আন্তর্জাতিক ডেস্ক: আফ্রিকার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় দেশ সুদানে লড়াইরত দুই পক্ষকে রিয়াদে নিয়ে এসে মীমাংসা বৈঠকে বসাতে সক্ষম হয়েছে সৌদি আরব সরকার। সুদানের সেনাপ্রধান জে. আব্দুল ফাতাহ আল বুরহান এবং তার প্রতিপক্ষ মিলিশিয়া বাহিনী আরএসএফের প্রধান জেনারেল মোহামেদ হামদান দাগালো—যিনি হেমেটি নামে বেশি পরিচিত, তারা দুই জনেই তাদের প্রতিনিধিদের পাঠিয়েছেন রিয়াদে। সেখানে শনিবার থেকে সৌদি সরকারের মধ্যস্থতায় তারা মুখোমুখি বসে কথা বলতে শুরু করেছেন।
আফ্রিকার সাহেল এবং হর্ন অব আফ্রিকা অঞ্চলটি এমনিতেই বহুদিন ধরেই যুদ্ধ-বিগ্রহে বিপর্যস্ত। এর মধ্যে গত তিন সপ্তাহে সুদানে প্রায় ৬০০ জন নিহত হয়েছেন। সুদানের সংঘাত দীর্ঘায়িত হলে পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তা আরো ভঙ্গুর হয়ে পড়বে বলে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। আফ্রিকান ইউনিয়ন এবং সেই সঙ্গে পূর্ব এবং হর্ন অব আফ্রিকার আঞ্চলিক জোট ইগাড শুরু থেকেই মীমাংসার চেষ্টা করছে। কিন্তু আফ্রিকার নতুন এই যুদ্ধ বন্ধে সবচেয়ে তৎপর হয়েছে সৌদি আরব।
পূর্ব আফ্রিকা এবং সাহেল অঞ্চলের রাজনীতি ও নিরাপত্তার একজন ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষক বিবিসির বেভারলি ওচিয়েং বলছেন, অন্য সব পক্ষের তুলনায় সৌদি আরবের মধ্যস্থতার উদ্যোগ অনেক বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে, সুদানের বিবদমান দুই পক্ষই সৌদি আরবের মধ্যস্থতা নিয়ে আগ্রহী।
সুদানের সংঘাত বন্ধ নিয়ে সৌদিরা কেন এত উঠেপড়ে লেগেছে? বেভারলি ওচিয়েং বলেন, সুদান আফ্রিকার দেশ কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলো এদেশের রাজনীতি এবং অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি, বিশেষ করে সৌদি আরব। সুদান একই সঙ্গে সাহেল, হর্ন অব আফ্রিকা এবং লোহিত সাগর অঞ্চলের অংশ। কিন্তু তারপরও সুদানের সমাজ ও রাষ্ট্রের একটি বড় অংশের—বিশেষ করে আরবি ভাষাভাষী সুদানি শাসক এবং অভিজাত শ্রেণির সঙ্গে উপসাগরীয় আরব দেশগুলোর ঐতিহাসিকভাবে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।
ইয়েমেন যুদ্ধে সৌদি নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশনের প্রধান শরিক ছিল সুদান। যে চারটি দেশের মধ্যস্থতায় গত বছর সুদানে সামরিক শাসন থেকে বেসামরিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে চুক্তি হয়েছে তাতে আফ্রিকার কোনো দেশ না থাকলেও রয়েছে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত।
লন্ডনে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ঝুঁকিবিষয়ক বিশ্লেষক সাদি হামদি বলেন, সৌদি আরব এবং ইউএই মনে করে, সুদানের নিরাপত্তা এবং রাজনৈতিক সংস্কারের প্রকল্পটি তাদের। সুতরাং এই প্রকল্প ভেস্তে যাক সেটা তারা কোনোভাবে চায় না। সাদি হামদি মনে করেন, সুদানের সংঘাত নিয়ে সৌদি আরবের বিশেষ তৎপরতার পেছনে প্রধানত রয়েছে তাদের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ। একই কথা ইউএইর বেলাতেও প্রযোজ্য। সুদানে ইসলামপন্থি কোনো সরকার প্রতিষ্ঠিত হোক সৌদি আরব বা ইউএই কোনোভাবেই চায় না।
