আন্তর্জাতিক ডেস্ক: মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানে দেশটির প্রেসিডেন্ট উইন মিন্ট এবং ক্ষমতাসীন দলের প্রধান অং সান সু চিসহ দলের শীর্ষ কয়েকজন নেতাকে সোমবার (১ ফেব্রুয়ারি) ভোরে গ্রেফতার করা হয়। ক্ষমতাচ্যুত করার পর অং সান সু চির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ তোলা হয়েছে। এর একটিতে আদালত তাঁকে ১৪ দিনের রিমান্ডে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন। আটকাবস্থায় তাঁকে আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদ করবে পুলিশ। খবর এএফপি, রয়টার্স, সিএনএন ও বিবিসির।
এদিকে সেনা অভ্যুত্থানের তৃতীয় দিনে গতকাল বুধবার থেকে মিয়ানমারের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদ-বিক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করেছে। সেনা শাসনের বিরুদ্ধে অসহযোগের ডাক দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জান্তা সরকারের জন্য কাজ না করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
সু চির নেতৃত্বাধীন দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির (এলএনডি) একজন মুখপাত্র জানান, সু চির বিরুদ্ধে আমদানি ও রপ্তানি আইন ভঙ্গের অভিযোগ আমলে নিয়েছেন আদালত। পুলিশ বলছে, তিনি বেআইনিভাবে ওয়াকিটকি আমদানি করেছেন, যা তাঁর নেপিডোর বাসভবনে পাওয়া গেছে।
ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টের বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নিয়ে তাঁকেও দুই সপ্তাহের রিমান্ডে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত। পুলিশ বলছে, করোনা মহামারির সময় নিষেধাজ্ঞা ভেঙে জনসমাগম করেছেন তিনি।
অবশ্য গত সোমবার অভ্যুত্থানের পর থেকে সু চি বা উইন মিন্ট কাউকেই জনসমক্ষে দেখা যায়নি। তাঁদের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সু চিকে তাঁর নেপিডোর বাসভবনেই আটকে রাখা হয়েছে বলে নানা সূত্রে সংবাদমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে। রিমান্ডকালে তাঁকে সেখানেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে।
তবে অন্তরীণ এই নেত্রীর মুক্তিসহ সেনা শাসনের বিরুদ্ধে বড় বড় শহরের চিকিৎসক ও স্থাস্থ্যকর্মীরা শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। সেনা শাসনের প্রতিবাদে একজন চিকিৎসক চাকরিও ছেড়েছেন। অনেক চিকিৎসক রোগীদের সেবার কথা চিন্তা করে কাজ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও তাঁরা জান্তা সরকারের নতুন মন্ত্রিসভাকে স্বীকৃতি দেবেন না বলে জানিয়েছেন। তাঁরা প্রতিবাদ জানাতে লাল রঙের ফিতা বা রিবন পরছেন। অনলাইন কিংবা অফলাইনে এই কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা জানিয়েছে ইয়াঙ্গুনের বাসিন্দারাও। তারা ফেসবুকে নিজেদের প্রফাইল পিকচার বদলে শুধু ‘লাল’ বা ‘কালো’ রং দিচ্ছে কিংবা তিন আঙুলের স্যালুটের ছবি দিচ্ছে। গত বছর থাইল্যান্ডের বিক্ষোভকারীরা এভাবেই প্রতিবাদ জানিয়েছিল।
ইয়াঙ্গুন ইয়ুথ নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা থিনজার শুনলেই বলেন, ‘অসহযোগের অংশ হিসেবে তরুণরা দেশব্যাপী কর্মসূচি শুরু করেছে। তারা বিশেষ করে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জান্তা সরকারের পক্ষে কাজ না আহ্বান জানাচ্ছে।’
এ ছাড়া ইয়াঙ্গুনের বাসিন্দারা মঙ্গলবার রাতে মোমবাতি জ্বালিয়ে, হাঁড়িকুড়ি ও গাড়ির হর্ন বাজিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে।
