ফারুক তাহের, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম বন্দরে বহির্নোঙর থেকে পণ্য খালাস ও পরিবহনে ব্যবহৃত লাইটারেজ জাহাজের ভাড়া দিন দিন কমে যাচ্ছে। ভাড়ার অভাবে প্রতিদিন প্রায় চারশতাধিক জাহাজ অলস বসে থাকে।
প্রতিমাসে একটি করে ভাড়া পাওয়ার কথা থাকলেও কোনো কোনো জাহাজ দুই মাসেও ভাড়া পায় না। ফলে দৈনন্দিন যে খরচ রয়েছে একটি জাহাজের পেছনে, তা নির্বাহ করতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে জাহাজ মালিকদের। অনেকেই স্ক্র্যাপ হিসেবে বিক্রি করে দিচ্ছেন লাইটার জাহাজ এমনও তথ্য পাওয়া গেছে।
ডব্লিউটিসির (ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল) প্রধান নির্বাহী মাহবুব খান জুমবাংলাকে বলেন, ‘বেশ কয়েক মাস ধরে প্রতিদিন প্রায় চার’শ লাইটারেজ জাহাজ বন্দরে অলস বসে থাকে। এগুলোর মধ্যে প্রায় দুই মাস ধরে নোঙর করে আছে এমন জাহাজও রয়েছে। অর্থাৎ আগে যেখানে এসব জাহাজ প্রতি মাসে এক বা একাধিক ট্রিপ পেত, এখন সেখানে দুই মাসেও নিয়মিত ট্রিপ মিলছে না।’
কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, ‘ডব্লিউটিসির নিয়মের বাইরে গিয়ে প্রায় ২০০ লাইটার জাহাজ সরাসরি লাইটারিং করছে। বড় বড় শিল্প গ্রুপগুলো তাদের নিজস্ব পণ্য পরিবহনের জন্য নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় লাইটারেজ জাহাজ চালু করেছে। ফলে বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত লাইটারেজ জাহাজের চাহিদা কমে গেছে। এতে ভাড়া কমে যাওয়ায় জাহাজ মালিকদের লোকসান দিতে হচ্ছে। ডব্লিউটিসির অন্তরর্ভূক্ত জাহাজগুলোর জন্য বার্থিং সভা হয় এবং লাইটারিংয়ের চাহিদা অনুসারে জাহাজ ভাড়ার সিরিয়াল বরাদ্দ দেওয়া হয়।’
লাইটারেজ জাহাজমালিক শফিক আহমেদ বলেন, ‘শিল্প গ্রুপগুলো যদি তাদের আমদানি করা ৫০ শতাংশ পণ্য আমাদের জাহাজে পরিবহন করে, তাহলে আমরা লোকসান কাটিয়ে উঠতে পারব। একটি জাহাজ একবার ডকে (মেরামত) তুললে ৬০ থেকে ৮০ লাখ টাকা খরচ হচ্ছে। তিন বছর পর পর ডকে তুলতে হয়। জাহাজ চলাচল ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বেড়ে গেছে। এতে অনেকেই জাহাজ বিক্রি করে দিয়েছে। অসাধু গুটিকয়েক জাহাজমালিক নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে কম ভাড়ায় পণ্য পরিবহনে আমরা আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।’
জাহাজ মালিকদের সূত্রে জানা গেছে, জাহাজ রক্ষণাবেক্ষণ খরচও বেড়ে গেছে। একটি লাইটার জাহাজ ১ হাজার টন থেকে আড়াই হাজার টনের মতো পণ্য পরিবহন করে। চট্টগ্রাম থেকে নারায়ণগঞ্জে পণ্য নিয়ে একবার যাতায়াত করতে প্রায় ৩ হাজার ২০০ লিটার জ্বালানি তেলের প্রয়োজন হয়।
এর বাইরে প্রাায় ১৮ হাজার টাকা খরচ পড়ে। সরকারিভাবে নির্ধারিত হারের বেশি ভাড়া আদায় করা যায় না। ফলে এক দিকে ভাড়া কম ও নির্ধারিত দরে পরিবহন ভাড়ায় এই ব্যবসায় লোকসান বেড়ে গেছে। বর্তমানে ১ হাজার টনের একটি নতুন জাহাজ তৈরিতে ৪-৫ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে।
