আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বমতে, মহাকর্ষ শুধু স্থানই নয়, সময়ও বাঁকিয়ে দেয়। কৃষ্ণগহ্বরের অতি শক্তিশালী মহাকর্ষও তাই সময়কে চরমভাবে বাঁকিয়ে দেবে। আপেক্ষিকতা তত্ত্ব আরও বলে, অতি উচ্চগতি সময়কে ধীর করে দেয়। একইভাবে দানবীয় ভরের কোনো বস্তুও (যেমন কৃষ্ণগহ্বর) সময়কে ধীরগতির করে দিতে পারে। কাজেই আপনি কৃষ্ণগহ্বরের অনেক কাছে চলে গেলে আপনার বন্ধুরা দেখতে পাবেন যে আপনার সময় ধীরে বইছে। তাঁদের মনে হবে, আপনি খুবই খুবই ধীরগতিতে চলছেন। কৃষ্ণগহ্বরের যত কাছে যেতে থাকবেন, আপনার বন্ধুরা আপনাকে তত ধীরগতিতে চলতে দেখবেন।
আবার এদিকে কৃষ্ণগহ্বরের যত কাছে যাবেন, বন্ধুদের কাছে আপনার ঘড়ির সময়ও তত ধীরে চলতে থাকবে। তাঁদের চোখে, একসময় আপনার ঘড়ির সময় এতই ধীরে বইবে যে তাঁদের মনে হবে, আপনি বোধ হয় সময়ের ভেতর জমে গেছেন। আসলে বাইরের বিশ্বের চোখে আপনি চিরকাল ওভাবেই ঝুলে থাকবেন। বাইরের কেউই আপনাকে কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে কখনোই পড়তে দেখতে পাবে না। কারণ, বাইরের চোখে, আপনার জন্য সময় জমে যাবে এবং আপনার ছবিখানা কৃষ্ণগহ্বরের পৃষ্ঠতলে ছড়িয়ে পড়বে এবং সেখানেই খোদাই হয়ে থাকবে চিরকাল। কৃষ্ণগহ্বরের ভেতর আপনার পুরোপুরি পড়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখার জন্য বাইরের কোনো পর্যবেক্ষককে অসীম সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করে বসে থাকতে হবে।
এই বন্ধুরা নিঃসন্দেহে আপনার বেশ ঘনিষ্ঠ আর সেরা। কিন্তু তাঁদেরও নিজস্ব জীবন আছে। বাকি জীবনটা তাঁদেরও বেঁচে থাকতে হবে। আপনার ফিরে আসার আশা বাদ দিয়ে সেখান থেকে একসময় তাঁরা চলে যাবেন, সেটাই স্বাভাবিক। যাওয়ার আগে যদি স্মৃতি হিসেবে আপনার শেষ ছবিটা তুলতে চান, তাহলে সেখানে আপনাকে অস্পষ্ট আর লালচে দেখা যাবে। কারণ, কৃষ্ণগহ্বরের মহাকর্ষ সেখানকার ফোটনের তরঙ্গদৈর্ঘ্যগুলো প্রসারণের মাধ্যমে রূপান্তরিত করবে অবলোহিত আলোয়। কাজেই বুঝতেই পারছেন, বন্ধুদের চমকে দিতে যদি নাটকীয়ভাবে কৃষ্ণগহ্বরে ঝাঁপ দেন, তাহলে খুব একটা লাভ নেই।
ওদিকে কৃষ্ণগহ্বরের ভেতর আপনার আসলে কী ঘটছে? বন্ধুদের চোখে আপনি সময়ের ভেতর জমে যাওয়া মানুষ হলেও বাস্তবে কিন্তু ঘটছে উল্টো ঘটনা। তখন আপনি এগিয়ে যাচ্ছেন কৃষ্ণগহ্বরের কেন্দ্র বরাবর। যেন চরম বন্য গতির কোনো রোলার কোস্টারের যাত্রী। মনে রাখতে হবে, সময় আপনার জন্য তখনো স্বাভাবিক গতিতে বয়ে যাচ্ছে। কাজেই আপনার দৃষ্টিভঙ্গিতে কৃষ্ণগহ্বরমুখী যাত্রাটা বেশ স্বাভাবিক গতিতে ঘটছে বলে মনে হবে। আপনি ক্রমে কেন্দ্রের দিকে এগিয়ে গেলেও বাইরের মহাবিশ্ব ভাববে, সেটা কখনো ঘটেনি। তাই ঘটনা দিগন্ত পেরিয়ে গেলে কী ঘটে, পদার্থবিদেরাও এ সম্পর্কে খুব বেশি জানেন না। তাঁদের বিশ্বাস, খুব বেশি ঘটনা এখানে ঘটে না।
চূড়ান্ত সীমা পেরিয়ে যাওয়ার পর বাইরের মহাবিশ্বের দৃশ্য সংকুচিত হতে হতে একটি ক্ষুদ্র থেকে আরও ক্ষুদ্র একটি বিন্দুতে এসে পৌঁছাবে। এরপর পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে যাবে আপনার চারপাশের সবকিছু। তখন একমাত্র যে আলোর উৎস দেখা যাবে, সেটি হলো, গোটা মহাবিশ্বের দৃশ্যের ওই অতি ক্ষুদ্র বিন্দু। অন্তত কিছু একটা তো আছে। তাত্ত্বিকভাবে, ঘটনা দিগন্তে আসলে কিছুই নেই। সেখানে কোনো বেড়া বা দেয়াল বা কোনো বলক্ষেত্র বা কোনো মহাজাতিক সিকিউরিটি গার্ডসহ কোনো গেট—কিছুই নেই। এটা এমন একটি জায়গা, যেখান থেকে আর ফেরা যায় না। এটাই সেই না ফেরার দেশের শুরু।
কৃষ্ণগহ্বরের ভেতর স্থান এতই বেঁকে যায় যে সেখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কোনো পথ থাকে না। আপনি যত জোরেই যাওয়ার চেষ্টা করুন না কেন, স্থান-কাল সেখানে একমুখী। কৃষ্ণগহ্বরের বাইরে সময় একমুখী (মানে সামনের দিকে চলে)। কিন্তু ঘটনা দিগন্তের ভেতরে স্থানও একমুখী (শুধু ভেতরের দিকে যাওয়া যায়)। কৃষ্ণগহ্বরের ভেতর সবকিছুই তার গভীরে টানছে।
এই সময় যদি বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার জোর চেষ্টা চালান, তাহলে সেটা কেন্দ্রে যাওয়াটাকেই আরও ত্বরান্বিত করবে। কাজেই সে চেষ্টা বাদ দেওয়াই ভালো। তার চেয়ে কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরটা কেমন, তা চোখ বুলিয়ে দেখে নিতে পারেন। কারণ, বিজ্ঞানীরা এখনো এ সম্পর্কে কিছুই জানেন না। অবশ্য সে চেষ্টা করেও খুব বেশি লাভ নেই। কারণ, সেখানে তো আলোর কোনো উৎসও নেই। দ্বিতীয়ত, কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরটা সম্পর্কে আপনি যদি মহান কোনো আবিষ্কার করেও ফেলেন, তারপরও সেটা আপনার স্বজাতিকে কখনো বোধ হয় জানাতে পারবেন না।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।