জুমবাংলা ডেস্ক : বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারপার্সন এবং সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী জহিরুল ইসলাম খান পান্নার (জেড আই খান পান্না) বিরুদ্ধে দায়ের করা হত্যাচেষ্টা মামলা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার পর সোমবার তিনি ঐ মামলায় আগাম জামিন পেয়েছেন।
“মামলাটি প্রভাবশালী কেউ করিয়েছিলো। সরকারের ভেতর থেকেও হতে পারে, আবার বাইরে থেকেও হতে পারে। দুর্নীতিবাজ অনেকের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি, তাদের কেউও হতে পারে। কিন্তু এসব করে আমার মুখ বন্ধ করা যাবে না,” জামিন পাওয়ার পর বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন।
উচ্চ আদালতে মি. পান্নার জামিন পাওয়ার কিছুক্ষণ পরই খবর আসে যে, ওই মামলার বাদী মো. বাকের মামলার এজাহার থেকে মি. পান্নার নাম বাদ দিতে আবেদন করেছেন। আবেদনে বলা হয়েছে তাকে ‘অজ্ঞতা ও ভুলবশত আসামি করা হয়েছে’।
খিলগাঁও থানায় সতেরই অক্টোবর দায়ের করা ওই মামলায় তার বিরুদ্ধে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় গত উনিশে জুলাই আহাদুল ইসলামকে গুলি ও মারধর করে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ করা হয়।
বাদী মো. বাকের পরে গত কয়েকদিনে একাধিক সংবাদ মাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছেন, মামলায় কাদের আসামি করা হয়েছে সেটি তার জানা নেই এবং মি. পান্নাকে তিনি চেনেন না।
যদিও এর আগে অনেকে অভিযোগ করছিলেন, মামলায় যে বা যারাই মি. পান্নার নাম যুক্ত করুক না কেন এর পেছনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের ‘রিসেট বাটন’ বিষয়ক একটি বক্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করা কিংবা মি. পান্না সরকারের যেসব সমালোচনা করছিলেন সেগুলোই মূল ভূমিকা রেখেছে।
লেখক ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলছেন, ঘটনাটি খুবই অপ্রত্যাশিত এবং যেভাবেই হোক এটি একটি ভুল বার্তা দিয়েছে জনমনে।
তবে সরকার প্রধান বা সরকারের সমালোচনার কারণেই তাকে মামলায় জড়ানো হয়েছিলো কি না এমন প্রশ্নের জবাবে মি. পান্না বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “সরকারের ভেতর কিংবা বাইরে- যে কোন জায়গা থেকেই এটি হতে পারে”।
জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে যোগ দেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে মার্কিন সংবাদ মাধ্যম ভয়েস অব আমেরিকাকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
ওই সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে তিনি বলেছিলেন, “প্রথমে স্বীকার করতে হবে যে ছাত্ররা বলেছে, আমরা ‘রিসেট বাটন’ পুশ করেছি; এভ্রিথিং ইজ গন; অতীত নিশ্চিতভাবে চলে গেছে। এখন নতুন ভঙ্গিতে আমরা গড়ে তুলবো। দেশের মানুষও তা চায়। সেই নতুন ভঙ্গিতে গড়ে তোলার জন্য আমাদের সংস্কার করতে হবে।”
তার এ বক্তব্যকে ঘিরে তখন ব্যাপক আলোচনা শুরু হয় সামাজিক মাধ্যমে। অনেকে অভিযোগ করেন এই বক্তব্যের মাধ্যমে মি. ইউনূস জাতীয় জীবন থেকে ১৯৭১ সাল কিংবা মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি সরিয়ে দিতে চাইছেন।
মি. ইউনূসের ওই মন্তব্যকে ঘিরে পাল্টা যে মন্তব্যটি সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছিলো সেটিই করেছিলেন মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারপার্সন এবং সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্না।
এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “রিসেট বাটন কিন্তু আমরাও চাপতে পারি। আমরা ১৯৭১ সালে রিসেট বাটনে চাপ দিয়ে পাকিস্তানকে ওয়াশ-আউট করে বাংলাদেশ তৈরি করছি, সেভাবে আবারও রিসেট বাটন চাপ দিতে পারি।”
জেড আই খান পান্নার এই বক্তব্য নিয়ে আলোচনার ঝড় ওঠে সামাজিক মাধ্যমে। অনেকে এও বলছেন যে তার ওই বক্তব্য আওয়ামী লীগের পক্ষে গেছে। আবার আওয়ামী লীগ পন্থী অনেকেই মি. পান্নার বক্তব্য শেয়ার বা প্রচার করেছেন।
পরে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকেও রিসেট বাটন বিষয়ক মন্তব্যের ব্যাখ্যা দেয়া হয়। ওই ব্যাখ্যায় বলা হয় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দেয়া সাক্ষাৎকার ঘিরে কেউ কেউ ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছেন।
‘রিসেট বাটন’ চাপার কথা বলে তিনি কখনোই বাংলাদেশের গর্বিত ইতিহাস মুছে ফেলার কথা বলেননি।
কিন্তু বিষয়টি নিয়ে আলোচনা আরও বেড়ে যায় সতেরই অক্টোবর মি. পান্নাকে হত্যা মামলার আসামী করার পর। শেখ হাসিনার সরকার বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নিয়েছেন এমন অনেকেই মামলায় মি. পান্নাকে আসামি করার তীব্র সমালোচনা করেন।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলছেন জেড আই খান পান্না আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন এবং তার পুরো ইতিহাসই অধিকার রক্ষার পক্ষে।
“তাকে ঘিরে এমন ঘটনা অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রত্যাশিত। ঘটনাটি মানুষের মধ্যে এমন ধারণা দেয় যে সমালোচনা করলে সমস্যা হতে পারে। এমনটি তো আওয়ামী লীগ আমলে হতো। এখন কেন ভয়ের মধ্যে থাকতে হবে। বরং সরকারের উচিত হবে সমালোচনা মানে সহায়তা – এই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করা,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
“আপনি সমালোচনা করতে পারবেন কিন্তু শুধু আওয়ামী লীগের এটা হলে তো হবে না। সমালোচনা করতে হবে সরকারের ভুল ত্রুটি নিয়ে যাতে সরকার সঠিক পথে এগুতে পারে। না হলে তো সেই আগের মতোই পরিস্থিতির উদ্ভব হবে” বলেন আনু মুহাম্মদ।
আরেকজন বিশ্লেষক অধ্যাপক জোবাইদা নাসরিন বলছেন, প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে ‘মন খুলে সমালোচনা’র আহবান জানিয়েছিলেন কিন্তু তার সাথে জেড আই খান পান্নার ক্ষেত্রে ঘটে যাওয়া ঘটনা মিলছে না।
“তিনি (জেড আই খান পান্না) সরকার প্রধান ও সরকারের সমালোচনা করেছেন। এখন হয়তো তুমুল সমালোচনার প্রেক্ষাপটে মামলা থেকে তার নাম বাদ দেয়া হচ্ছে। মামলায় সরকারের ভূমিকা থাকুক আর না থাকুক জনমনে এ ধারণাই তৈরি হয়েছে যে ওই সমালোচনার কারণেই তাকে হেনস্থা হতে হয়েছে,” বলছিলেন তিনি।
তার মতে ঘটনাটি আওয়ামী লীগের মতোই সরকারের সমালোচনার সুযোগ না দেয়ারই ইঙ্গিত দিয়েছে।
আনু মুহাম্মদ বলছেন, বিরোধী বা সমালোচকদের মামলায় আসামী করা, হয়রানি করা কিংবা গণগ্রেফতার -এগুলো ছিলো পুরনো সরকারের বৈশিষ্ট্য, যা বর্তমান সরকারের কাছে কেউ প্রত্যাশা করে না।
“মামলা ও গ্রেফতারের ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়া উচিত। ঢালাও ভাবে মামলা ও গ্রেফতারের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে,” বলছিলেন তিনি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।