জুমবাংলা ডেস্ক : প্রচার আছে, নৌপথে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক নেওয়ার মূল হোতা এক দালাল, নাম তার পেণ্ডে আলী। এই দালালের প্রতারণার শিকার ২৫ জন বাংলাদেশি শ্রমিকের দেখা মিলল কুয়ালালামপুরের পান্ডান ইন্দার এলাকায়। টাকা দিয়েও বৈধ হতে পারেননি এই ২৫ জনের একজন শহিদুল ইসলাম। তিনি জামালপুরের মাদারগঞ্জের তারতাপাড়ার নওয়াব আলীর ছেলে। এই প্রতিবেদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে তার নানা কাহিনি।
শহিদুলকে বৈধ করার কথা বলে প্রথমে চার হাজার রিংগিত নেন পেণ্ডে আলী। আজিন্দা রেনচেং কম্পানির নামে মাইইজির রসিদ দেওয়া হয়। ভিসাসহ পাসপোর্ট হাতে পেলেই আরো পাঁচ হাজার রিংগিত দেওয়ার কথা হয়। কিন্তু মাসের পর মাস যায়, ভিসা আর লাগে না, পেণ্ডে আলীকেও পাওয়া যায় না। খোঁজ নিয়ে শহিদুল জানতে পারেন, মাইইজির রসিদ দেওয়া হলেও কোনো টাকাই জমা দেননি পেণ্ডে আলী। রসিদটি ১ সেপ্টেম্বর ২০১৬ তারিখের। রিহায়ারিং সিরিয়াল নম্বর ৬০৭৮০৯-টি এবং ইনভয়েস নম্বর-ইএমএম/পিটি১৪৭১৫২২৪২১৬১৫। শহিদুলের নামে টাকা জমা দেওয়া হয়েছে ইনস্যুরেন্স বাবদ ২৮৬.৫২ রিংগিত, নিবন্ধন বাবদ ৮০০ রিংগিত মোট এক হাজার ৮৬.৫২ রিঙ্গিত। শহিদুল বলেন, ‘খোঁজ নিয়ে জানতে পারি সেটা ভুয়া মাইইজি রসিদ।’
পেণ্ডে আলীর প্রতারণার শিকার প্রবাসী বাংলাদেশি ব্যবসায়ী মো. শহিদুল। কুয়ালালামপুরের পান্ডান ইন্দার ৯, জালান ৬/১০-এর আজিন্দা রেনচাং এসডিএন ডিএইচডি নামক একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক মো. শহিদুলকে কৌশলে ফাঁসিয়ে তাঁর প্রতিষ্ঠানের তথ্য চুরি করেন পেণ্ডে আলী। গত ১০ অক্টোবর সশরীরে গেলে শহিদ নথিপত্র দেখিয়ে পেণ্ডে আলীর প্রতারণার কিছু প্রমাণ তুলে ধরেন। মালয়েশিয়ার জহুর বারুর কুলা পুলিশ স্টেশনে চলতি বছরের ১০ এপ্রিল পেণ্ডে আলীর বিরুদ্ধে একটি মামলাও করেন শহিদুল। ওই মামলার তদন্ত করছেন পুলিশ অফিসার মুহাম্মদ রিদোয়ান তান বিন আব্দুল্লাহ।
পেণ্ডে আলীর প্রতারণার আরো চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে। মালয়েশিয়ার জহুর বারুর কুলা এলাকার অ্যালকমেক্স রিসোর্সেস (এম) এসডিএন বিএইচডি কম্পানি। সার্টিফিকেট অনুযায়ী এটি কম্পানির ব্যাবসায়িক ঠিকানা দেওয়া হয়েছে জহুর বারুর ৫৭-এ জালান পাহলাওয়ান ১ তামান উঙ্গাকু তুন আমিনাহ ৮১৩০০ স্কুদাই জহুর মালয়েশিয়া। প্রতিষ্ঠানটি নিবন্ধন করা হয়েছে ২০১০ সালের ২৫ জানুয়ারি; কম্পানি নম্বর ৮৮৭৫৪২-ডাব্লিউ। আর নিবন্ধন করা হয়েছে কুয়ালালামপুরের ৪.৩২ চতুর্থ তলা পেরতামা অফিস টাওয়ার কমপ্লেক্স, জালান টয়ংকু আব্দুর রহমান, কুয়ালালামপুর ঠিকানায়। অ্যালকমেক্স রিসোর্সেস নামের কম্পানিটির সার্টিফিকেট ঘেঁটে দেখা যায়, তিনজন পরিচালক রয়েছেন কাগজে-কলমে—মো. মজিব বিন আব্দুল রহমান, উশরি বিন ননিআজনি ও আলী হোসেন মো. হাবিবুর রহমান। আলী হোসেন মো. হাবিবুর রহমানই মালয়েশিয়ায় পেণ্ডে আলী নামে পরিচিত। তিনি এই কম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে আছেন। তবে সাবেক চারজন পরিচালক ও একজন কম্পানি সেক্রেটারির নাম উল্লেখ রয়েছে প্রফাইলে। সাবেক চারজন পরিচালকের মধ্যে তিনজনই মালয়েশিয়ান, আর একজন বাংলাদেশি, নাম মিজানুর রহমান।
