আমাদের মনে হয় পৃথিবী বুঝি এক জায়গায় আছে আর সূর্য আমাদের চারপাশে ঘুরছে। আমাদের এরকম মনে হওয়ার কারণ এই যে ভূমণ্ডল বিরাট, নিরেট। এরকম একটা প্রকাণ্ড ভারী জিনিস সাধারণ কোন লাটিমের মতো বন বন করে ঘুরতে পারে না। সে ঘুরতে থাকে ধীরে ধীরে মন্থর গতিতে, কোনো রকম ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজ ও ঝাঁকুনি ছাড়াই।
নিজের অক্ষরেখার ওপর এক পাক ঘুরে আসতে ভূমণ্ডলের লাগে পুরো চব্বিশ ঘণ্টা। এই কারণে তার ঘোরা আমাদের নজরেই পড়ে না। বড় একটা জাহাজে করে যখন সমুদ্রপথে ঘোরে তখনো কিন্তু খেয়াল করতে পার না কখন সেটা ঘুরছে।
অবশ্য এটা ঠিক যে তীরভূমি দৃষ্টিগোচর হলে তাকে দেখে বাঁক বোঝা যায়। কিন্তু তীরভূমি যদি দেখা না যায়? যদি জাহাজটা মাঝসমুদ্রে চলতে থাকে? সেক্ষেত্রে কেবল সূর্যের সাহায্যেই লক্ষ করা যায় যে জাহাজ বাঁক নিল। ধরো ডেকের যে দিকটাতে ছায়া পড়েছে সেই দিক বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ তোমরা দেখতে পেলে তোমাদের গায়ের ওপর রোদ এসে পড়ছে। তার মানে জাহাজ তোমাদের ডেকটাকে সূর্যের দিকে ঘুরিয়ে মোড় নিচ্ছে।
ভূমণ্ডলের বেলায়ও তাই। সূর্য যখন বাড়িঘরের মাথার পেছন থেকে বা পাহাড়ের পেছন থেকে ওঠে তখন একবার মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করে দেখো। মনে হবে সূর্য আকাশের গায়ে ধীরে ধীরে গুড়ি মেরে উঠছে। আসলে কিন্তু বিশাল একটা জাহাজের মতো আমাদের ভূমণ্ডলটা সূর্যকিরণের নীচে ধীরে ধীরে ঘুরছে।
পৃথিবীর যেই অর্ধভাগ সূর্যের দিকে মুখ করে আছে, সূর্য কেবল তাকেই আলোকিত করে। বাকি অর্ধাংশে সেই সময় অন্ধকার। সেখানে তখন রাত। তারপর ভূমণ্ডল যখন ঘুরে যায় তখন যেখানে দিন ছিল সেখানে নেমে আসে রাত, আর যেখানে ছিল রাত সেখানে নামে দিন।
ভূমণ্ডল কীভাবে ঘুরছে তোমরা যাতে আরও স্পষ্ট বুঝতে পার তার জন্য ছবিতে আমরা ভূমণ্ডলকে একটা অক্ষদণ্ড দিয়ে এফোঁড় ওফোঁড় করেছি। আসলে কিন্তু অক্ষদণ্ড বলে কিছু নেই। এই রেখাটিকে আমরা কল্পনা করেছি মাত্র।
পৃথিবীর যে যে প্রান্তে এই কল্পিত অক্ষদণ্ডটি বেরিয়ে থাকার কথা তাকে বলা হয় মেরু। ওপরের বিন্দুটা উত্তর মেরু, নীচেরটা দক্ষিণ মেরু। আর দুই মেরুর মাঝখানে, ভূমণ্ডলের মধ্যদেশের নাম হলো নিরক্ষ বৃত্ত।
আমরা বাস করছি ভূমণ্ডলের ওপরকার অর্ধাংশে, নিরক্ষ বৃত্ত ও উত্তর মেরুর মাঝখানে। এই অর্ধাংশের নাম উত্তর গোলার্ধ। সূর্যকে ঘুরে যেতে পৃথিবীর অনেক সময় লাগে। পুরো একটা বছর লেগে যায় সুর্যের চারদিকে এক পাক ঘুরতে। এই সময়ের মধ্যে নিজের অক্ষদণ্ডের ওপরে পৃথিবী পাক খায়, ৩৬৫ বার। এই কারণে বছরে আছে ৩৬৫টি দিন আর ৩৬৫টি রাত।
