আর্থিক জটিলতা কমাতে এবং করদাতাদের জন্য বিনিয়োগের পথ সহজ করতে এবার সরকার নতুন একটি পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে যা সাধারণ জনগণের জন্য অনেকটা স্বস্তির বিষয় হতে পারে। আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে এমন একটি প্রস্তাবনা রাখা হচ্ছে যার ফলে সঞ্চয়পত্র কেনার ক্ষেত্রে রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা আর থাকছে না। এই পরিবর্তনটি মূলত আয়কর রিটার্নের প্রমাণপত্র দাখিল সংক্রান্ত জনদুর্ভোগ কমানোর উদ্দেশ্যে নেওয়া হচ্ছে।
রিটার্ন দাখিল সংক্রান্ত পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট
রিটার্ন দাখিল বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সেবাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক ছিল। বিশেষ করে পাঁচ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কেনা, ১০ লাখ টাকার মেয়াদি আমানত খোলা, এবং বিভিন্ন পেশাজীবী সদস্যপদ গ্রহণের ক্ষেত্রে পিএসআর (প্রমাণপত্র) দাখিল করা ছাড়া উপায় ছিল না। এই নিয়মের ফলে বহু মানুষ শূন্য রিটার্ন জমা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন, যা কার্যত কোনো কর আদানে সহায়ক ছিল না বরং ছিল প্রশাসনিক চাপ ও সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের উৎস।
Table of Contents
উল্লেখযোগ্য যে, ২০২৩ সালের আয়কর আইনে পিএসআর দাখিল সংক্রান্ত নির্দেশনা আরও কঠোর করা হয়েছিল এবং এর সত্যতা যাচাই না করলে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রাখা হয়। ফলে করদাতারা বাধ্য হয়েই এই কাঠামোর মধ্যে আসেন। কিন্তু এর ফলে প্রকৃত করদাতা সংখ্যা বাড়েনি, বরং রিটার্ন দাখিলের হার কৃত্রিমভাবে বেড়ে গিয়েছে।
সঞ্চয়পত্র কেনার ক্ষেত্রে নতুন সুযোগ এবং এর সম্ভাব্য প্রভাব
এই নতুন নীতিমালায় পাঁচ লাখ টাকা বা তার বেশি মূল্যের সঞ্চয়পত্র কেনার সময় আর রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র জমা দিতে হবে না, যা বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি বড় সুযোগ। এর ফলে অনেকে যারা কেবলমাত্র এই জটিলতার কারণে সঞ্চয়পত্র কিনতেন না, তারা এখন সহজেই বিনিয়োগ করতে পারবেন। একইসঙ্গে এটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ পরিবেশকে উন্নত করতে সহায়ক হবে।
এছাড়া, ১০ লাখ টাকা বা তার বেশি মেয়াদি আমানত খোলার ক্ষেত্রেও একইভাবে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণের প্রয়োজন থাকবে না। চিকিৎসক, আইনজীবী, হিসাববিদ, ইঞ্জিনিয়ার, স্থপতি, সার্ভেয়ারসহ বিভিন্ন পেশাজীবীদের পেশাজীবী সংগঠনের সদস্যপদ পেতেও রিটার্ন জমা বাধ্যতামূলক নয় বলে জানানো হয়েছে। তবে টিআইএন (ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর) থাকতে হবে।
বর্তমানে যেসব ক্ষেত্রে রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক
চলমান বাধ্যবাধকতা সমূহ:
- ২০ লাখ টাকার বেশি ঋণ নেওয়া
- কোম্পানি পরিচালকের পদ পাওয়া
- ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ ও নবায়ন
- ১০ লাখ টাকার বেশি জমি বা ফ্ল্যাট নিবন্ধন
- পেশাজীবী সংগঠনের সদস্যপদ
- মোটরযান নিবন্ধন ও ফিটনেস
- বিদ্যুৎ, গ্যাস সংযোগ
- নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া
এই বাধ্যবাধকতাগুলোর কারণেই অনেকে অপ্রয়োজনীয়ভাবে করদাতার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। কিন্তু এখন এনবিআর এসব নীতির পুনর্বিবেচনা করছে জনস্বার্থে।
জনস্বার্থে কর নীতি পরিবর্তনের দৃষ্টিভঙ্গি
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, তারা ধীরে ধীরে সেইসব ক্ষেত্রে রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা তুলে নিতে চাইছেন যেগুলোতে আদতে পিএসআর প্রয়োজনীয় নয়। তিনি বলেন, “আমরা চাই জনবান্ধব করনীতি গড়ে তুলতে, যাতে নাগরিকেরা প্রয়োজনীয় সেবা সহজেই পেতে পারেন।”
এধরনের নীতিমালা বাস্তবায়ন হলে রিটার্ন দাখিলের অপ্রয়োজনীয় চাপ থেকে মুক্তি পাবেন সাধারণ মানুষ, বিশেষত মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিনিয়োগকারীরা। এটি তাদের মধ্যে কর সচেতনতা বাড়াতেও সাহায্য করতে পারে।
বিশ্ববাজার ও দেশের অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ সম্পর্ক
দেশের অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ বাড়ানো, বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করার জন্য এই ধরনের নীতিমালা অত্যন্ত কার্যকর। এই পরিবর্তনের ফলে বিনিয়োগে মানুষের আগ্রহ বাড়বে, যা জাতীয় অর্থনীতিকে গতিশীল করতে পারে। বিশ্ববাজারের প্রভাব এবং স্থানীয় আর্থিক পরিবেশ—এই দুইয়ের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য জনবান্ধব করনীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এছাড়াও, রিটার্ন দাখিল ছাড়াই সঞ্চয়পত্র কেনার সুবিধা নাগরিকদের মধ্যে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণ (Financial Inclusion) বৃদ্ধি করতে পারে। এটি আর্থিক খাতের বিস্তৃতিতে বড় ভূমিকা রাখবে।
যদিও এই নীতির চূড়ান্ত বাস্তবায়ন বাজেট পাসের ওপর নির্ভর করবে, তবুও ইতোমধ্যেই এটি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে।
এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে, রিটার্ন দাখিল ছাড়াই সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ এখন সাধারণ মানুষের জন্য অনেক সহজ ও স্বস্তিদায়ক হবে।
FAQs: রিটার্ন দাখিল সংক্রান্ত সাধারণ জিজ্ঞাসা
১. সঞ্চয়পত্র কিনতে রিটার্ন দাখিল করা কি এখন বাধ্যতামূলক?
না, আগামী বাজেট অনুযায়ী ৫ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কেনার সময় রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক থাকছে না।
২. টিআইএন ছাড়া কি সঞ্চয়পত্র কেনা যাবে?
না, রিটার্ন দাখিল না করলেও টিআইএন থাকা বাধ্যতামূলক হবে।
৩. এই পরিবর্তন কবে থেকে কার্যকর হবে?
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট পাস হলে এটি কার্যকর হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
৪. পেশাজীবী সংগঠনে সদস্যপদ পেতে কি এখন রিটার্ন লাগবে?
না, রিটার্ন নয়; শুধুমাত্র টিআইএন থাকলেই চলবে।
৫. মেয়াদি আমানতের ক্ষেত্রে রিটার্ন দাখিল লাগবে?
না, ১০ লাখ টাকার বেশি মেয়াদি আমানত খুলতেও রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ প্রয়োজন হবে না।
৬. এর ফলে করদাতার সংখ্যা কি কমে যাবে?
না, বরং প্রকৃত করদাতারা তালিকাভুক্ত হবেন এবং শূন্য রিটার্নের প্রবণতা কমে যাবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।