রঞ্জু খন্দকার, গাইবান্ধা থেকে: ‘এংকা দিনত কোষ্টার (পাট) ভাড় বাঁংকত (বাঁশের তৈরি ভাড় বহনের বাঁক) কর্যা নিয়্যা হাটত গেচি। হাটত সেই কোষ্টা বেচে ইলশ্যা কিনচি। সেই ইলশ্যা বাঁংকত কর্যা বান্ধ্যা বাড়িত আচ্চি। সেগল্যা দিন আর নাই, বাহে।’
একসময়ের সোনালি আঁশখ্যাত পাটের সোনালি দিন নিয়ে এমন আক্ষেপ কৃষক ইদ্রিস আলী মণ্ডলের (৫৫)। ইদ্রিসের বাড়ি গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার কুমারগাড়ী গ্রামে।
ইদ্রিস আলীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল কুমারগাড়ীর ছাতিয়ানতলা বাজারে। সেখানে পাশাপাশি দুটি উপজেলার কয়েকটি গ্রামের মানুষের আনাগোনা। তাঁদের অনেকেও হারিয়ে যাওয়া পাটের সোনালি দিন নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন।
পাশের গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার ডুমুরগাছা গ্রামের এফায়েচ উদ্দিনও (৬৫) ছিলেন ছাতিয়ানতলা বাজারে। তিনি বলেন, পাট নিয়ে তাঁরা হেঁটেই বগুড়ার মোকামতলা, মহাস্থানগড়, গাইবান্ধার ফাঁসিতলা, গোলাপবাগ, ফুলছড়ি হাট করেছেন। তখন দাম অনেক বেশি ছিল। পাট বেচে তাঁরা স্ত্রী-সন্তানদের জন্য শাড়ি-কাপড় কিনতেন।
কৃষকেরা এমন সোনালি স্মৃতির পসরা খুলে বসেন এবার পাট নিয়ে নানা দুর্ভোগের কারণে। বৈশ্বিক ও জাতীয় কারণে এমনিতেই দিনের পর দিন এই অঞ্চলে পাটের আবাদ কমেছে। তার ওপর এখন পাট নিয়ে নতুন সংকট দেখা দিচ্ছে। জাগ দেওয়ার জন্য পাওয়া যাচ্ছে না পর্যাপ্ত পানি। বাজারে এবার দামও কম।
ডুমুরগাছা গ্রামের পাটচাষি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, তিনি অল্প জমিতে এখনও পাটের আবাদ করেন। কিন্তু জাগ দেওয়ার জন্য জায়গা পাচ্ছেন না। খোলা পুকুর-ডোবা কমে গেছে। যাদের আছে, তাঁরাও জাগ দিতে দিচ্ছেন না।
এই কথার জবাব পাওয়া গেল কুমারগাড়ী গ্রামের আব্দুল হাইয়ের কথায়। তাঁর ভাষ্য, তাঁর নিজেরই একটা ডোবা আছে। আগে সেটি খোলা ছিল। বাইরের পানি ঢুকত। বেরও হতো। কিন্তু এখন সেটির চারপাশে পাড় দেওয়ায় বাইরের পানি ঢোকা-বের হওয়ার সুযোগ নেই। আর বদ্ধ জলাশয়ে জাগ দিলে পাটপচা পানি বের হতে পারে না। ফলে ওই পুকুরে মাছও তেমন হয় না। এখন নিজের মাছ নষ্ট করে তিনি জাগ দিতে দেবেন কেন?
পাটের দাম নিয়েও কৃষকদের কথায় ঝরে পড়ল হতাশা। আশপাশের কয়েকটি হাট ঘুরে তাঁরা দেখেছেন, পাটের দামও এবার কম। গতবারও পাট মানভেদে প্রায় তিন হাজার টাকা মণ বিক্রি হয়েছে। এবার ভালো মানের পাটের দামও মণপ্রতি সর্বোচ্চ ২২শ থেকে ২৫শ টাকা।
গোবিন্দগঞ্জের নাকাইহাট ঘুরে জানা যায়, নিম্নমানের পাটের দাম মণে ১৪-১৫শ টাকা। মাঝারি মানের পাটের দাম ১৮শ থেকে ২ হাজার টাকা। আর ভালো মানের পাট মণপ্রতি ২২শ থেকে আড়াই হাজার টাকা।
এ হাটে পাট বেচতে এসেছিলেন পাটোয়া গ্রামের মফিজ উদ্দিন। তিনি বলেন, তাঁর কয়েক বিঘা জমিতে পাটের আবাদ। ফলনও ভালো হয়েছে। কিন্তু পাটের যে দাম, তাতে উৎপাদন খরচও তোলা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
গাইবান্ধা সদর উপজেলার তুলশীঘাট হাট এ অঞ্চলে পাটের বড় মোকাম। এখানে পাট বিক্রি করতে এসেছিলেন পলাশবাড়ীর ঘোড়াবান্ধা গ্রামের আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, এবার বিঘাপ্রতি পাটখেতে খরচ হয়েছে প্রায় ২০ হাজার টাকা। তাতে প্রতি মণ পাটের উৎপাদন খরচ পড়েছে ২ হাজার টাকার বেশি। কিন্তু তাঁর পাটের দাম ১৮শ টাকা করে বলছে। তাতে পাট বিক্রি করে লোকসান হবে।
ফিরি ছাতিয়ানতলা বাজারে। সেখানকার কৃষকদের ভাষ্য, সোনালি আঁশ বিক্রি করে রুপালি ইলিশ কেনার সেইদিন আর ফিরবে বলে মনে হয় না। এখন দৈনন্দিন দরকারেও কৃষকের আর পাট তেমন কাজে লাগে না। পাটের রশির জায়গায় এসেছে নাইলন, প্লাস্টিকের রশি। ব্যাগের জায়গা নিয়েছে নিষিদ্ধ পলিথিন। সরকার যদি এসব দিকে মনোযোগ না দেয়, তবে পাটচাষ যেটুকু আছে, সেটাও হারিয়ে যেতে পারে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।