভূপেন্দ্র। এর মধ্যেই এক ছেলে জয়সালের আবদার, সে ক্রিকেট খেলবে। স্বপ্ন তার আকাশ সমান। বড় ক্রিকেটার হতে চায়! কিন্তু চার সন্তানের লালন-পালনের পর যশস্বীকে ক্রিকেটার বানানোর খরচ জোগানো স্রেফ অসম্ভব হয়ে উঠছিল ভূপেন্দ্রর পক্ষে।
ছেলেকে কাছে ডেকে বাবা বুঝান। কিন্তু জয়সালের স্বপ্নালু মন ব্যথাতুর হয়ে ওঠে। মুম্বাইয়ে পাঠানোর জন্য বাবাকে বুঝাতে থাকে সে। একসময় ছেলের অদম্য স্পৃহার কাছে পরাভূত হলেন ভূপেন্দ্র। জয়সালের জায়গা হলো মুম্বাইয়ের চাচার বাড়িতে।
চাচার অবস্থাও ভালো নয়। তাই সেখানে বেশিদিন থাকা হলো না। কিশোর জয়সওয়াল মাথার উপরে ছাদ হিসেবে পেলেন আজাদ ময়দানের মাঠকর্মীদের তাঁবু। সকালে ব্যাট-বল নিয়ে পড়ে থাকতেন মাঠে, সন্ধ্যা হলেই শুরু হতো অন্যজীবন। ক্রিকেটটা চালিয়ে নিতে মাঠের পাশেই পানিপুরি বিক্রি করতেন এই তরুণ ক্রিকেটার।
সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হতো জয়সালের হাঁকডাক। তার সঙ্গে অনুশীলন করা অনেক কিশোরও খেতে আসতেন দোকানে। ব্যাপারটা জয়সালের জন্য অস্বস্তিকর হলেও স্বপ্নের তাড়নায় খুঁজেছেন হাসিমুখ। হঠাৎই কেরোসিনের প্রদীপের আলোর মতো জয়সালের জীবনে প্রদীপ হয়ে আসলেন এক ভদ্রলোক; জ্বালা সিং।
পানিপুরি বিক্রেতা কিশোর থেকে প্রতিভার আলোয় উদ্ভাসিত এক তরুণের পুরোটা জুড়েই বটবৃক্ষ হয়ে থেকেছেন জ্বালা। পেশায় তিনি ক্রিকেট কোচ। তার শৈশবও ছিল জয়সালের মতো। লড়াই করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন বটে, তবে ক্রিকেটার হবার স্বপ্নটুকু পূরণ হয়নি। তাই বলে আরেক কিশোরের স্বপ্ন অপূর্ণ থাকবে, সেটা চাননি জ্বালা।
পানিপুরি বিক্রির দিনগুলোতেই একদিন জ্বালা সিংহের নজরে পড়েন ছোট্ট জয়সাল। তাকে এনে নিজের বাড়িতে ছেলের মতো আগলে রাখেন জ্বালা। শেষ হয় জয়সালের লড়াইয়ের দিনগুলো, আজাদ ময়দানের তাঁবুতে কাটানো রাতগুলো। ঘুরে যায় জীবনের গতিপথ।
সেই পথ ঘুরতে ঘুরতে বয়সভিত্তিক দল, ঘরোয়া ক্রিকেট পেরিয়ে জয়সাল এসে দাঁড়িয়েছেন আইপিএলের মঞ্চে।
ব্যাট হাতে রেকর্ডের পর রেকর্ড গড়ে গেছেন। নামডাকও ছড়িয়ে পড়েছে। তবে মানসিকতা আছে সেই আগের মতোই। যেমনটা বলেন জ্বালা সিং, ‘ট্যালেন্ট সবার মধ্যেই থাকে। আসল বিষয় হচ্ছে মানসিকতা। আর মানসিকতাই তফাৎ গড়ে দিয়েছে।’
লড়াকু মানসিকতাই জয়সালকে বাকি সবার থেকে আলাদা করেছে। পেশীবহুল শরীর কিংবা পাওয়ারহিটিংয়ের উপাদান কোনোটিই তার মাঝে নেই। কিন্তু ক্রিকেটের শুদ্ধ ব্যাকরণের সাথে নিঁখুত টেকনিকটা আছে। এই দুইয়ে মিলেই ব্যাটিংয়ে রানের ফুলঝুরি ছোটাচ্ছেন ২৩ বছর বয়সী তরুণ।
আইপিএলের ষোলোতম আসরে ১৪ ম্যাচে ১৬৩ স্ট্রাইক রেটে, ৪৮ গড়ে, ৫ ফিফটি ও ১ সেঞ্চুরিতে ৬২৫ রান করে হয়েছেন সেরা উদীয়মান ক্রিকেটার। এবারের আসরে হাঁকিয়েছেন আইপিএলের ইতিহাসে দ্রুততম হাফ সেঞ্চুরিও।
তার সেঞ্চুরি আছে রঞ্জি ট্রফি, ইরানি কাপ, দুলিপ ট্রফি, বিজয় হাজারে ট্রফি, অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ ও ভারত ‘এ’ দলের হয়েও। ডাবল সেঞ্চুরি আছে অনূর্ধ্ব-১৬, অনূর্ধ্ব-১৯, অনূর্ধ্ব-২৩, ফার্স্ট ক্লাস ও লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে।
জয়সাল এখন তারকা। খুব শীঘ্রই হয়তো ভারত জাতীয় দলের তেরঙ্গা জার্সিও গায়ে জড়াবেন। ইতোমধ্যে টেস্ট দলে রিজার্ভ খেলোয়াড় হিসেবে ডাক পেয়েছেন। আইসিসি ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালের জন্য দলের সঙ্গে এখন ইংল্যান্ডে অবস্থান করছেন।
জয়সালের জীবনের মন্ত্র এখনো একটাই। যে মন্ত্রটা কানে গুঁজে দিয়েছিলেন জ্বালা সিং। শিষ্যকে তিনি বলেছিলেন, ‘যদি অন্যদের থেকে আলাদা হতে হয়, লোকে হাততালি দিলো কিনা, সেটা নিয়ে ভেবো না।’ যশস্বীও কখনো যশ-খ্যাতির কথা ভাবেননি।
আজাদ ময়দানের তাঁবুতে জ্বালা সিংয়ের সঙ্গে প্রথম দেখা। সেদিন অনেকটা আশা নিয়ে আকুলতার সবটা ঢেলে দিয়েছিলেন জয়সাল, ‘স্যার, আমি আর কোনো কিছু পারি না। শুধু ক্রিকেট খেলতে পারি। আমি আপনার সব কাজ করে দেবো। যা বলবেন সব করব, ঘর পরিষ্কার করব, জুতো পালিশও করে দেবো। শুধু ক্রিকেটটা খেলতে দেবেন।’
জয়সাল শুধু ক্রিকেটটাই খেলতে চেয়েছেন। ব্যাট-প্যাড আগলে একজীবন কাটাতে চেয়েছেন। ভাদোহির সেই কিশোর জিততে চেয়েছেন; জীবনের লড়াইয়ে, জীবিকার লড়াইয়ে, মাঠের লড়াইয়ে। লক্ষ্য, সাধনা, পরিশ্রম আর নিবেদনের মিশেলে জয়ীর নামটাও তাই যশস্বী জয়সাল।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।