এ টি এম মোসলেহ উদ্দিন জাবেদ: আমাদের বিশ্বের জনসংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি সমস্ত বিশ্ববাসীর জন্য পর্যাপ্ত খাবার সরবরাহ করা দিনদিন চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে উঠছে। খাদ্যের যোগানের জন্য বহুসংখ্যক দেশ এখন ব্লু ইকোনোমি বা নীল অর্থনীতির সম্ভাব্যতায় ও সঠিক ব্যবস্থাপনায় খাদ্য এবং কর্মসংস্থানের আশা সঞ্চার করছে ও অনেকে এক্ষেত্রে বহুদূর এগিয়েছে। ২০১২ সালে আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের সঙ্গে আর ২০১৪ সালে ভারতের সাথে সমূদ্রসীমা নির্ধারণ হয়। এর মাধ্যমে প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার বর্গকিলোমিটার ‘ব্লু স্পেসের’ উপর বাংলাদেশের নিরঙ্কুশ অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যথাক্রমে এরপর প্রায় ছয় ও আট বছর পেরিয়েছে। এখন প্রশ্ন, এই বিশাল সমূদ্র থেকে আমরা কি পরিমান ফল ঘরে তুলতে পারলাম বা তোলার পথে কতটুকু এগুলাম।
চীন, জাপান, ইন্দোনেশিয়া এবং ফিলিপাইনের মতো দেশগুলি প্রায় ৩০০ বছর ধরে সামুদ্রিক অর্থনীতির উপর নির্ভর করে আসছে। প্রকৃতপক্ষে, সামুদ্রিক মাছ, উদ্ভিদ এবং প্রাণী বিশ্বব্যাপী প্রায় ৪৩০ কোটি মানুষের জন্য ১৫ শতাংশ প্রোটিন সরবরাহ করে। বিশে^র প্রায় ৩০ শতাংশ গ্যাস ও জ্বালানী সমুদ্র উপকূলীয় গ্যাস এবং তেলক্ষেত্র থেকে সরবরাহ করা হয়। সময়ের সাথে সাথে বিশ্বব্যাপী নীল অর্থনীতি আরও গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে অবতীর্ণ হতে চলেছে।
বঙ্গোপসাগরে অধিগ্রহণ করা বিশাল অঞ্চলটি যদি সঠিকভাবে ব্যবহার করা হয় তবে বৈদেশিক মুদ্রায় বাংলাদেশের পক্ষে উল্লেখযোগ্য উপার্জন সম্ভব হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে- দেশের ভূমি সম্পদের পরিমাণের তুলনায়, এই সম্পদের ৮১ শতাংশ সমুদ্রের তলদেশে পড়ে রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বঙ্গোপসাগরে ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি সহ ৪৭৫ ধরনের মাছ এবং অসংখ্য অর্থনৈতিক ও জৈবিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ রয়েছে। তবে এই বিশাল জলরাশির সঠিক ব্যবহারে ব্যর্থ হওয়ায় ২০১৭-১৮ সালে উৎপাদিত ৪৩ লাখ ৩৪ হাজার টন মাছের মধ্যে মাত্র সাড়ে ছয় লাখ মেট্রিক টন মাছ সমুদ্র থেকে আহরণ করা সম্ভব হয়েছে।
খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) ১৯৬৯ সালে বঙ্গোপসাগরে একটি সমীক্ষা চালিয়ে ৪৭৫ প্রজাতির মাছ সনাক্ত করে। টেকসই উপকূলীয় ও সামুদ্রিক ফিশারি প্রকল্পের উপ-প্রকল্প ব্যবস্থাপক অধীর চন্দ্র দাসের মতে, বঙ্গোপসাগরে ৩৬৪ প্রজাতির মাছ ও হাঙ্গর, চিংড়ি ও গলদা ৩৩ প্রজাতির, কাঁকড়ার ২১ প্রজাতির এবং ১২ প্রজাতির সেফালোপোড (অক্টোপাস, স্কুইড, শামুক ইত্যাদি) রয়েছে। Save Our Seas Foundation এ সংরক্ষিত তথ্য অনুসারে, প্রায় ৫০০ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী সমুদ্রে বাস করে এবং তাদের মধ্যে কমপক্ষে ৪৭৫ প্রজাতির মাছ রয়েছে বঙ্গোপসাগরে।
