পত্রিকায় পাতায় দেখেছেন হয়তো, ‘দেশজুড়ে চলছে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ’। এই ‘শৈত্যপ্রবাহ’ শব্দটা আমাদের বেশ পরিচিত, কিন্তু কেমন যেন দুর্বোধ্য। শৈত্যপ্রবাহ হলে শীত বাড়বে, তা আমরা জানি। কিন্তু জিনিসটা আসলে কী, কেন হয়—এসব প্রশ্নের উত্তর হয়তো অজানাই রয়ে গেছে। বিস্তারিত বলছি। তার আগে শীতকাল কেন আসে, তা একটু বলে নেওয়া যাক।
সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর একবার ঘুরে আসতে যে সময় লাগে, সে সময়টাকে এক বছর ধরা হয়। সূর্যের চারপাশে ঘোরার পাশাপাশি পৃথিবী নিজ অক্ষের ওপরেও ঘুরতে থাকে। নিজ অক্ষের ওপর এই ঘূর্ণনকে আমরা বলি, আহ্নিক গতি। এই আহ্নিক গতির কারণে দিন-রাতের পালাবদল ঘটে।
মজার বিষয় হলো, নিজ অক্ষের ওপর পৃথিবী স্থিতিশীল অবস্থায় ঘোরে না। এদিক-ওদিক হেলেদুলে ঘোরে। অনেকটা লাটিম ঘুরিয়ে দিলে পড়ে যাওয়ার আগমুহূর্তে যেভাবে দোলে, সেভাবে। ফলে সূর্য থেকে সব সময় পৃথিবীর সব জায়গায় আলো সমানভাবে পড়ে না। কোথাও সোজাভাবে পড়ে, কোথায় একটু বাঁকা বা তীর্যকভাবে পড়ে।
ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধ প্রায় ২৩.৫ ডিগ্রি কোণে হেলে থাকে সূর্যের বিপরীত দিকে। এ অঞ্চলে বছরের এ সময়টায় সরাসরি সূর্যের আলো পড়ে না। পৃথিবীর এই হেলানো অবস্থার কারণে এখানে দিনের দৈর্ঘ্য কমে যায়, বেড়ে যায় রাতের দৈর্ঘ্য। ফলে বছরের অন্য সময়ের তুলনায় এ সময় ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি থাকা বাতাস কম উত্তপ্ত হয়। শীতের চাদরে ঢাকা পড়ে উত্তর গোলার্ধে থাকা সব কটি দেশ।
ক্যালেন্ডারের হিসেবে সময়টা ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারির প্রথম অংশ। এ সময়ে শীতের তীব্রতা সবচেয়ে বেশি থাকে উত্তর মেরুর কাছাকাছি দেশগুলোতে। তাপমাত্রা নেমে যায় হিমাঙ্কের নিচে। দিন-রাত তুষারে ঢাকা থাকে ওসব দেশ। তবে বিষুবরেখার কাছাকাছি অবস্থিত অঞ্চলগুলোতে শীতের তীব্রতা কিছুটা কম থাকে।
কারণ, এখানে দিনের দৈর্ঘ্য তুলনামূলক বেশি থাকে মেরুর তুলনায়। শীতের তীব্রতা কম থাকায় এখানে তুষারপাত হয় না। তাই বলে এ অঞ্চলের শীতের আবহাওয়াকে নিরীহ ভাবার সুযোগ নেই। ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে সব মিলিয়ে প্রায় ৪ থেকে ৬ বার শৈত্যপ্রবাহ চলে। তীব্র শীতে তখন স্বাভাবিক কার্যকর্ম ব্যহত হয়।
শৈত্যপ্রবাহ শব্দটার মধ্যেই এর পরিচয় পাওয়া যায়। সংস্কৃত শব্দ ‘শৈত্য’ এর বাংলা আসলে শীত। আর প্রবাহ মানে বয়ে চলা। সেদিক থেকে শৈত্যপ্রবাহকে শীতের প্রবাহ বা বয়ে চলা শীতের স্রোত বলতে পারেন। আরেকটু ভালো করে বললে, ঠান্ডা বাতাসের প্রবাহের আরেক নাম শৈত্যপ্রবাহ।
তবে আবহাওয়াবিদেরা ‘শৈত্যপ্রবাহ’ বলতে আবহাওয়ার একটি বিশেষ অবস্থা নির্দেশ করেন। এর কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। সব ধরনের শীতল বাতাসের প্রবাহকে শৈত্যপ্রবাহ বলা যায় না। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওয়েদার সার্ভিস বলছে, ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে পরিবেশের তাপমাত্রা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমে ওই অঞ্চলের গড় সর্বনিম্ন অবস্থায় গেলে সেটাকে শৈত্যপ্রবাহ বলা যায়। অঞ্চলভেদে এই সর্বনিম্ন তাপমাত্রা কম-বেশি হয়।
ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামলে তাকে শৈত্যপ্রবাহ বলা হয়। এখানেও অবশ্য কিছু শর্ত আছে। ১০ ডিগ্রি বা তার নিচের তাপমাত্রা কমপক্ষে ৩দিন স্থায়ী হতে হবে। তিনদিনের কম হলে, তাপমাত্রা কমে গেলেও সেটাকে শৈত্যপ্রবাহ হিসেবে ধরা হয় না। অর্থাৎ শীতকালে তাপমাত্রা ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে ১০ ডিগ্রি বা তার নিচে নেমে গেলে সেটা যদি কমপক্ষে তিনদিন স্থায়ী হয়, তাহলেই একে শৈত্যপ্রবাহ বলা হবে।
শীতল বায়ু আসে দেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল দিয়ে। উত্তরে হিমালয় পর্বতমালা থেকে হিমেল বাতাসের উৎপত্তি। পৃথিবী ও চাঁদের অবিরাম ঘূর্ণনের কারণে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল কখনো স্থির থাকে না। পুরো পৃথিবীজুড়ে বিভিন্নভাবে চলে বায়ু প্রবাহ। বাতাস ছুটে বেড়ায় এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। এই বাতাসের স্রোতের সঙ্গে যখন হিমালয়ে ঠান্ডা বাতাস মিশে বাংলাদেশে প্রবেশ করে, তখনই শৈত্যপ্রবাহ হয়।
শৈত্যপ্রবাহকে মূলত চার ভাগে ভাগ করা হয়। তাপমাত্রা ৮ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে বলা হয় মৃদু শৈত্যপ্রবাহ, ৬থেকে ৮ ডিগ্রি হলে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ, ৪ থেকে ৬ ডিগ্রি হলে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ এবং এর নিচে নেমে গেলে সেটাকে অতি তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বলা হয়।
ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য (যেমন সমুদ্র থেকে দূরত্ব এবং উঁচু-নিচু জমি) শৈত্যপ্রবাহের তীব্রতাকে প্রভাবিত করে। দেশের উত্তরাঞ্চলের উঁচু জমি এবং হিমালয়ের নিকটবর্তী এলাকাগুলো সাধারণত তীব্র শৈত্যপ্রবাহের কবলে পড়ে। অন্যদিকে, দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকাগুলিতে তাপমাত্রার হ্রাস তুলনামূলক কম।
শৈত্যপ্রবাহের সময় মানুষের জীবনযাত্রা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়। বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠী পর্যাপ্ত শীতবস্ত্রের অভাবে তীব্র কষ্টে থাকেন এ সময়। ফলে হাইপোথার্মিয়া এবং শ্বাসযন্ত্রজনিত রোগের প্রকোপ বেড়ে যায় এ সময়। কৃষিক্ষেত্রে শৈত্যপ্রবাহের প্রভাব পড়ে। শৈত্যপ্রবাহের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে আলু, সরিষা এবং গমের মতো শীতকালীন ফসল। এ ছাড়া যোগাযোগব্যবস্থা, বিশেষ করে সড়ক, নৌ ও বিমানপথে যাতায়াত কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয় ঘন কুয়াশার কারণে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।