রঞ্জু খন্দকার : উত্তরাঞ্চলে রমজান মাসে সেহরিতে ডেকে তোলার জন্য একসময় বাজানো হতো কাসার প্লেট। পরে আসল মাইকিং। কালক্রমে সেটাও বিলুপ্ত হওয়ার পথে।
তবে গাইবান্ধা জেলার কোনো কোনো এলাকায় এখনো সেহরির সময় কান পাতলে শোনা যায়– ‘ওঠো, ওঠো, আল্লাহর বান্দারা। সেহরি খাওয়ার সময় হয়েছে। এখন সময়…। নিজে জেগে উঠুন, অন্যকে জাগিয়ে তুলুন।’
এবার রমজান এসেছে সপ্তাহ হতে চলল। এবারও গাইবান্ধায় শেষ রাতে মাইক নিয়ে বের হচ্ছেন কেউ কেউ। উদ্দেশ্য, রোজাদারদের জাগিয়ে তোলা।
যদিও প্রযুক্তির এই কালে শেষ রাতে এই মাইকিংয়ের আদৌ প্রয়োজন আছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে, তবুও অনেককে তা করে তুলছে স্মৃতিকাতর।
পলাশবাড়ী উপজেলার কুমারগাড়ী গ্রামের বাচ্চু ব্যাপারী (৭৫) স্মৃতিকাতর ব্যক্তিদের একজন। তিনি নিজেও একসময় শেষ রাতে রোজাদারদের ডেকে তুলতেন।
বাচ্চু বলেন, তিনি আজ থেকে ৩৫-৪০ বছর আগে মানুষজনকে ডেকে তুলতেন। তখন অবশ্য ঘরে ঘরে ঘড়ি ছিল না। মাইকও তেমন পাওয়া যেত না। হেঁটে হেঁটে কাসার প্লেট বাজিয়ে লোকজনকে ডাকতেন তিনি।
‘কাসার প্লেট বাজিয়ে অবশ্য বেশি মানুষকে জাগিয়ে তোলা সম্ভব হতো না। এ কারণে তখন পাড়ায় পাড়ায় প্লেট বাজানো হতো। যারা আগে টের পেতেন, তারা অন্যদের জাগিয়ে তুলতেন,’ জানান বাচ্চু ব্যাপারী।
মাইকের প্রচলন বাড়ার পর থেকে বাচ্চু ব্যাপারীর কাজ আস্তেধীরে ‘নাই’ হয়ে যায়। তিনি বলেন, তখন আশপাশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে ভ্যানে করে মাইক নিয়ে লোকজন বের হওয়া শুরু করেন। তারা মাইক বাজিয়ে কয়েক গ্রামের মানুষকে ডেকে তোলা শুরু করেন।
কয়েকজন রোজাদার জানান, পলাশবাড়ী উপজেলার তালুক ঘোড়াবান্ধা ও পবনাপুর এলাকা থেকে দুটি দল দীর্ঘদিন আশপাশের কয়েক গ্রামের মানুষকে মাইক বাজিয়ে ডেকে তোলার কাজ শুরু করেন। পরে মসজিদের মাইকগুলোও ডেকে তোলার কাজে লেগে পড়ে। সময়ের স্রোতে ঘরে ঘরে আসে ‘অ্যালার্ম’ ঘড়ি। আরও পরে আসে মুঠোফোন। তাতেও বাজে ঘড়ি। ফলে মাইকে ডাকাডাকির চাহিদা আরও কমে যায়।
জানতে চাইলে তালুক ঘোড়াবান্ধার দলটি জানায়, তারা বংশ পরম্পরায় এই কাজ করে আসছেন। আগে তাদের মাইকের শব্দ শুনতে না পেলে অনেকে ঠিক সময়ে সেহরি খেতে পেতেন না। অবশ্য এখন সেই যুগ নেই। তবু কিছু কিছু বয়স্ক মানুষ ঘড়ি বা মোবাইলের অ্যালার্ম দিতে পারেন না। তাদের জন্য হলেও মাইকিংয়ের দরকার আছে। এতে দুয়েকজনের উপকার হলেও এই পরিশ্রম সার্থক হবে বলে মনে করেন তারা।
গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার ডুমুরগাছা গ্রামটা পলাশবাড়ীর কুমারগাড়ীর লাগোয়া। এই গ্রামের একাংশের লোকজনকেও মাইকে ডেকে তুলত পবনাপুর ও তালুক ঘোড়াবান্ধার দলের লোকজন।
ডুমুরগাছার শামসুল আলম বলেন, তিনি নিজে ছোটবেলা থেকে মাইকের ডাকেই মা-বোনদের জেগে উঠতে দেখেছেন। মায়েরা গভীর রাতে উঠে রান্না বসাতেন। সেই খাবার খেয়ে রোজা রাখতেন তারা। কোনোদিন মাইকের শব্দ শুনতে না পেলে ঘুম থেকে জেগে উঠতে দেরি হতো। তখন সেহরিও অনেক সময় খাওয়া হতো না।
তবে প্রযুক্তির এই যুগে মাইকে ডেকে তোলার প্রয়োজনীয়তা কতটুকু– সে প্রশ্ন তোলেন শামসুল।
এ বিষয়ে একই গ্রামের এফায়েচ উদ্দিন (৭৫) বলেন, যদিও এখন ঘরে ঘরে অ্যালার্ম ঘড়ি। তবুও তার মতো কিছু বয়স্ক লোক এসব ঘড়ি অত ভালো বোঝেন না। সে ক্ষেত্রে এখনো মাইকে ডেকে তোলার লোকের প্রয়োজনীয়তা একেবারে ফুরিয়ে যায়নি বলেই মনে হয়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।