মাছ ধরার জন্য ৬৬০ কিলোমিটার সমুদ্রসীমা প্রাপ্তির পরেও বাংলাদেশ এখনও সুযোগটি কাজে লাগাতে পারেনি। মাছ ধরার যান্ত্রিক নৌকা, ট্রলার এবং জাহাজগুলো উপকূল থেকে মাত্র ৭০ কিলোমিটার অবধি মাছ ধরতে পারে। বাকি অংশটি আমাদের মাছ ধরার আওতার বাইরে পড়ে আছে। বঙ্গোপসাগরে প্রায় ৮০ লাখ টন মাছ ধরা পড়ে, যার মধ্যে বাংলাদেশি জেলেরা মাত্র সাড়ে ছয় লাখ থেকে সাত লাখ টন মাছ আহরণ করতে পারেন। বিভিন্ন প্রজাতির মূল্যবান মাছের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রবাল এবং ৩০০ প্রজাতির শামুকও পাওয়া যায় এখানে। বিশেষজ্ঞদের মতে- এছাড়াও বালু, কাঁদামাটি, ইউরেনিয়াম এবং থোরিয়ামিন প্রভৃতি খনিজ সম্পদ রয়েছে।
মৎস ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রণালয় ২০১৫ সালে এক গবেষণাপত্রে, সামুদ্রিক মৎস সম্পদের উপর ভিত্তি করে গভীর সমুদ্রের আয়তন নির্ধারণমূলক সমীক্ষার প্রয়োজনীয়তার উপর আলোকপাত করেছে। এতে সমুদ্র সম্পদকে সুরক্ষিত করার লক্ষে সর্ব-অন্তর্ভূক্ত বা সামগ্রিক নীতির আলোকে একটি আইনি কাঠামো তৈরীর প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি রয়েছে। যা এখনো আলোর মুখ দেখেনি।
বাংলাদেশের সমুদ্র সীমানা দেশের মূল ভূখন্ডের প্রায় সমান। তবে, সমুদ্রের মাছ দেশের মোট মাছ উৎপাদনের মাত্র ১৫.৪২ শতাংশ অবদান রাখে এবং বাংলাদেশে বার্ষিক প্রায় ৮০ লক্ষ টন মাছ ধরার ক্ষমতা রয়েছে। বাংলাদেশ যে পরিমাণ সামুদ্রিক ভূখন্ডের মালিকানা লাভ করেছে, সেখান থেকে তেল-গ্যাস উত্তোলন, মাছ ধরা, নৌযান চলাচল সুবিধা, বন্দর সুবিধা এবং চিত্তাকর্ষক পর্যটনের প্রসার ঘটিয়ে প্রতি বছর প্রায় ২৫০ মিলিয়ন ডলার উপার্জন করা সম্ভব।
খনিজ সম্পদ বিশেষজ্ঞদের মতে, বঙ্গোপসাগরে তেল ও গ্যাসের বড়সড় মজুদ রয়েছে। সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হওয়ার পর তেল ও গ্যাস সম্পদের বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনায় এসেছে। কিন্তু মিয়ানমার ২০১২ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির বছর দুয়েকের মাথায় শুধু গ্যাসের মজুদ আবিষ্কারই নয়, বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষে নিজস্ব ব্লক থেকে গ্যাস উত্তোলন করছে। সেই গ্যাস তারা নিজেরা ব্যবহার করছে এবং চীনেও রপ্তানী করছে। ভারতও বসে নেই, বঙ্গোপসাগরের ভারতীয় অংশে তারা তেল গ্যাসের জন্য জোর অনুসন্ধান চালাচ্ছে এবং বিপুল পরিমানে প্রাপ্তির আশা করছে।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে, ইন্ডিয়ান ওসান রিম অ্যাসোসিয়েশন (আইওআরএ) ঢাকায় ‘Promoting sustainable blue economy – making the best use of opportunities from the Indian Ocean’ শীর্ষক দুই দিনব্যাপী সম্মেলন করেছে। সম্মেলনে রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব) মোঃ খুরশেদ আলম, সামুদ্রিক বিষয়ক ইউনিটের সেক্রেটারি বলেছেন, “সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের সম্ভাবনা, গভীর সমুদ্রে টুনা মাছ ধরা, মাইনিং, শিপিং এবং জ¦ালানি অনুসন্ধান এখনও অব্যাহত রয়েছে।” এই কাজটি দ্রুততার সহিত সম্পাদন করা প্রয়োজন। সম্মেলনে বিশেষজ্ঞরা মতামত দিয়েছেন যে, সমুদ্র সম্পদ আহরণে দেশের বেসরকারী খাতকে এগিয়ে আসা উচিত এবং নীল অর্থনীতি অন্বেষণে বিনিয়োগ করতে হবে।
