তাকী জোবায়ের : ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মো. জামিনুর রহমানের স্বেচ্ছাচারের কবলে পড়েছে সরকারি খাতের পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক। নিয়োগ-পদোন্নতি-বদলি-ক্রয়সহ সকল খাতে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ থাকার পরও বাহুবলে পদ আকড়ে থাকার চেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি।
তাঁর বিরুদ্ধে বিক্ষোভে নামলে ‘বহিরাগতদের’ দিয়ে কর্মকর্তাদের ওপর হামলা করার ঘটনাও ঘটেছে।
এই হামলায় ব্যাংকটির বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা আহত হলেও মুঠোফোনে এমডি বলেছেন, ‘আহত তো হবেই। দুই চারটা মারা যায়নি, এটা ভাগ্য।’
পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের বিক্ষুব্ধ কর্মকর্তাদের অভিযোগ, ব্যাংকটির চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত এমডি শেখ মো. জামিনুর রহমান ব্যাংকটির সিস্টেম এনালিস্ট আল্লামা মোহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া তানহার ও মো. শাহেদ আলমগীরকে নিয়ে সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। তারা ক্ষমতার ব্যাপক অপব্যবহার ও সীমাহীন দুর্নীতি, ঘুষ বাণিজ্য, অবৈধ কেনাকাটার সঙ্গে জড়িত। এজন্য তাদের পদত্যাগের দাবিতে বেশ কিছুদিন ধরে আন্দোলন করছেন ব্যাংকটির শতাধিক কর্মকর্তা।
এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৪ আগস্ট ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করলে ঢাকার বাইরে থেকে আসা ফিল্ড অফিসার ও বহিরাগতরা আন্দোলনকারী কর্মকর্তাদের ওপর ‘সন্ত্রাসী কায়দায়’ হামলা করে। এতে কয়েকজন আহত হয় যাদের মধ্যে একজন এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
আন্দোলন দমাতে ঢাকার বাইরে থেকে ফিল্ড অফিসারদের প্রধান কার্যালয়ে ডেকে আনা হয়েছে বলে অভিযোগ ব্যাংকটির কর্মকর্তাদের।
এই প্রসঙ্গে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের এমডি এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে নিজে থেকেই বলেছেন, ‘আট হাজার ফিল্ড অফিসার এখন ঢাকায়। এদের অনেকেই প্রধান কার্যালয়ের ফ্লোরে ঘুমাচ্ছে। আরো লোক এখনো আসছে। আর আন্দোলনকারী মাত্র একশ।’
তাদেরকে কেন ডেকে এনেছেন- জানতে চাইলে বলেন, ‘আমি ডেকে আনিনি। তারা শুনেছে এমডিকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। সেজন্য এসেছে।’
ইতোমধ্যে ৩৭ জন আন্দোলনকারী কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে ঢাকার বাইরে বদলি করেছেন শেখ মো. জামিনুর রহমান। ১৮ আগস্টের মধ্যে কর্মক্ষেত্রে যোগ না দিলে তারা স্থায়ীভাবে বরখাস্ত হবেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
তাদেরকে বরখাস্ত করে বদলি করার কারণ জানতে চাইলে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের এমডি বলেন, ‘আমারতো কন্ট্রোল করতে হবে। পুরো ব্যাংক কন্ট্রোলে নিতে হবে। আমি যদি তাদের বরখাস্ত এবং বদলির অর্ডার পরিবর্তন করি, তাহলে যে ৮ হাজার লোক ঢাকায় এসেছে তারা আমার কথা শুনবে না।’
ইতোমধ্যে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের এমডির অনিয়মের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে স্বারকলিপি এবং অর্থ উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে অভিযোগপত্র দিয়েছেন ব্যাংকটির সংক্ষুব্ধ কর্মকর্তাগণ।
এমডির অপসারণের দাবিতে রোববার সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করেছেন ব্যাংকটির কর্মকর্তারা। সংবাদ সম্মেলন শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকে এসে গভর্নরের কাছে স্বারকলিপি দিয়ে গেছেন তারা।
ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, শেখ মো. জামিনুর রহমান ২০২২ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের এমডি পদে চুক্তিভিত্তিক দায়িত্ব পালন করে আসছেন। গত ৭ এপ্রিল প্রথম দফা মেয়াদ শেষে তাঁকে আবার দুই বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের ‘একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প’-এর যাত্রা শুরু হয়। তবে ২০০১ সালে বিএনপি সরকার গঠনের পর প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যায়।