কম্পানি সার্টিফিকেটের ঠিকানা ধরে সরেজমিনে গিয়ে ৮ অক্টোবর অ্যালকমেক্স নামের কোনো কম্পানির অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। সেই ঠিকানায় দেখা গেছে ইন্ডিয়ান সেলুন আর বিউটি পার্লার। একইভাবে কুয়ালালাপুরের ৪.৩২ পেরতামা অফিস টাওয়ার কমপ্লেক্সের চতুর্থ তলা, জালান টয়ংকু আব্দুর রহমান, কুয়ালালামপুর ঠিকানায় গিয়েও অ্যালকমেক্স রিসোর্সেসের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে অ্যালকমেক্স রিসোর্সেস কম্পানির কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন পেণ্ডে আলী। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, এমন কাগজে-কলমে নামসর্বস্ব এই প্রতিষ্ঠানে জিটুজি প্লাস পদ্ধতিতে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ থেকে ৫০ জনের বেশি কর্মী আনা হয়েছে। তারা কাজ করছে অন্য কম্পানিতে।
মালয়েশিয়ায় অবৈধ হয়ে কষ্টে দিনাতিপাত করা ১৮৫ জন শ্রমিকের সঙ্গেও প্রতারণা করেছেন পেণ্ডে আলী। দীর্ঘদিনের পলাতক জীবন থেকে মুক্তি পেতে বৈধকরণের জন্য তারা হাড়ভাঙা পরিশ্রমে জমানো এবং দেশের বাড়ি থেকে আনা টাকা তুলে দেয় পেণ্ডে আলীর হাতে। কিন্তু যে প্রতিষ্ঠানের নামে ভিসা করার কথা, সেটি না করে অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের নামে ভিসার আবেদন করে। শেষ পর্যন্ত সেটিও হয়নি। সব টাকা হাতিয়ে তিনি পালিয়ে যান। নিজেদের শেষ সম্বলটুকু তুলে দিয়ে প্রতারিত শ্রমিকরা আরো মারাত্মক কষ্টে পড়ে যায়। সরেজমিনে গিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বললে তাদের দুর্দশার কথা এ প্রতিবেদকের কাছে তুলে ধরে।
(মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের আজ যে দুর্দশা চলছে, তার পেছনে দালালদের ভূমিকা অন্যতম—কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে সেটা স্পষ্ট হয়েছে। পেণ্ডে আলী, কমল দাস, নুরুল ইসলাম, হুমায়ুন কবীরদের মতো অনেক দালালের অপতৎপরতার কথা জানা গেছে। মালয়েশিয়ায় বসে নিজ দেশের শ্রমিকদের ছলে-বলে-কৌশলে শোষণ করে করে তারা আজ অঢেল সম্পদের মালিক। এই দালালদের নিয়ে আমাদের অনুসন্ধান চলছে। শেষ হলেই পরবর্তী সময়ে সেই প্রতিবেদন আমরা পাঠকের সামনে তুলে ধরব)।
(হায়দার আলীর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ‘দালালেই সর্বনাশ শ্রমিকের’ থেকে নেয়া)
সূত্র : সমকাল
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।