২০১৭ সালে বিদ্যুৎ, জ¦ালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের শক্তি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের আওতায় ‘বøু ইকোনমি সেল (বিইসি)’ শীর্ষক একটি প্রশাসনিক সেল গঠিত হয়েছিল। এখনও মাঝে মাঝে গোলটেবিল বৈঠক করা ব্যতীত তাদের কোন অগ্রগতিমূলক কার্যক্রম দেখা যায়নি। ‘Towards a blue economy: A pathway for sustainable growth in Bangladesh’ শীর্ষক বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে যে সমুদ্রের অর্থনীতি নিয়ে বাংলাদেশ এখনও একটি বিস্তৃত নীতি পরিকল্পনা গ্রহণ করেনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমুদ্রের এই সম্পদগুলি যথাসময়ে চিহ্নিত ও ব্যবহার করা গেলে বার্ষিক ১২,০০০ কোটি টাকা আয় করা সম্ভব।
সমুদ্র ও এর সম্পদকে কতভাবে ও কিভাবে ব্যবহার করা যায়, তা নিয়ে বিভিন্ন দেশে চলছে গবেষণা ও কর্মযজ্ঞ। ইকোনোমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ২০১৫ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশে^র বিভিন্ন উপকূলীয় দেশ ও দ্বীপের সরকারগুলো অর্থনীতির এক নতুন ক্ষেত্র হিসেবে সমুদ্রের দিকে নজর দিচ্ছে এবং বøু ইকোনমির উপর নির্ভর করে দেশের প্রবৃদ্ধির নীতি গ্রহণ করেছে। ইন্দোনেশিয়ার অর্থনীতি এখন সমুদ্র অর্থনীতির উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। খাদ্য, খনিজ, জ্বালানী ও ঔষধের কাঁচামালের উৎস হিসেবে সমূদ্রের উপর নির্ভরতা দিনকে দিন বাড়ছে।
আমাদের বঙ্গোপসাগরের নতুন অঞ্চল খুঁজে বের করতে হবে। অবশ্যই বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ যখন প্রতিবেশী নেপাল এবং ভুটানের মতো স্থলবেষ্টিত দেশগুলিতে সমূদ্র বন্দর নির্ভর সুবিধা প্রদান করতে পারবে, তখনই নীল অর্থনীতি আরো অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হিসাবে বিবেচিত হবে। কেবলমাত্র ভৌগলিক অবস্থানের কারণে এই সুযোগটি আমাদের রয়েছে।
বাংলাদেশ উপকূলীয় এলাকায় সুরক্ষিত সমূদ্রসীমা নিশ্চিতকরণ, জাহাজশিল্প স্থাপন, সমূদ্রের নবায়নযোগ্য জ¦ালানী (বাতাস ও স্রোত) এবং তেল গ্যাস তথা প্রাকৃতিক খনিজ সম্পদের উৎস অনুসন্ধান সম্পর্কিত সংস্থাসমূহের সাথে সক্রিয়ভাবে কিছু ক্ষেত্রে কাজ শুরু করেছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং পর্যটনের ক্ষেত্র তৈরির কাজও চলছে। বঙ্গোপসাগরে মৎস্য সংরক্ষণ ও মৎস আহরণে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যদিও বাপেক্স সহ বিদেশী অনুদানের সহায়তায় সময়ে সময়ে কিছু সমীক্ষা চালানো হয়েছে, তবুও বঙ্গোপসাগরের বিস্তৃত সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণে বাংলাদেশের অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। এর দীর্ঘসূত্রীতা যত কমানো যাবে ততই বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য সহায়ক হবে।
এ টি এম মোসলেহ উদ্দিন জাবেদ: ফ্রিল্যান্স কলামিস্ট
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।