সয়াবিন তেলের দাম বারবার বাড়ার কারণে দেশের সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ভীষণভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য এই মূল্যবৃদ্ধি এখন যেন অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে এপ্রিল মাস থেকে বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি ১৯৩ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, যা বর্তমানের তুলনায় লিটারপ্রতি ১৮ টাকা বেশি। এই সিদ্ধান্ত দেশের বাজার ব্যবস্থার অসংগতি এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থারই এক করুণ প্রতিচ্ছবি।
ব্যবসায়ীদের নতুন প্রস্তাব: কতটা যুক্তিসঙ্গত?
বাজারে দাম বৃদ্ধির জন্য ব্যবসায়ীরা যুক্তি দেখাচ্ছেন যে সরকারের দেওয়া শুল্ক ও কর অব্যাহতির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। এর ফলে তারা নাকি ক্ষতির মুখে পড়ছেন। কিন্তু বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসাব বলছে, শুল্ক অব্যাহতির ফলে তারা প্রতি লিটারে ১১ টাকা সাশ্রয় করছিলেন। তাহলে এখন লিটারে ১৮ টাকা বাড়িয়ে তারা আসলে অতিরিক্ত ৭ টাকা মুনাফা করতে চাইছেন।
এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে—এই মূল্যবৃদ্ধির আসল উদ্দেশ্য কী? ঈদের ঠিক আগের কর্মদিবসে দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়ে ব্যবসায়ীরা সুস্পষ্টভাবে সরকারকে চাপের মুখে ফেলতে চাচ্ছেন। সরকারি ছুটির সুযোগে তারা যেন একতরফাভাবে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারছেন।
সয়াবিন তেলের দাম: সিন্ডিকেটের কবলে বাজার
সয়াবিন তেলের দাম অনেক সময়ই নির্ধারিত হয় কিছু গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠানের ইচ্ছার উপর ভিত্তি করে। বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন এমন একটি সংগঠন, যাদের হাত ধরে বাজারে বহুবার একচেটিয়া মূল্যবৃদ্ধির নজির দেখা গেছে।
এই সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের প্রভাব এতটাই ব্যাপক যে, সরকার অনুমোদন না দিলেও তারা অনেক সময় দাম বাড়িয়ে দেয় এবং পরে সরকারকে সেটি মেনে নিতে বাধ্য করে। ফলে সাধারণ মানুষ হয়ে পড়ে জিম্মি।
এই পরিস্থিতিকে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এটি একটি কার্টেল সিস্টেম—যেখানে প্রতিযোগিতা নেই, কেবল মুনাফা করার নেশা রয়েছে।
সরকার কোথায়? নিয়ন্ত্রণের ঘাটতি কেন?
বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সরকারের ভূমিকা একটি বড় প্রশ্নবোধক চিহ্নের মুখে। ব্যবসায়ীরা দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব দিলে সেটি যাচাই-বাছাই এবং অনুমোদনের দায়িত্ব থাকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের উপর। কিন্তু এই প্রক্রিয়া প্রায়শই ধীরগতির এবং অপরিকল্পিতভাবে পরিচালিত হয়।
বিশেষ করে জাতীয় ছুটির সময় বা কোনো গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে ব্যবসায়ীরা দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দিলে, সরকার যেন হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকে। এতে প্রমাণ হয়, এই বাজার ব্যবস্থায় প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ নেই। বরং একটি অদৃশ্য শক্তি বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করছে—যেটি হচ্ছে প্রথম সারির কিছু ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেট।
ভোক্তাদের জীবনযাত্রার মান কতটা ব্যাহত হচ্ছে?
সয়াবিন তেলের দাম বৃদ্ধির সরাসরি প্রভাব পড়ে সাধারণ মানুষের খরচের উপর। রাজধানীর রামপুরার গৃহবধূ রুবি হুসাইন জানান, “প্রতিবার তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাজারের সবকিছুর দাম বেড়ে যায়। এক বোতল তেলের দাম বাড়লে, তা আমাদের পুরো মাসের বাজার খরচে প্রভাব ফেলে।”
বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর জন্য এটি একটি ভয়াবহ সংকট। তাদের পক্ষে প্রতিবার মূল্যবৃদ্ধি সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে। এর ফলে পরিবারে পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ কমে যায়, অনেকেই প্রয়োজনীয় জিনিস না কিনে চলার চেষ্টা করেন।
পাঁচ লিটারের বোতলে কীভাবে বেশি খরচ হচ্ছে?
