২০ সেপ্টেম্বর, ১৫১৯ সাল। স্পেনের সেভিল বন্দর থেকে ছাড়ল পাঁচটি ছোট্ট জাহাজের একটি স্কোয়াড্রন। জাহাজগুলোর নাম সান আন্তনিও, ট্রিনিদাদ, কনসেপসিয়ন, ভিকটোরিয়া ও সান্তিয়াগো। অফিসার এবং নাবিক মিলিয়ে সবসহ যাত্রা করে ২৩৯ জন, ফেরে মাত্র কয়েকজন।
স্প্যানিশ স্কোয়াড্রনটির অধিনায়ক এ্যাডমিরাল ম্যাগেলান। জন্মসূত্রে তিনি স্পেনের লোক নন, প্রতিবেশী পর্তুগাল থেকে এসেছেন। যে কর্তব্যকর্ম ফার্দিনান্দ দ্য ম্যাগেলান নিজের সামনে রাখেন, তা দুরূহ। সেটি হলো, আটলান্টিক মহাসমুদ্র থেকে প্রশান্ত মহাসাগরে যাওয়ার একটি পথ বের করা।
মানচিত্রে একবার চোখ বোলাও। দুটি মহাসমুদ্রের মাঝে বিরাট আমেরিকা (যুক্তরাষ্ট্র) মহাদেশ, সুমেরু মহাসমুদ্রের (উত্তর মহাসাগর) তুষারাবৃত্ত জল থেকে কুমেরু সমুদ্র (দক্ষিণ বা অ্যান্টার্কটিক মহাসাগর) পর্যন্ত তার বিস্তার। সে সময় আমেরিকার পশ্চিমবর্তী মহাসমুদ্রটি আবিষ্কৃত হয়েছে, তার নামকরণ করা হয় বৃহৎ দক্ষিণ সমুদ্র।
ম্যাগেলানের আগেও সমুদ্রযাত্রীরা নতুন অজানা মহাসমুদ্রটিতে হানা দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু যেখানেই তাঁরা যান, বিষুবরেখা থেকে উত্তরে বা দক্ষিণে, তাঁদের পথ রোখে আমেরিকা মহাদেশ। প্রায় সবাই ভাবত যে আটলান্টিক মহাসমুদ্র থেকে এই বৃহৎ দক্ষিণ সমুদ্রে যাওয়া অসম্ভব।
কথাটা মেনে নেননি ম্যাগেলান। তাঁর সন্দেহ ছিল না যে দক্ষিণে কোথাও একটি প্রণালী দুটি মহাসমুদ্রকে যুক্ত করেছে। লোকবল এবং জাহাজ পেলে প্রণালীটি বের করার ভার তিনি নেবেন বলেন। নিজ দেশ পর্তুগালে জাহাজ ও লোকজন জোগাড়ের চেষ্টা বহু বছর করে তিনি ব্যর্থ হন। স্বদেশ ছেড়ে তাই যেতে হলো স্পেনে। সেখানে তাঁকে বিশ্বাস করে, এমন লোকের সন্ধান মিলল। তাঁকে দেওয়া হলো একটি স্কোয়াড্রনের ভার।
অদৃষ্টপূর্ব এমন একটি যাত্রায় স্প্যানিশ অভিযানের নেতা এই ভাবে হলেন পর্তুগালের ম্যাগেলান (পর্তুগীজ ভাষায় মাগেলহায়েনস)। যাত্রা সফল হলে বিশাল সম্পদের আধকারী হবেন ম্যাগেলান: স্পেনের রাজার সঙ্গে একটি চুক্তি শর্তে নব-আবিষ্কৃত সব দেশের শাসকপদ তিনি পাবেন, আর পাবেন সেসব দেশ থেকে পাওয়া লাভের বিশ ভাগের এক ভাগ। কিন্তু উচ্চ পদ আর সম্ভাব্য সম্পদের জন্য বড় একটা দাম দিতে হয় তাঁকে: বিদেশির অধীনে নিযুক্ত গর্বিত স্প্যানিশ ক্যাপ্টেন তাঁকে হিংসা করত, সুযোগ পেলে তাঁকে সাবাড় করার শপথ গ্রহণ করে তারা।
ম্যাগেলানের আশা ছিল, তিনি সব সংশয়গ্রস্ত লোকের কাছে দৃঢ়ভাবে প্রমাণ করবেন যে পৃথিবী বলের মতো গোল। সে সময় কিন্তু কয়েকজন মাত্র পণ্ডিত পৃথিবীর আকার নিয়ে মাথা ঘামাতেন। রাজরাজড়া বা সওদাগরদের এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা ছিল না। তাদের একমাত্র চিন্তা—ম্যাগেলানের অভিযান সফল হলে অঢেল মুনাফা পাওয়া যাবে। তোমাদের হয়তো মজার মনে হবে, এমনকি বিদঘুটে ঠেকবে যদি কোনো দোকানদারকে বলতে শোন: ‘ওহে যা কিনলে, তার জন্য বিশটে গোলমরিচদানা পাওনা রইল।’
একসময় টাকা হিসেবে চল ছিল গোলমরিচের, তখন ধার শোধ করা হতো, খাজনা দেওয়া হতো গোলমরিচে, গোলমরিচ দিয়ে কেনা হতো বাড়ি, খামার, জাহাজ। এখনকার দিনে বড়লোকদের বলা হয় ‘টাকার থলে’, কিন্তু আগের দিনে এদের নাম ছিল ‘গোলমরিচের থলে’।
আর এই সব দিনে ম্যাগেলান রওনা দিলেন তাঁর সুবিখ্যাত যাত্রায়। প্রাচ্যের মশলা, গোলমরিচ, দারুচিনি আর আদা লাগত বড়লোকদের খাবারে, খাদ্য হতো ঝাঁঝালো আর রসালো, আর রসালো খাবার তো হজমি জিনিস। ওষুধ তৈরি করিয়েদের অতি নিখুঁত নিক্তিতে মশলা ওজন করা হতো, প্রতিটি দানার মূল্য অনেক। প্রাচ্যের নানা ওষুধের, যেমন কর্পুরের বিশেষ সমাদর ছিল, অথচ যেসব দেশে এগুলো জন্মাত অর্থাৎ ভারত এবং মালাক্কাদ্বীপপুঞ্জে (মশলা দ্বীপপুঞ্জ) এরা বিকোত ইউরোপের যইশস্য বা মটরের দামে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।