আকাশে লাল সূর্য ডুবে যাচ্ছে। রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে ইফতারের খাবারের সুবাস। অথচ সদ্য বিবাহিত জাহিদের চোখে অশ্রুর রেখা। স্ত্রীর সঙ্গে তুচ্ছ কারণে তর্কে জড়িয়ে এখন নীরবতার দেয়াল। এমন অসংখ্য দাম্পত্য সম্পর্ক প্রতিদিন ভেঙে পড়ছে অমীমাংসিত দ্বন্দ্বে। কিন্তু ইসলাম কি শুধু বিবাহবন্ধনের বিধান দেয়? নাকি দিয়েছে সফল দাম্পত্যের মূলমন্ত্র? কুরআন-হাদিসের পাতায় পাতায় লুকিয়ে আছে দাম্পত্য সুখের সেই অমূল্য রত্নভাণ্ডার।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS) ২০২৩ রিপোর্টে চাঞ্চল্যকর তথ্য: ঢাকায় প্রতি ১০০টি বিবাহবিচ্ছেদের ৪৭টির কারণ “আন্তঃব্যক্তিক দ্বন্দ্ব ও যোগাযোগের অভাব”। অথচ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গবেষণায় দেখা যায়, যেসব দম্পতি নবি (সা.)-এর সুন্নাহ মেনে দাম্পত্য জীবন পরিচালনা করেন, তাদের বিবাহবিচ্ছেদের হার মাত্র ১২%। পার্থক্যটা তৈরি হয় মূলনীতির অনুসরণে।
সফল দাম্পত্যের মূলমন্ত্র: যে ৩ ভিত্তিতে গড়ে উঠবে সুখের সংসার
ইসলামে দাম্পত্য সম্পর্ক শুধু শারীরিক চাহিদা পূরণের মাধ্যম নয়, বরং এটি আল্লাহর বিশেষ নেয়ামত। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে:
“আর তাঁর নিদর্শনসমূহের মধ্যে অন্যতম নিদর্শন হলো, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে সৃষ্টি করেছেন স্ত্রী, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তি পাও এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন।” (সুরা আর-রুম, আয়াত ২১)
মূলনীতি ১: মীসাকান গালীজা – পবিত্র অঙ্গীকারের বন্ধন
ইসলামি শরিয়তে বিবাহকে “মীসাকান গালীজা” বা মজবুত অঙ্গীকার বলা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. ফরিদ আহমেদের মতে:
“বাংলাদেশে ৬৮% দম্পতি বিবাহের সময় কাবিননামায় স্বাক্ষর করলেও এর আধ্যাত্মিক তাৎপর্য বোঝেন না। অথচ এই অঙ্গীকারই হচ্ছে সফল দাম্পত্যের মূলমন্ত্রের প্রথম সোপান।”
মূলনীতি ২: তাওয়াক্কুল আলাল্লাহ – আল্লাহর উপর ভরসা
রাসূল (সা.) বলেছেন:
“তোমরা বিবাহ করো, কারণ আমি কিয়ামতের দিন তোমাদের সংখ্যাধিক্য নিয়ে গর্ব করব।” (ইবনে মাজাহ)
দাম্পত্য জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্তে আল্লাহর সাহায্য কামনা করা সাফল্যের চাবিকাঠি।
মূলনীতি ৩: আদল ও ইহসান – ন্যায়বিচার ও সদাচার
স্ত্রীর প্রতি স্বামীর কর্তব্য সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেছেন:
“তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি সর্বোত্তম যে তার স্ত্রীর নিকট সর্বোত্তম।” (তিরমিজি)
একইভাবে স্ত্রীর কর্তব্য সম্পর্কে হাদিসে এসেছে:
“যদি আমি কাউকে অন্য কারো জন্য সিজদা করার আদেশ দিতাম, তবে স্ত্রীকে আদেশ দিতাম তার স্বামীকে সিজদা করতে।” (তিরমিজি)
দাম্পত্য জীবনে ইসলামিক অনুশাসনের ৭টি বাস্তব প্রয়োগ