বর্তমানে পাঁচ লিটার বোতলের দাম ৮৭০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯৩৫ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মানে প্রতি বোতলে বাড়ছে ৬৫ টাকা। যদি কেউ মাসে দুটো পাঁচ লিটারের বোতল কেনেন, তাহলে তার অতিরিক্ত খরচ হবে ১৩০ টাকা।
এক বছরে সেই অতিরিক্ত খরচ দাঁড়াবে ১৫৬০ টাকা—যা নিম্ন আয়ের একজন মানুষের জন্য বিশাল বোঝা।
বাজারে খোলা তেলের দামও কম নয়
একমাত্র বোতলজাত তেল নয়, খোলা সয়াবিন ও পাম তেলের দামও প্রতি লিটার ১৩ টাকা করে বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। নতুন দামে খোলা তেল লিটারপ্রতি ১৭০ টাকা হবে।
এই খোলা তেল মূলত নিম্ন আয়ের মানুষের অন্যতম ভরসা। কিন্তু এখন সেটিও তাদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।
সয়াবিন তেলের দাম বৃদ্ধির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব
একটানা সয়াবিন তেলের দাম বৃদ্ধি আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে বড় প্রভাব ফেলছে। এতে খাদ্য পণ্যের সামগ্রিক দাম বেড়ে যায়, কারণ তেল একটি মৌলিক উপাদান। ফলে রেস্টুরেন্ট থেকে শুরু করে হোটেল, স্ট্রিট ফুডসহ প্রতিটি জায়গায় খাবারের দাম বাড়ে। এটি মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে ছাত্র, বেকার, নিম্নবিত্ত সবার ওপর চাপ সৃষ্টি করে।
অন্যদিকে, তেলের দাম বাড়লে পোশাক কারখানা বা ছোট খাবার উৎপাদনকারীদের উৎপাদন খরচও বেড়ে যায়। ফলে তারা হয় পণ্যের দাম বাড়ায়, না হয় কর্মী ছাঁটাই করে।
কী হতে পারে সমাধান?
মূল্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা শক্তিশালী করা: সরকারকে সয়াবিন তেলের দাম নির্ধারণে আরও কঠোর হতে হবে এবং নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে।
সিন্ডিকেট ভাঙা: কয়েকজন ব্যবসায়ীকে নিয়ন্ত্রণে আনতে ট্রেড কমিশনকে আরো কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।
মূল্যবৃদ্ধি প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করা: ব্যবসায়ীরা যেকোনো সময় দাম বাড়াতে না পারে, সে জন্য প্রয়োজন নীতিগত সংস্কার।
ভোক্তাস্বার্থ রক্ষায় গণশুনানি: যেকোনো দাম বাড়ানোর আগে জনমত যাচাইয়ের ব্যবস্থা রাখা উচিত।
সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর
“আমরা তো আর প্রতিদিন বিদেশি পণ্য খাই না। ভাত আর ডাল রান্না করতেও এখন ভাবতে হয়, তেলের দাম কত,”—বলছিলেন মিরপুরের বাসিন্দা জয়নাল আবেদীন।
এ ধরনের কণ্ঠস্বর প্রতিটি পাড়ায় মহল্লায় শোনা যাচ্ছে। সাধারণ মানুষের ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
সময় এসেছে পরিবর্তনের
সয়াবিন তেলের দাম শুধু একটি পণ্যের দাম নয়, এটি দেশের বাজার ব্যবস্থার দুর্বলতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সিন্ডিকেটের হাতে বাজার নিয়ন্ত্রণ থাকলে সরকার যতই চেষ্টা করুক, সাধারণ মানুষ স্বস্তি পাবে না। সময় এসেছে বাস্তবভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বাজার ব্যবস্থার কাঠামোগত সংস্কারের।
আরও পড়ুন: সোনার দাম : ২২ ক্যারেট সহ স্বর্ণের দাম ভরি প্রতি
ঘন ঘন জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQs)
১. এখন বাজারে সয়াবিন তেলের দাম কত?
বর্তমানে প্রস্তাবিত দাম অনুযায়ী বোতলজাত সয়াবিন তেল লিটারপ্রতি ১৯৩ টাকা এবং পাঁচ লিটারের বোতল ৯৩৫ টাকা।
২. কেন হঠাৎ করে তেলের দাম বাড়ছে?
ব্যবসায়ীরা শুল্ক অব্যাহতির মেয়াদ শেষ হওয়ার অজুহাতে দাম বাড়ানোর চেষ্টা করছেন, যদিও তাদের প্রকৃত খরচ বাড়েনি তেমনভাবে।
৩. সরকার এই দাম বৃদ্ধির অনুমোদন দিয়েছে কি?
না, এখনো সরকার এই প্রস্তাব অনুমোদন করেনি, তবে ব্যবসায়ীরা একতরফাভাবে দাম কার্যকর করতে চাইছে।
৪. এই দাম বৃদ্ধির ফলে কারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে?
নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো, যাদের মাসিক খরচ সীমিত, তারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হবে।
৫. সাধারণ মানুষের জন্য কোনো সমাধান আছে?
সরকার যদি বাজার মনিটরিং এবং সিন্ডিকেট বিরোধী ব্যবস্থা গ্রহণ করে, তাহলে কিছুটা স্বস্তি আসতে পারে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।




