জুমবাংলা ডেস্ক : বাড়ির পাশে জগন্নাথ দিঘী পাঞ্জাবীদের ক্যাম্প । প্রতি দিনই কোন না কোন বাড়িতে হানা দিয়ে গরু,ছাগল ,হাঁস মুরগী নিয়ে যাচ্ছে।আর যে বাড়িতে সুন্দরী যুবতী মেয়ে কিংবা বিবাহিত অল্প বয়স্ক বউ থাকত তাদের ধরে ক্যাম্পে নিয়ে নানা রকম নির্যাতন করত।
এলাকার যুবক ছেলে ও মধ্য বয়স্ক পুরুষরা বাড়ি ছাড়া পাঞ্জাবীদের ভয়ে।মে মাসের দিকে এলাকায় পাঞ্জাবীদের অত্যাচার বেড়ে গেল।বাড়িতে থাকা অসম্ভব হয়ে গেল। তখন আমি সাত মাসের অন্ত:সত্ত্বা। সকালে স্বামী জানাল,আমার জীবন আর তোমার ইজ্জ্বত নিয়ে গ্রামে থাকা যাবে না। রাজাকারদের আনাগোনাও বেড়ে গেছে।তাই আজই ভারতে চলে যাব।
ইতিমধ্যে আমাদের গ্রামের অনেকেই শরণার্থী হয়ে ভারতে চলে গেছে।বেলা ১২টার দিকে ছোট দুই ছেলে বাদল ও হুমায়ুনকে নিয়ে আমরা স্বামী স্ত্রী নিজের সাজানো বাড়ি ঘর ফেলে চলে যাই ভারতে।কথা গুলো কান্না জর্জরিত কন্ঠে বলেছেন কুমিল্ল¬ার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বাতিসা ইউনিয়নের বসন্তপুর গ্রামের মৃত আবুল খায়ের পাটোয়ারির স্ত্রী লতিফা বেগমের। বর্তমানে তিনি ঢাকার সাভারে স্থায়ী ভাবে বসবাস করছেন।
কেন নিজের বাড়ি ঘর,সংসার ছেড়ে ভারতে গেলেন জানতে চাইলে লতিফা বেগম বলেন,বাবারে দুনিয়াতে কি এমন লোক আছে যে মনের সুখে নিজের বাড়ি ঘর ছেড়ে পরদেশে চলে যায়।আমাদের গ্রাম বসন্তপুর পাশেই ছিল জগন্নাথ দিঘি। এই দিঘী সংলগ্ন এলাকায় পাঞ্জাবীদের বড় একটি ক্যাম্প ছিল। এই ক্যাম্পের অত্যাচার নির্যাতনের কথা মনে হলে এখনো আতংকিত হয়ে পড়ি।
এমন কোন নির্যাতন নেই যে জগন্নাথদিঘী ক্যাম্পের পাঞ্জাবীরা আমাদের বসন্তপুর গ্রামসহ আশেপাশের কয়েকটি গ্রামে করেনি।তাদের নির্যাতনে গ্রামের বাবা মা তাদের যুবতী মেয়েদের আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিত।প্রতিদিন সকাল হলেই শুনতাম অমুকের মেয়েকে অমুকের বউকে পাঞ্জাবীরা ধরে নিয়ে গেছে।বাড়ি ঘরের চাল ডালসহ সব কিছু লুট করে নিয়ে যেত। সাথে যোগ দিত কিছু রাজাকারও।বলতে পারেন নিজের ইজ্জত আর স্বামীর জীবন বাঁচাতেই আমরা ভারতে যাই।
কিভাবে গেলেন জানতে চাইলে মনটা বিষাদে ভারী হয়ে উঠল লতিফা বেগমের। তিনি এক পর্যায়ে কেঁদে দিয়ে বললেন,বাবারে সেই কষ্টের দিনগুলোর কথা মনে আসলে এখনো চোখের পানি রাখতে পারি না। তখন আমি সাত মাসের অন্ত:সত্তা ছিলাম।মে মাসের প্রথম দিকে একদিন দুপুরে ছোট দুই ছেলে নিয়ে আমরা রওয়ানা হই। রাস্তায় উঠে দেখি আমাদের মত শত শত নারী পুরুষ শিশু বৃদ্ধরা ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বালুধুমের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিচেছ। সবার চোখে মুখে আতংকের ছাপ। কখন জানি পাঞ্জাবীরা আবার দেখে ফেলে।কার উপর গুলি, বোমা এসে পড়ে।সন্তান পেটে নিয়ে হাটতে পারছিলাম না।ছোট দুই ছেলেও হাটতে হাটতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। হাটছি তো হাটছি। রাস্তা শেষ হয় না। আল্লাহকে ডাকতে ডাকতে গলা শুকিয়ে যায়।
