নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে ‘বঙ্গবন্ধু টানেল’ নামে বাংলাদেশের প্রথম বহুলেন সড়ক টানেল উদ্বোধন করা হয়েছে। এতে অনেক সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলে যাবে বলে আশাবাদী চট্টগ্রামের মানুষ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল (২৮ অক্টোবর) টানেলটি উদ্বোধন করেন। দক্ষিণ এশিয়ায় নদীর তলদেশ দিয়ে যানবাহন চলাচলকারী প্রথম টানেল এটি। সরকারের মেগাপ্রকল্পগুলোর মধ্যে এটিও একটি।
আজ (২৯ অক্টোবর) ভোর ৬টা থেকে বঙ্গবন্ধু টানেলে যানবাহন চলাচল শুরু হয়েছে। প্রথম যাত্রীবাহী বাস হিসেবে টোল দেয় বিডি বাস লাভার গ্রুপের একটি বাস। আনোয়ারা প্রান্তে ভোর ছয়টায় প্রথম যাত্রী হিসেবে টোল দেন মুন্সিগঞ্জের ব্যবসায়ী জুয়েল রানা। এরপর টোল দেন সাতকানিয়ার চালক শফিক আলম।
টানেলে প্রবেশের জন্য উভয় প্রান্তে অপেক্ষায় ছিল শতশত গাড়ি। তবে পতেঙ্গা প্রান্তের চেয়ে আনোয়ারা প্রান্তে গাড়ির চাপ বেশি।
এক নজরে বঙ্গবন্ধ টানেলের কয়েকটি তথ্য:
মোট দৈর্ঘ্য – ৯.৩৯ কিমি
মূল টানেলের দৈর্ঘ্য – ৩.৩১৫ কিমি
এপ্রোচ সড়কের দৈর্ঘ্য – ৫.৩৫ কিমি
টানেলের ধরন – দুই লেনের ডুয়েল টানেল
প্রবেশপথ – চট্টগ্রাম বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দরের কাছে, কর্ণফুলী নদীর ভাটির দিকে নেভি কলেজের কাছে
বহির্গমন – আনোয়ারা প্রান্তে কাফকো সার কারখানার কাছে।
খরচ কত?
২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। তবে নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। ২০২০ সালের নভেম্বরে উদ্বোধনের কথা থাকলেও কোভিড-১৯ মহামারিসহ কয়েক দফায় পেছানো হয় প্রকল্প শেষের সময়। এর সাথে বাড়ে ব্যয়ও।
প্রাথমিকভাবে যেটা সাড়ে ৮ হাজার কোটির কিছুটা কম ছিল সেটা বেড়ে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি ৭১ লক্ষ টাকায়। এর মাঝে বাংলাদেশ ব্যয় করছে ৪ হাজার ৬১৯ কোটি ৭০ লাখ এবং চীনের ঋণ ৬ হাজার ৭০ কোটি টাকা।
এতে কী লাভ হবে?
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, চট্টগ্রাম শহরে নিরবচ্ছিন্ন ও যুগোপযোগী সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং বিদ্যমান সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার ‘আধুনিকায়ন’ করতে এই প্রকল্প করা হয়েছে।
একই সাথে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার এর মধ্যে নতুন সড়ক যোগাযোগে অত্যন্ত ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বিদ্যমান কর্ণফুলী নদীর উপরের দুই সেতুতে চাপ কমাতেও সাহায্য করবে এই টানেল।
বর্তমান কোরিয়ান ইপিজেডের সাথে চট্টগ্রাম বন্দরের যাতায়াতের তুলনামূলক সুবিধাজনক রুট হবে এই টানেল। এছাড়া ঢাকা-কক্সবাজার রুটে “৫০ কিলোমিটারের মতো দূরত্ব কমবে এবং সময় বাঁচবে এক ঘণ্টার মতো’’ জানান টানেল নির্মাণ প্রকল্প পরিচালক মোঃ হারুনুর রশীদ চৌধুরী। ভবিষ্যতে এশিয়ান হাইওয়ের সাথে সংযোগ স্থাপন হবে এই টানেলের মধ্য দিয়ে।
ওয়ান সিটি টু টাউন:
প্রকল্পের সাথে সম্পৃক্ত কর্মকর্তারা দাবি করছেন, এই টানেল নির্মাণের আরেকটি উদ্দেশ্য চট্টগ্রাম শহরকে চীনের সাংহাই শহরের আদলে “ওয়ান সিটি টু টাউন” বা “এক নগর দুই শহর” এর মডেলে গড়ে তোলা। এই যোগাযোগ ব্যবস্থা চালুর পর শহরের সম্প্রসারণ এবং বিদ্যমান শিল্প নগরীর আরও শিল্পায়ন হওয়ার চিন্তা থেকেই তা বলা হচ্ছে।
কর্ণফুলী নদীর পূর্বদিকের প্রস্তাবিত শিল্প এলাকার উন্নয়নের দিক যেমন আছে, তেমন পশ্চিম দিকের শহর, বন্দর ও বিমানবন্দরের সাথে উন্নত ও সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থার কথা বলছে সেতু বিভাগ। এছাড়া নদীর পূর্ব প্রান্তে ভবিষ্যতে শিল্পায়নের দিক ছাড়াও পর্যটন শিল্পের বিকাশের কথাও বলা হচ্ছে।