৩.১. যোগাযোগের কুরআনি পদ্ধতি: শুনুন মন খুলে, বলুন মধুর ভাষায়
মদিনার এক যুবক রাসূল (সা.)-এর কাছে অভিযোগ করলেন, “আমার স্ত্রী আমার সঙ্গে রুক্ষ আচরণ করে।” নবিজি তাকে ডেকে পাঠালেন স্ত্রীকে। জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কি জানো তোমার স্বামীর জান্নাত-জাহান্নাম তোমার হাতে?” স্ত্রী বিস্মিত হয়ে বললেন, “কিভাবে?” রাসূল (সা.) বললেন: “তুমি যদি তার সন্তুষ্টিতে জীবন কাটাও তবে সে জান্নাতে যাবে। আর যদি অসন্তুষ্ট রাখ তবে জাহান্নামে যাবে।” (বায়হাকি)
বাস্তব টিপস:
- রাগের মুহূর্তে “আউজুবিল্লাহ” পড়ে ১০ সেকেন্ড নীরব থাকুন
- “আমি” ভাষায় কথা বলুন: “আমি কষ্ট পাই যখন…” (বদলে “তুমি আমাকে কষ্ট দাও”)
- সপ্তাহে একবার “দাম্পত্য মজলিস” করুন: নির্দিষ্ট সময়ে একে অপরের অনুভূতি শুনুন
৩.২. আর্থিক ব্যবস্থাপনায় সুন্নাহর আদল
রাজশাহীর এক দম্পতির গল্প: স্বামী ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় স্ত্রী তার গহনা বিক্রি করে দেন। স্বামী জিজ্ঞাসা করলে বলেন, “আপনার ঋণ তো আমারও ঋণ।” এটাই ইসলামের শিক্ষা – সম্পদে অংশীদারিত্ব।
অর্থব্যবস্থার সুন্নাহ মডেল: | বিষয় | স্বামীর দায়িত্ব | স্ত্রীর দায়িত্ব |
---|---|---|---|
আয় উপার্জন | পরিবারের প্রধান রিজিকদাতা | পারিবারিক সিদ্ধান্তে অংশগ্রহণ | |
ব্যয় ব্যবস্থাপনা | অপ্রয়োজনীয় ব্যয় এড়ানো | সংসারের বাজেটে সততা | |
সঞ্চয় | স্ত্রীর জন্য পৃথক সঞ্চয় | জরুরি তহবিল গঠন |
৩.৩. শারীরিক সম্পর্কে ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গি: শুধু চাহিদা নয়, ইবাদত
রাসূল (সা.) বলেছেন:
“তোমাদের স্ত্রীদের সঙ্গে সহবাস করাও সদকা।” সাহাবিরা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাদের কামভাব পূরণ করাও কি সওয়াবের কাজ?” তিনি বললেন: “তোমরা যদি হারাম পথে তা চরিতার্থ করো, তা কি গুনাহের কাজ হবে? তেমনিভাবে হালাল পথে করলে সওয়াবের কাজ হবে।” (মুসলিম)
সুন্নাহর নির্দেশনা:
- সহবাসের আগে দোয়া পড়া: “বিসমিল্লাহ, আল্লাহুম্মা জান্নিবনাশ শাইতান…”
- স্ত্রীর ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেওয়া
- শারীরিক সৌন্দর্য রক্ষায় যত্নবান হওয়া
দাম্পত্য সংকটে ইসলামিক সমাধান কৌশল
৪.১. শ্বশুরবাড়ি-স্বামীর সংঘাত: রাসূল (সা.)-এর মধ্যস্থতা মডেল
হজরত আলী (রা.) ও ফাতিমা (রা.)-এর মধ্যে বিবাদের সময় রাসূল (সা.) উভয়কে ডেকে বললেন:
“স্মরণ করো, আমি তোমাদের উভয়ের পিতা। তোমরা উভয়ে কি আমার আনুগত্য করবে না?” উভয়ে সম্মত হলে তিনি বললেন: “তাহলে পরস্পরকে ক্ষমা করো।” (বুখারি)
আধুনিক প্রয়োগ:
- পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের মধ্যস্থতাকারী নিযুক্ত করুন
- মাসে একদিন “শ্বশুরবাড়ি দিবস” রাখুন
- স্বামী-স্ত্রীর আলোচনায় তৃতীয় পক্ষকে অনুমতি দেবেন না
৪.২. সন্তান লালন-পালনে যুগল দায়িত্ব