আল্লাহকে বলি,আল্ল¬াহরে আমার পেটের সন্তানকে তুমি সুস্থ রাখিও,ভাল রাখিও।রাস্তায় কত মানুষ যে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল তার কোন হিসাব নেই। জীবন মৃত্যুকে সাথে নিয়ে মাগরিবের পর ভারতের বালুধুমে গিয়ে পৌঁছি। সেখানে ঐ দিন রাতে পূর্ব পরিচিত রুহুল আমীনের বাড়িতে থাকি।পরদিন বালুধুমের একটি খালি জায়গায় কত কষ্ট করে পাহাড় টিলা থেকে বাশ কেটে একটি ছোট ঘর উঠাই।স্বামী স্ত্রী দুই
সন্তান নিয়ে কত কষ্ট করে এই টুকরী নিয়ে ৮ মাস ছিলাম।আগস্ট মাসে আমার সন্তান প্রসব হয়। সে দিন আমার যে কি কষ্ট হয়েছিল তা কোন দিন বুঝিয়ে বলতে পারব না। কারণ,এখানে আমার কোন আত্মীয় স্বজন নেই,পাড়া প্রতিবেশী নেই,পরিচিতজন কেউ নেই।এমন এক পরিস্থিতিতে আমার তৃতীয় ছেলের জন্ম হয় সেখানে। যার নাম রাখি সেলিম।
ভারতে কিভাবে চলেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন,বালুধুমে কোন রেশম ক্যাম্প ছিল না। রেশম ক্যাম্প ছিল রাধানগরে। বালুধুম থেকে অনেক দূরে। হাতে টাকা নেই। অনেক কষ্ট করে পায়ে হেঁটে রাধানগর গিয়ে আমরা চারজন শরণার্থী হিসেবে রেশম কার্ড করি। মাসে মাসে সরকার যে রেশম দিত তা দিয়ে আমাদের সংসার খুব একটা চলত না। এই রেশমে মাস যেত না। বাধ্য হয়ে আমার স্বামী সেখানে স্থানীয়দের কৃষি জমিতে কাজ করত।
বালুধুমের জীবন সম্পর্কে জানতে চাইলে শরণার্থী হিসেবে জীবন কাটানো লতিফা বেগম বলেন, প্রতি দিনই মৃত্যুর যন্ত্রনার ছটফট করতাম।কারণ,আমাদের চৌদ্দগ্রামের সীমান্ত নিয়ে পাঞ্জাবীরা প্রায়ই বোমা ও আর্টিলারী ছুঁড়ত যা বালুধুমে আমাদের আশ্রয় শিবিরে এসে পড়ত।নভেম্বরের শেষ দিকে হবে। একদিন সকালে একটি বোমা এসে ঠিক আমাদের ঘরের পেছনে এসে পড়ে। আর একটু হলেই ঘরে এসে বোমাটি বিস্পোরিত হত আর আমরা সরিবারে নিহত হতাম। এ সময় আমরা সবাই মিলে সকালের নাস্তা খাচ্ছিলাম। মনে হল আমাদের ঘরটি ভেঙ্গেচুড়ে আমাদের মাথার উপর পড়ল। বাহিরে এসে দেখি যে গাছের সামনে বোমাটি পড়েছে গাছটি উড়ে মাটি গুলো পর্যন্ত গর্ত হয়ে গেল। তখন আমরা সবাই মিলে কান্নাকাটি শুরু করলাম।
কবে দেশে আসলেন জানতে চাইলে লতিফা বেগম বলেন, ৮ডিসেম্বর কুমিল্লা মুক্ত হলে আমরা পরদিনই দেশে চলে আসি। এসে দেখি আমাদের বাড়ির ঘরটি পুরো ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। ঘরের অবশিষ্ট যে মালামাল ছিল তা লুট করা হয়েছে।কিছুই নেই ঘরে। তিন ছেলে স্বামী নিয়ে দেশে এসে পড়লাম আরেক বিপদে।ঘর নেই,টাকা নেই পয়সা নেই,খাবার নেই। বহু কষ্ট করে ঘর ঠিক করি। আবার শূন্য থেকে শুরু করি সংসার।
শরণার্থী লতিফা বেগম দু:খ করে বলেন,মুক্তিযুদ্ধের কারণেই আমরা ঘর বাড়ি ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেই। অর্ধহারে অনাহারে জীবন কাটে আমাদের। আমার স্বামী যদি রাজাকারদের কথা শুনত,পাঞ্জাবীদের কথা শুনত তাহলে দেশ ছাড়তে হতো না। । যারা যুদ্ধ করেছে, ভারতে প্রশিক্ষন নিয়েছে তাদের আমরা বিভিন্ন ভাবে সহযোগিতা করেছি। আজ মুক্তিযুদ্ধের সরকার ক্ষমতায় অথচ আমাদের কোন খোঁজ খবর নেয় না। তিনি জোড় দাবী জানান, সরকার যেন শরণার্থীদের স্বীকৃতি দেন এবং সার্বিক সহযোগিতা করেন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।



