আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ‘প্রজেক্ট নিওম’ সৌদি আরবের ৫০০ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে ২৬ হাজার ৫০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নির্মাণ হতে যাওয়া একটি বিশেষ শহর। এই প্রকল্পের অধীনে দেশটির উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল, আকাবা উপসাগর এবং সৌদি আরবের লোহিত সাগরের উপকূল বরাবর একটি মেগা শহর নির্মাণ করা হচ্ছে। এমন কোন সুযোগ-সুবিধা নেই যা এখানে থাকবে না। প্রকল্পটিকে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ‘স্বপ্নের শহর’ বলে অভিহিত করেছেন। তবে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কেউ বাধা হয়ে দাঁড়ালে তাকে হত্যা করারও নির্দেশ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম বিবিসি জানিয়েছে, দেশটির একজন সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেছেন, সৌদি কর্তৃপক্ষ নির্মাণ হতে যাওয়া শহরের জন্য জমি খালি করতে হত্যার অনুমতি দিয়েছে। যদিও এই বিষয়ে সৌদি সরকার ও নিওম ব্যবস্থাপনা কমিটি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
কর্নেল রাবিহ আলেনেজি বলেছেন, নিওম ইকো-প্রকল্পের অংশ ‘দ্য লাইনের’ জন্য জমি খালি করতে তাকে উপসাগরীয় রাজ্যের একটি উপজাতি গোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তিনি জানান, উচ্ছেদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় তাদের একজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
‘দ্য লাইন’ হল ‘প্রজেক্ট নিওম’ এর একটি উপ-প্রকল্প যেখানে ১০ লক্ষ বাসিন্দা থাকতে পারবেন। এই শহরটির হবে ২০০ মিটার চওড়া এবং ১৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ। শহরটিতে কোন ধরনের গাড়ি থাকবে না। ২০৩০ সালের মধ্যে এই প্রকল্পের মাত্র ২ দশমিক ৪ কিলোমিটার কাজ সম্পূন্ন হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশ্বের একাধিক প্রতিষ্ঠান শহরটি নির্মাণে কাজ করছে।
যে এলাকায় নিওম নির্মাণ করা হচ্ছে সেটিকে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান “খালি ক্যানভাস” হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তার সরকারের মতে, এই প্রকল্পের জন্য ৬ হাজার লোককে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। তবে যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক মানবাধিকার গ্রুপ এএলকিউএসটি অনুমান করেছে যে সংখ্যাটি আরও বেশি।
ভেঙে দেয়া তিনটি গ্রাম আল-খুরায়বাহ, শর্মা এবং গায়ালের স্যাটেলাইট ছবি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গ্রামগুলোতে থাকা বাড়ি, স্কুল, হাসপাতালের কিছুই আর নেই। দেশটি থেকে পালিয়ে যুক্তরাজ্যে আশ্রয় নেয়া কর্নেল আলেনেজি বলেছেন, তিনি যেই নির্দেশ পেয়েছিলেন তা ছিল আল-খুরায়বাহ গ্রামের জন্য। সেখানে হুওয়াইতাত উপজাতির সদস্যরা বংশ পরম্পরায় বসবাস করে আসছে।
তিনি বলেন, ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে দেয়া আদেশে বলা হয়েছিল, হুওয়াইতাতে অনেক বিদ্রোহী রয়েছে এবং যে উচ্ছেদ কার্যক্রমে বিরোধিতা করবে তাকে হত্যা করা উচিত। তিনি জানান, আব্দুল রহিম আল-হুওয়াইতাত নামের একজন জমি দিতে অস্বীকৃতি জানানোর একদিন পরে সৌদি কর্তৃপক্ষ তাকে গুলি করে হত্যা করে। তিনি এর আগে উচ্ছেদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় একাধিক ভিডিও পোস্ট করেছিলেন।
সেই সময়ে সৌদি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষ থেকে জারি করা একটি বিবৃতি অভিযোগ করা হয়েছে, আল-হুওয়াইতাতরা নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর গুলি চালিয়েছিল এবং তারা পাল্টা জবাব দিতে বাধ্য হয়েছিল। মানবাধিকার সংস্থা এবং জাতিসংঘ বলেছে, তাকে উচ্ছেদ কার্যক্রমে প্রতিরোধ জানানোয় হত্যা করা হয়েছে।
জাতিসংঘ এবং এএলকিউএসটি জানিয়েছে, উচ্ছেদে বাধা দেয়ায় অন্তত ৪৭ জন গ্রামবাসীকে আটক করেছে কর্তৃপক্ষ। যাদের মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস-সম্পর্কিত অভিযোগ এনে বিচার করা হয়েছে। এদের মধ্যে পাঁচজনকে মৃত্যুদণ্ডও দেয়া হয়েছে।
সৌদি কর্তৃপক্ষ বলছে, যাদের দ্য লাইনের জন্য জমি ছেড়ে দিতে হবে তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দেখা গেছে এই ক্ষতিপূরণ প্রতিশ্রুতি দেয়া পরিমাণের চেয়ে অনেক কম। কর্নেল আলেনেজির মতে, নিওম হল মোহাম্মদ বিন সালমানের চিন্তাধারার কেন্দ্রবিন্দু। এজন্যই তিনি হুওয়াইতাতদের সাথে মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে এত নৃশংস ছিলেন।
নাদের হিজাজি (ছদ্মনাম) আজিজিয়া গ্রামের বাসিন্দা। দ্য লাইনের জন্য তার গ্রামের ৬৩ বাড়ি ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। তার বাবার বাড়িটি ২০২১ সালে গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। বাড়ি থেকে সরে যেতে তাকে এক মাসেরও কম সময় আগে সতর্ক করা হয়। তিনি বলেন, তারা একটি যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি করেছে। তারা মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, আমাদের পরিচয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে।
এএলকিউএসটি জেদ্দার আশেপাশের এলাকা থেকে ৩৫ জন উচ্ছেদ করা লোকের ওপর একটি জরিপ করেছে। সবাই জানিয়েছে যে তারা স্থানীয় আইন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ বা পর্যাপ্ত সতর্কতা পায়নি এবং অর্ধেকেরও বেশি বলেছে যে গ্রেপ্তারের হুমকি দিয়ে তাদের বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে।
কর্নেল আলেনেজি এখন যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন কিন্তু এখনও তিনি তার নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। তিনি বলেন, একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা তাকে বলেছিলেন যে যদি তিনি সৌদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে লন্ডনের সৌদি দূতাবাসে একটি বৈঠকে যোগ দেন তবে তাকে ৫ মিলিয়ন ডলার দেয়া হবে। কর্নেল আলেনেজির বলেন, মোহাম্মদ বিন সালমান নিওমের পথে কোন কিছুই দাঁড়াতে দিবেন না।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।