সূর্যের মতো চাঁদও প্রতিদিন ওঠে, প্রতিদিন অন্ত যায়। যদি তোমরা বেশ মন দিয়ে তারাদের দিকে তাকিয়ে দেখ, তাহলে লক্ষ করবে যে তারাভরা পুরো আকাশটাও যেন খুব আস্তে আস্তে ঘুরছে। কোনো একটা উজ্জ্বল তারার দিকে ভালো করে নজর দিয়ে দেখ। তারাটা এখন এখানে। এক ঘণ্টা সময়ের মধ্যে সে নজরে পড়ার মতো স্থান পরিবর্তন করবে। আর আগামীকাল ঠিক এই একই সময় পুরো একটা পাক দিয়ে আসার পর তাকে ফের দেখা যাবে তার আগের জায়গায়।
এটা ঘটার কারণ এই যে পৃথিবী সব সময় ধীরে ধীরে ঘোরে। আমরা এই বিশাল নাগরদোলাটায় বসে তার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরপাক খায়। আমাদের তাই মনে হয় আমাদের চারপাশে গোটা পৃথিবীটা, গোটা মহাকাশ ঘুরপাক খাচ্ছে।
পৃথিবীর মেরু নাগরদোলার মাথার মতো। আমরা যদি মেরুপ্রদেশে থাকি তাহলে মেরুতারা বা ধ্রুবতারা সরাসরি আমাদের মাথার ওপর দেখতে পাব। তোমাদের মনে আছে আমরা এর কথা বলেছিলাম? তাহলে দেখতে পাচ্ছ এই সেই ‘পেরেক’।
ভূমণ্ডল ধীরে ধীরে ঘোরে। আমাদের মাথার ওপরকার পুরো আকাশটা যেন ঘুরপাক খেতে খেতে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। কিন্তু ধ্রুবতারা একই জায়গায় স্থির হয়ে আছে।
তারাভরা আকাশকে সম্পূর্ণ অন্যরকম দেখাবে যদি আমরা মেরুপ্রদেশ থেকে সরে আসি নিরক্ষ বৃত্তে। এখান থেকে ধ্রুবতারা দেখলে মনে হবে যেন উত্তর মেরুর দিককার দিগন্তের ওপর স্থির হয়ে পড়ে আছে। নিরক্ষ বৃত্তে দাঁড়িয়ে যদি আমরা পূবের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পারি থিয়েটারের বিশাল পর্দার মতো তারাভরা আকাশ তার মহিমাদীপ্ত রূপ নিয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে; এদিকে পশ্চিমে তারাগুলো ঠিক একই রকম খাড়াভাবে নেমে যাচ্ছে দিগন্তের দিকে।
নিরক্ষ বৃত্তে সূর্য ও চাঁদ কী ভাবে অন্ত যায় তা লক্ষ করাও কৌতূহলোদ্দীপক। তারাদের মতো সূর্য আর চাঁদও নেমে যায় একেবারে খাড়াভাবে। দেখে মনে হয় কেউ যেন তাদের একটা সূতোয় ঝুলিয়ে রেখেছিল, এখন ডুবোচ্ছে দিগন্তের ওপাশে।
আমরা যেখানে বাস করি সে জায়গাটা মেরু প্রদেশও নয়, নিরক্ষ বৃত্তও নয়। আমরা বাস করি মাঝখানে। তাই ধ্রুবতারাও আমাদের মাথার ওপর দেখা যায় না, দেখা যায় তার থেকে খানিকটা নীচে। এই কারণে আমাদের এই অংশে চন্দ্র-সূর্য যখন ওঠে তখন মনে হয় যেন পাহাড়ের ঢাল বয়ে আস্তে আস্তে ওপরে উঠছে, আবার অন্ত যাওয়ার সময় ঢাল বয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে নামে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।