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ২০২৪ সমীক্ষা: যে পরিবারে বাবা সন্তানদের নামাজে নিয়ে যান, সেই শিশুদের শিক্ষাগত সাফল্যের হার ৪১% বেশি।
সুন্নাহর রূপরেখা:
- জন্মের সময় কানে আজান দেওয়া
- ৭ বছর বয়সে নামাজ শিক্ষা
- কিশোর বয়সে পৃথক ঘরের ব্যবস্থা
- বিবাহযোগ্য বয়সে দ্রুত বিবাহের উদ্যোগ
“সফল দাম্পত্যের মূলমন্ত্র কোন জটিল তত্ত্ব নয়, বরং রাসূল (সা.)-এর জীবনই তার প্রায়োগিক রূপ। যখন দেখবেন দাম্পত্য জাহাজ ঢেউয়ে টলমল করছে, মনে করবেন সেই নৌকার মাঝি স্বয়ং আল্লাহ। তিনিই বলেছেন: ‘আর সবর ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো।’ (সুরা বাকারা, আয়াত ৪৫)। আজই শুরু করুন ছোট্ট একটি সুন্নাহ অনুশীলন – স্ত্রীর চায়ের কাপে এক চামচ চিনি বাড়িয়ে দিন, স্বামীর কাজের ফোল্ডারে রেখে দিন প্রেমের চিরকুট। এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টাই তৈরি করবে অনন্ত সুখের সোপান।”
জেনে রাখুন
প্রশ্ন: ইসলামে স্ত্রীর আর্থিক অধিকার কী?
ইসলামি আইনে স্ত্রীর নিজস্ব সম্পদের পূর্ণ মালিকানা থাকে। স্বামীর দেওয়া মহরানা, উপহার বা স্ত্রীর নিজস্ব আয়ে স্বামীর কোন অধিকার নেই। এমনকি স্বামী স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া তার সম্পদ ব্যবহার করতে পারেন না (ফাতাওয়া আলমগীরি, খণ্ড ৩)।
প্রশ্ন: স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মতবিরোধ হলে ইসলামিক সমাধান কী?
প্রথমে সরাসরি আলোচনা, তারপর পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের মধ্যস্থতা। তাতেও সমাধান না হলে স্থানীয় ইমাম বা ইসলামিক স্কলারদের পরামর্শ নেওয়া যায়। কুরআনে এ সম্পর্কে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে (সুরা আন-নিসা, আয়াত ৩৫)।
প্রশ্ন: দাম্পত্য জীবনে রাসূল (সা.)-এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ কী ছিল?
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত হাদিসে রাসূল (সা.) বলেছেন: “ঈমানদারদের মধ্যে পরিপূর্ণ ঈমান তার, যার চরিত্র সবচেয়ে উত্তম। আর তোমাদের মধ্যে সেই সর্বোত্তম যে তার স্ত্রীর প্রতি সর্বোত্তম আচরণ করে।” (তিরমিজি, হাদিস নং ১১৬২)।
প্রশ্ন: ইসলামিক দাম্পত্য জীবনে শারীরিক সম্পর্কের সীমারেখা কী?
ইসলামে দাম্পত্য সম্পর্ক পবিত্র ও প্রশংসনীয়। তবে কোন অবস্থাতেই এটি যৌন নির্যাতন, জবরদস্তি বা অসম্মতিতে হতে পারে না। স্ত্রীর শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতির বিষয়টি বিবেচনা করা ফরজ (আল-মুগনি, ইবনে কুদামা)।
প্রশ্ন: সফল দাম্পত্যের জন্য দৈনিক কী আমল করা উচিত?
১. যুগলভাবে ফজর নামাজ পড়া
২. সকালে একে অপরের জন্য দোয়া করা
৩. রাতে ঘুমানোর আগে পারস্পরিক ত্রুটি মাফ চাওয়া
৪. সপ্তাহে একদিন যৌথভাবে কুরআন তিলাওয়াত
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।