রক্ষণাবেক্ষণ:
এই টানেল নির্মাণে কাজ করেছে চীনের চায়না কমিউনিকেশনস কনস্ট্রাকশন কোম্পানি। এর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ সেই কোম্পানির সাথেই পাঁচ বছরের চুক্তি করেছে বলে জানান টানেল নির্মাণ প্রকল্প পরিচালক মোঃ হারুনুর রশীদ চৌধুরী।
তবে এই টানেলটি খুবই ‘সংবেদনশীল’ এবং এর রক্ষণাবেক্ষণ খুব সহজ হবে না বলে জানান পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহ-সভাপতি প্রকৌশলী সুভাস বড়ুয়া। এখানে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ যেমন নিশ্চিত করতে হবে তেমন প্রতিদিন কার্বন-ডাই-অক্সাইড অপসারণ করে অক্সিজেন প্রবেশ করানো এমন নানা বিষয়ের কথা উল্লেখ করেন তিনি। এছাড়া টানেলে যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে সেটাকে উদ্ধারের খরচটাও বেশ বড় হবে বলে জানা গেছে।
রিসোর্টের মতো সার্ভিস এরিয়া:
এই টানেল প্রকল্পের ভেতরেই ‘সার্ভিস এরিয়া’ বলতে একটি বিশেষ অংশের কাজ চলছে। সেখানে থাকবে ৩০টি বাংলো, একটি ভিআইপি বাংলো, মোটেল মেস, হেলথ সেন্টার, মাঠ, টেনিস কোর্ট, কনভেনশন সেন্টার, জাদুঘর, সুইমিং পুল,
মসজিদ, হেলিপ্যাডসহ অনেক সুযোগ সুবিধা।
আনোয়ারার দিকে পার্কি বিচের কাছে এর কাজ চলছে বলে জানান হারুনুর রশীদ চৌধুরী। এটিকে পরবর্তীতে রিসোর্ট হিসেবে জনসাধারণের জন্য খুলে দেয়া হবে যেটা থেকে সরকারের আয়ের উৎস হবে বলে জানান তিনি। প্রকল্পব্যয় যে ১০ হাজার কোটি ধরা হয়েছে এই অংশটি সেটার অন্তর্ভুক্ত, যদিও এর নির্মাণকাজ শেষ হয়নি।
টোল কত?
এই টানেলের টোল ভাড়া প্রকাশ করা হয়েছে যা গাড়িভেদে ২০০ টাকা থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত হবে। বড় যানবাহনের ক্ষেত্রে চাকার সাথে একটি অংশ থাকে এক্সল যেটায় আসলে গাড়ি কতটা প্রশস্ত সেটা নির্ধারণ হয়। এই এক্সলের উপরেও ভাড়া নির্ভর করবে।
কার, জীপ, পিকআপ – ২০০ টাকা
মাইক্রোবাস – ২৫০ টাকা
বাস (৩১ আসন বা এর কম) – ৩০০ টাকা
বাস (৩২ আসন বা এর বেশি) – ৪০০ টাকা
বাস (৩ এক্সল) – ৫০০ টাকা
ট্রাক (৫ টন পর্যন্ত) – ৪০০ টাকা
ট্রাক (৫.০১ টন হতে ৮ টন পর্যন্ত) – ৫০০ টাকা
ট্রাক (৮.০১ টন হতে ১১ টন পর্যন্ত) – ৬০০ টাকা
ট্রাক/ট্রেইলার (৩ এক্সল) – ৮০০ টাকা
ট্রাক/ট্রেইলার (৪ এক্সল) – ১০০০ টাকা
ট্রাক/ট্রেইলার (৪ এক্সলের অধিক) – ১০০০ টাকা + প্রতি এক্সল ২০০ টাকা।
টানেলের কার্যকারিতার বড় অংশই দুই পাশের ব্যবস্থাপনার অনেক দিকের উপর নির্ভর করবে বলে জানান পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহ-সভাপতি প্রকৌশলী সুভাস বড়ুয়া।
তিনি এই টানেলসহ চট্টগ্রামের পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে গবেষণাধর্মী কাজ করেছেন।
প্রকৌশলী সুভাস বড়ুয়া বলেন, মহাসড়কের অব্যবস্থাপনার যে সমস্যা রয়েছে সেটা নিয়ন্ত্রণ না হলে যে সময় বাঁচানোর কথা বলা হচ্ছে সেটা খুব বেশি কার্যকর কিছু হবে না। প্রকল্পের বাইরে উভয় দিকের রাস্তা ছোট এবং যানজটের সমস্যা প্রকট।
‘ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় কোন ধরণের গাড়ি চালালে অল্প জায়গায়, অল্প সময়ে সর্বোচ্চ যাত্রী পরিবহন করতে পারবে এসব বিষয় চিন্তা না করে যদি পরিকল্পনা করা হয় তাহলে এর সুফল পাওয়া যাবে না,’ বলেন সুভাস বড়ুয়া।
চট্টগ্রামের জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এটিএম পেয়ারুল ইসলাম বলেন, টানেলের কারণে ঢাকা-কক্সবাজারের সড়ক দূরত্ব কমার পাশাপাশি বাণিজ্যিক সুবিধাও বৃদ্ধি পাবে। দক্ষিণে যে শিল্পায়ন ত্বরান্বিত হওয়ার কথা বলা হচ্ছে সেসব সফলভাবে সম্পন্ন হবে খুব দ্রুত।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।