এরপর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর এর কার্যক্রম আবার শুরু হয়। প্রকল্পটিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে ২০১৪ সালে আলাদা আইনের মাধ্যমে গঠিত হয় পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক। সারাদেশে ৪৯৫টি শাখা রয়েছে। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানের কর্মী সংখ্যা প্রায় ১২ হাজার। এদের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটি (বিএসসি) সচিবালয়ের মাধ্যমে অল্পসংখ্যক সিনিয়র অফিসার, সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার ও প্রিন্সিপাল অফিসার পদে নিয়োগ হয়েছে। বেশির ভাগ নিয়োগ, পদায়ন, পদোন্নতি হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়।
কর্মকর্তারা জানান, ব্যাংকের আইসিটি বিভাগের সিস্টেম অ্যানালিস্ট ও আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানকের ঘনিষ্ঠ আল্লামা ইয়াহিয়া তানহা এমডির আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বিভিন্নভাবে কর্মীদের ওপর চাপ প্রয়োগ করতেন। তার মাধ্যমেই বিভিন্ন কেনাকাটায় দুর্নীতি এবং নিয়োগ-পদোন্নতিতে অনিয়মের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া টাকার বিনিময়ে ৭২ জন নিরাপত্তারক্ষী ও ৪৯২ জন অফিস সহায়ক নিয়োগ দেওয়া হয়। সরকার বদলের পর অবিলম্বে তাঁকে বদলির দাবি জানানো হলে বিক্ষোভ দমনের নামে এমডি ভুল বার্তা দিয়ে সারাদেশ থেকে চার হাজারের মতো লোক ঢাকায় জড়ো করেছেন।
একই সঙ্গে গত বৃহস্পতিবার প্রধান কার্যালয়ের ৩৬ জন কর্মকর্তাকে এক দিনের নোটিশে দেশের বিভিন্ন শাখায় বদলি করা হয়েছে। আজ তারা বদলীকৃত স্থানে যোগদান না করলে তাদের স্থায়ী বহিষ্কার হিসেবে গণ্য হবে বলে আদেশ দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকে দাখিলকৃত অভিযোগপত্রে ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ চাহিদার বিপরীতে অবৈধভাবে উচ্চমূল্যে অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটা করে ব্যাংকের অর্থ ও সম্পদের ক্ষতি, স্বেচ্ছাচারিতা, রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্বৃত্তায়ন, অভ্যন্তরীণ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় উত্তরপত্র টেম্পারিংয়ের মাধ্যমে ঘুষ বাণিজ্যি, অর্থের বিনিময়ে বদলি-পদোন্নতি-নিয়োগ, মামলা বাণিজ্য, অর্থের বিনিময়ে শাস্তি মওকুফসহ প্রতিষ্ঠানটির সকল সেক্টরে দুর্নীতি ও ঘুষ বাণিজ্যের মাধ্যমে বিপুল অবৈধ সম্পদ গড়ে তোলার বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে।
অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, ছুটির দিন শুক্রবার ব্যাংক বন্ধ থাকলেও অর্থের বিনিময়ে জেলা কর্মকর্তাদের শাখা ব্যবস্থাপক হিসেবে পদোন্নতি দিয়েছেন তিনি। কিন্তু, অর্ডারে উল্লেখ করেছেন ১৫ আগস্ট (বৃহস্পতিবার)।
এছাড়া, তাড়াহুড়ো করে জনপ্রতি ৩ লাখ টাকার বিনিময়ে মাঠকর্মীদের পদোন্নতি দেওয়ার প্রক্রিয়াও চালাচ্ছেন তিনি। সম্প্রতি ৪৯২ জন অফিস সহকারী ও ৭২ জন নিরাপত্তা প্রহরী নিয়োগে বাণিজ্য করেছে এমডির সিন্ডিকেট। এই নিয়োগে জনপ্রতি ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা করে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ করেছেন সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
আরও অভিযোগ রয়েছে, ব্যাংকের প্রত্যেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর হোম লোন অনুমোদনের জন্য ২ লাখ টাকা করে কমিশন নেওয়া হয়। মোটরসাইকেল লোন দেওয়ার সময় কমিশন নেওয়া হয় ৩০ হাজার টাকা। ব্যাংকের ল্যাপটপ ২ লাখ টাকা করে ক্রয়মূল্য দেখানো হয়েছে, যার বর্তমান বাজারমূল্য মাত্র ৭০ হাজার টাকা। প্রধান কার্যালয়ে ট্রেনিংয়ে অংশগ্রহণকারী এমপ্লয়িদের দুপুরের খাবার বাবদ ৪০০ টাকা বিল করা হয়। অথচ, সরবরাহকৃত খাবারের প্রকৃত মূল্য ১০০ টাকা। কর্মীদের সাসপেনশন তুলতে কমপক্ষে ১ লাখ টাকা নেওয়া হয়। পদ অনুযায়ী বিভিন্ন অঙ্কের টাকার বিনিময়ে (১ থেকে ৫ লাখ) বদলি করা হয়। ব্যাংকের সকল শাখা অফিস, জেলা অফিস ও প্রধান কার্যালয়ে ৬০০ অ্যাটেনডেন্স মেশিন কেনা হয়েছে। যার প্রতিটির প্রকৃত মূল্য ১১ হাজার টাকা। অথচ, বিল দেখানো হয়েছে প্রতিটি ২৮ হাজার টাকা করে। এছাড়া ভুয়া বিল, টেন্ডার বাণিজ্যসহ ব্যাংকের প্রায় প্রতিটি খাতে এমডি অপকর্ম করছেন।
এসব অভিযোগের বিষয়ে এমডি শেখ মো. জামিনুর রহমান বলেন, ‘আমি দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত না। আমি দুর্নীতি করলে ফলাও করে লিখবেন।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।