আরব বসন্ত অর্থাৎ গণবিক্ষোভের জেরে সরকার পতনের পর যেসব আরব দেশে নির্বাচন হয়েছে—যেমন মিশর, তিউনিসিয়া, সব জায়গায় ইসলামপন্থিরা ক্ষমতা নিয়েছিল। এতে ঘাবড়ে গিয়েছিল সৌদি আরব এবং ইউএই। অভিযোগ রয়েছে, ঐসব সরকারের পতনে পেছন থেকে কাজ করেছে এই দুই দেশ।
এ কারণে গণবিক্ষোভের ভেতর দিয়ে ওমর আল বশিরের পতনের পর সুদানে কোনো নির্বাচন হয়নি। হেমেটির সঙ্গে সম্পর্কে টানাপড়েনের মাঝে জে. বুরহান কিছু দিন আগে হুমকি দিয়েছিলেন তিনি নির্বাচন দিয়ে দেবেন, যেটা সৌদি এবং ইউএইকে হয়তো উদ্বিগ্ন করে তুলছে। স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, লড়াইয়ে জে. বুরহানের অনুগত বাহিনী হেমেটির বাহিনীকে বেশ চাপে ফেলেছে। ফলে, সৌদি এবং ইউএই হয়তো ভয় পাচ্ছে এই লড়াইয়ে যদি হেমেটি হারে তাহলে জে. বুরহান হয়তো নির্বাচন দিয়ে দেবেন এবং সেই নির্বাচনে ইসলামপন্থিরা জিতবে। সামি হামদি মনে করেন, প্রধানত সে কারণে সৌদিরা মধ্যস্থতা করতে উঠেপড়ে লেগেছে—যাতে হেমেটির আরএসএফ যেন টিকে থাকতে পারে। তবে অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, শুধু রাজনৈতিক বা কৌশলগত স্বার্থই নয়, সুদানের এই সংঘাতকে সৌদি আরব তাদের নিজেদের উচ্চাভিলাষী অর্থনৈতিক পরিকল্পনার জন্য হুমকি হিসেবে মনে করছে। কারণ, তেল সম্পদ ছাড়াই অর্থনৈতিক উন্নয়নের যেসব প্রকল্প যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান নিয়েছেন তার অনেকগুলোই লোহিত সাগর উপকূল ঘেঁষে। ৫০০ বিলিয়ন ডলারের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি-ভিত্তিক শহর নিওম সিটিও সেখানে। এই এলাকা সুদানের লোহিত সাগর উপকূল থেকে বেশি দূরে নয়। তাই এই মুহূর্তে সৌদিরা যেটা একেবারেই চায় না তা হলো—লোহিত সাগরের উপকূলে আরেকটি সিরিয়া। সৌদিরা ভয় পাচ্ছে সুদানের সংঘাত আশপাশের দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়লে লোহিত সাগর উপকূলে তাদের প্রকল্পগুলোতে বিনিয়োগ আকর্ষণ কঠিন হয়ে উঠতে পারে।
এছাড়া, ২০১৯ সালে বশিরের উৎখাতের পর প্রাকৃতিক সম্পদ এবং কৃষিতে সমৃদ্ধ সুদানে পা রাখার সুযোগ হয় সৌদি আরবের। গত বছর তারা সুদানের কৃষি এবং খনিজ সম্পদ উন্নয়নে ৩০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে। সংযুক্ত আরর আমিরাতও পোর্ট অব সুদানের ২০০ মাইল উত্তরে একটি নতুন বন্দর নির্মাণে ৬০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের একটি চুক্তি করেছে।
হামদির ভাষায়, বর্তমান পরিস্থিতিতে সুদান হয়তো আন্তর্জাতিক ছায়া যুদ্ধের একটি ভেন্যু হতে চলেছে এবং এটি ঠেকানো না গেলে পরিণতিতে সাড় ৪ কোটি জনসংখ্যার খনিজসম্পদে সমৃদ্ধ দেশটি একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবে। আর ঘটনাপ্রবাহ সেভাবে গড়ালে সৌদি আরবের জন্য তা হবে চরম এক দুঃস্বপ্ন। —সূত্র : বিবিসি
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।