এর আগে মঙ্গলবার সু চির দল এনএলডি তাঁকে অবিলম্বে মুক্তি দেওয়ার দাবি জানায়। তারা সামরিক বাহিনীকে গত নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফল মেনে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। ওই নির্বাচনে এনএলডি ৮০ শতাংশ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছে।
জাতিসংঘে চীনের বিরোধিতা : মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের নিন্দা জানাতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের আনা প্রস্তাব আটকে দিয়েছে চীন। গত মঙ্গলবার নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক বসেছিল। তবে এর স্থায়ী সদস্য চীন এতে ভেটো দিয়েছে।
চীনের ভেটো প্রসঙ্গে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের মিয়ানমারবিষয়ক বিশেষজ্ঞ এলিয়ট প্রাসে-ফ্রিম্যান বলেন, “এর মাধ্যমে জেনারেলদের চীন স্পষ্ট করে না হলেও জোরালো সমর্থনের আভাস দিচ্ছে। চীনের আচরণে মনে হচ্ছে, এটা পুরোপুরি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়, যা তাদের চোখে ‘মন্ত্রিসভায় রদবদল’, অন্তত চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম এভাবেই বিষয়টিকে চিত্রিত করছে।”
তিনি বলেন, যদিও নিন্দা প্রস্তাব জানিয়ে জাতিসংঘের বিবৃতি তাৎক্ষণিকভাবে কোনো ফল বয়ে আনবে না, এর পরও এটা ‘আন্তর্জাতিক সুসংহত প্রতিক্রিয়ার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য হতো; যা আপাতত আলোর মুখ দেখছে না বলে মনে হচ্ছে।’
জি-৭-এর ‘উদ্বেগ’ : মিয়ানমারের সেনা অভ্যুত্থানের ঘটনায় ‘গভীর উদ্বেগ’ প্রকাশ করেছে বিশ্বের শীর্ষ ধনী সাত দেশের জোট জি-৭। গতকাল এক যৌথ বিবৃতিতে জি-৭ ভুক্ত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জার্মানি, জাপান, ইতালি ও ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ‘অং সান সু চিসহ অন্যদের আটক ও মিডিয়াকে লক্ষ্যবস্তু বানানো’র ঘটনায় গভীর উদ্বেগ জানান। তাঁরা ‘জারি করা জরুরি অবস্থা দ্রুত প্রত্যাহারসহ নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর, বেআইনিভাবে আটক ব্যক্তিদের মুক্তি, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল’ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
‘অভ্যুত্থান অনিবার্য ছিল’ : সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশটির সেনাপ্রধান মিন অং লাইংয়ের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত হয়েছে। অর্থ, স্বাস্থ্য, স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্রসহ ১১ জন মন্ত্রীর পদে রদবদল করেছেন তিনি। গত মঙ্গলবার তাঁর মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে মিন অং লাইং আবারও বলেন যে ক্ষমতা নেওয়াটা ‘অনিবার্য’ হয়ে পড়েছিল।
সেনা অভ্যুত্থানের পরপর পুরো মিয়ানমার শান্তই ছিল। বড় শহরগুলোর রাস্তায় টহল দিয়েছেন সেনারা। রাতে জারি করা হয়েছিল কারফিউ। তবে গতকাল থেকে নানাভাবে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ জানানো শুরু হয়েছে।
প্রসঙ্গত, মিয়ানমারে সেনা শাসনের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ২০১৫ সালে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে অং সান সু চি ক্ষমতায় আসেন। কিন্তু দুই বছর পর রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর সামরিক বাহিনী নির্মম অভিযান চালায়। এর জেরে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে সু চির ভাবমূর্তি ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্ন হয়। তবে নিজ দেশে তিনি জনপ্রিয়ই ছিলেন। নভেম্বরের নির্বাচনে বিপুল বিজয় সে কথাই বলে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।