এখন জাহাজ দেশে তৈরি হচ্ছে। জাহাজ নির্মাণের খরচ মেটাতে ব্যাংক ঋণ নেন মালিকরা। কিন্তু ব্যাংক ঋণের সুদের হার বেড়ে গেছে। আয় কমে যাওয়ায় জাহাজ মালিকরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ব্যাংক ঋণও পরিশোধ করতে পারছেন না। লোকসানের কারণে ইতিমধ্যে অনেক লাইটারেজ জাহাজ কেটে স্ক্র্যাপ হিসেবে বিক্রি করে দিয়েছেন।
চট্টগ্রামে লাইটারেজ জাহাজ মালিকদের সংগঠন ডব্লিউটিসির মাধ্যমে দৈনিক জাহাজের সিরিয়াল দেওয়া হয়। সংগঠনের আওতায় একসময় দেড় হাজারের বেশি জাহাজ থাকলেও বর্তমানে রয়েছে বারশ’ এর মতো। মাদার ভেসেলে বিদেশ থেকে আনা পণ্য বহির্নোঙরে খালাসের পর ছোট আকারের লাইটারেজ জাহাজে করে দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছানো হয়। কিন্তু সিরিয়ালে থাকা জাহাজ অনুপাতে ভাড়া নেই। পণ্য আমদানি কমে যাওয়ায় বর্তমানে দৈনিক ৫০ থেকে ৬০টির মতো জাহাজ চলাচল করছে। সিরিয়ালের জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়।
বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পরিচালিত জাহাজ চলাচলে জাহাজমালিকদের মধ্যে বিরোধও রয়েছে। ওয়াটার সেলভুক্ত জাহাজগুলো সরকারনির্ধারিত হারে ভাড়ায় নিয়ে পণ্য পরিবহন করে। কিন্তু ওয়াটার সেলের বাইরেও প্রায় ৫০-৬০ লাইটারেজ জাহাজ পণ্য পরিবহন করছে। ওয়াটার সেলভুক্ত জাহাজমালিকদের অভিযোগ সমিতির বাইরে থাকা এসব জাহাজ কম রেটে পণ্য পরিবহন করছে। কম রেটের কারণে কিছু আমদানিকারক এসব জাহাজে পণ্য পরিবহন করছে। এর ফলে সমিতিভুক্ত জাহাজের চাহিদা কমে গেছে।
বাংলাদেশ কার্গো ভ্যাসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব নুরুল হক বলেন, ‘বিদেশ থেকে আনা পণ্যের একটি বৃহদাংশ আমদানি করে কয়েকটি শিল্প গ্রুপ। এখন তারা নিজেরাই পণ্য পরিবহনের জন্য ৪০-৫০ টনের সক্ষমতার জাহাজ ও ট্রাক কিনেছে। পণ্য কম আমদানি হচ্ছে, তা নয়। তাদের জাহাজে ও ট্রাকে পণ্য পরিবহন হচ্ছে। এদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কিছু অসাধু জাহাজ মালিক। তারা কম রেটে পণ্য পরিবহন করছে। আমাদের জাহাজের ভাড়া কমে গেছে। ক্রমাগত লোকসানের কারণে অনেকেই জাহাজ কেটে ফেলেছে। শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন দিতে পারছি না।
ডব্লিউটিসি সূত্রে জানা গেছে, বন্দর ও বহির্নোঙর থেকে বছরে প্রায় চার কোটি টন পণ্য পরিবহন করে লাইটার জাহাজগুলো। বহির্নোঙর থেকে কর্ণফুলীর ১৬টি ঘাট এবং ঢাকা, মিরপুর, নগরবাড়ী, বাঘাবাড়ী, নোয়াপাড়া, খুলনা, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এসব জাহাজ পণ্য পরিবহন করে। সিইউএফএল ও কাফকোর উৎপাদিত সারও পরিবাহিত হয় লাইটার জাহাজে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।