মক্কার পবিত্র ভূমিতে পদার্পণ করার মুহূর্তটি প্রতিটি মুসলমানের জীবনের সবচেয়ে আবেগঘন অধ্যায়। হাজারো মাইল পথ পাড়ি দিয়ে আল্লাহর ডাকে সাড়া দিতে আসা লাখো মানুষের সমুদ্রে যখন আপনি নিজেকে আবিষ্কার করবেন, তখন বুকে ধাক্কা দেবে এক অনির্বচনীয় অনুভূতি। কিন্তু এই মহান সফরের সাফল্য নির্ভর করে প্রতিটি ধাপে সঠিক নিয়ম মেনে চলার ওপর। হজের সময় করণীয় বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা না থাকলে আধ্যাত্মিক এই যাত্রায় ভুলত্রুটির আশঙ্কা থাকে। এই গাইডে আমরা ধাপে ধাপে জানাবো কিভাবে আপনি হজের প্রতিটি মুহূর্তকে পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করতে পারবেন, বাংলাদেশি হাজীদের বিশেষ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার কৌশলসহ।
হজের সময় করণীয়: ইহরাম থেকে আরাফাত পর্যন্ত সম্পূর্ণ রোডম্যাপ
হজের রীতিনীতি শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়, এটি হৃদয়ের গভীরে প্রবেশকারী এক আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে ১ লক্ষ ২৭ হাজার বাংলাদেশি হজ পালন করেন, যাদের ৩৪% প্রথমবারের মতো এই সফরে অংশ নেন। রিয়াদের প্রখ্যাত হজ গাইড ড. খালিদ আল-রশিদ বলেন, “হজের সময় করণীয় জানা মানে কেবল নিয়ম শেখা নয়, বরং প্রতিটি কর্মের আত্মিক অর্থ উপলব্ধি করা। ইব্রাহিম (আ.)-এর আত্মত্যাগ, হাজেরার ত্যাগ ও মহানবীর (সা.) শিক্ষা প্রতিটি ধাপে জীবন্ত হয়ে ওঠে।
ধাপ ১: ইহরাম ও মিকাত – পবিত্রতার সূচনা
ইহরামের পূর্বপ্রস্তুতি:
- নিয়ত ও তালবিয়া:
“লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারীকা লাকা লাব্বাইক…”
- মিকাত (নির্দিষ্ট সীমানা) অতিক্রম করার আগেই তালবিয়া পাঠ শুরু করতে হবে
- বাংলাদেশি হাজীদের জন্য সাধারণত বিমানেই ইহরাম বাঁধার নির্দেশ দেওয়া হয়
ধাপ ২: মক্কায় পৌঁছে করণীয়
কাবা শরিফে প্রথম দর্শন:
- কাবা দেখার সময় দু’আ: “আল্লাহুম্মা আনতাস সালাম…” (হে আল্লাহ! আপনি শান্তির উৎস…)
- মনকে শান্ত রাখুন, ভিড়ে ধৈর্য ধারণ করুন
- তাওয়াফে কুদুম (আগমনী তাওয়াফ):
- হাজরে আসওয়াদ (কালো পাথর) থেকে শুরু করে ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে ৭ চক্কর
- প্রতিটি চক্করে রুকনে ইয়ামেনি স্পর্শ করা মুস্তাহাব (না পারলে ইশারা)
- শেষে মাকামে ইব্রাহিমে ২ রাকাত নামাজ
ধাপ ৩: জিলহজ্জ ৮ তারিখ – মিনার পথে যাত্রা
- সূর্যোদয়ের পর মিনায় যাত্রা:
- মসজিদুল হারাম থেকে মিনা প্রায় ৮ কিমি (বাস/পায়ে হেঁটে)
- এদিন মিনায় জোহর, আসর, মাগরিব ও এশা নামাজ আদায় (প্রত্যেকটিকে দুই রাকাত করে)
- রাত মিনায় অবস্থান, আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি ও কোরআন তিলাওয়াত
ধাপ ৪: জিলহজ্জ ৯ তারিখ – আরাফাতের মহিমান্বিত দিন
- সূর্যোদয়ের আগেই আরাফাতের উদ্দেশ্যে রওনা:
- আরাফাত ময়দানে অবস্থান হজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রুকন (ফরজ)
- দুপুর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত এখানে অবস্থান
- নবী (সা.)-এর বিদায়ী ভাষণের স্থান (জাবালে রাহমাত) দেখার চেষ্টা করুন
- ব্যক্তিগত তাওবা, দু’আ ও জিকিরে মশগুল থাকুন
- সৌদি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ: ছাতা ব্যবহার করুন, ORS পান করুন
ধাপ ৫: মুজদালিফায় রাতযাপন
- সূর্যাস্ত পর মিনার উদ্দেশ্যে যাত্রা:
- মাগরিব ও এশা নামাজ একসাথে আদায় (মক্কাবাসী ছাড়া)
- মুজদালিফার মাটি থেকে ৪৯টি বা ৭০টি কঙ্কর সংগ্রহ
- ভোররাতে মিনায় ফেরার আগে সংক্ষিপ্ত বিশ্রাম
ধাপ ৬: জিলহজ্জ ১০ তারিখ – কোরবানির দিন
- জামারাতে আকাবা (বড় শয়তান)-কে কঙ্কর মারার মাধ্যমে শুরু:
- সকাল ১০টার পর থেকে কঙ্কর নিক্ষেপ (৭টি)
- কোরবানি দেওয়া (নিজে বা অন্যের মাধ্যমে)
- মাথা মুণ্ডন/চুল ছাঁটা (পুরুষের জন্য মুণ্ডন উত্তম)
- ইহরাম খুলে সাধারণ পোশাক পরা
- তাওয়াফে জিয়ারত (হজের তাওয়াফ) ও সাঈ সম্পন্ন করা
হজের সময় যে ৭টি ভুল ৯০% হাজীই করেন – এবং কীভাবে এড়াবেন
বাংলাদেশ হজ অফিসের ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৬৮% প্রথমবারের হাজী গুরুত্বপূর্ণ কিছু না কিছু ভুল করেন। জেদ্দার অভিজ্ঞ মুয়াল্লিম আব্দুল্লাহ আল-হাশিমি সতর্ক করেন: “সবচেয়ে বড় ভুল হলো হজকে শুধু আনুষ্ঠানিকতা ভাবা। মনে রাখবেন, প্রতিটি কাজের পেছনে রয়েছে গভীর আধ্যাত্মিক শিক্ষা।
ইহরামের নিষিদ্ধ কাজে লিপ্ত হওয়া:
- সুগন্ধি ব্যবহার, নখ কাটা বা সহবাসের দিকে ইঙ্গিতপূর্ণ আচরণ
- সমাধান: ইহরামের নিয়ম মুখস্থ করুন, সহযোগীদের সতর্ক করুন
তাওয়াফে ভিড়ের সময় ধৈর্যহারা হওয়া:
- ধাক্কাধাক্কি, চিৎকার বা তাড়াহুড়ো করা
- সমাধান: ভিড় এড়াতে ফজরের পর বা মধ্যরাতের সময় বেছে নিন
আরাফাতের দিনে অতিরিক্ত সেলফি বা ভিডিও:
- মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়া, আধ্যাত্মিক মুহূর্ত নষ্ট হওয়া
- সমাধান: মোবাইল সীমিত ব্যবহার, প্রয়োজন ছাড়া না তোলা
কঙ্কর নিক্ষেপে সময় ভুল:
- নির্দিষ্ট সময়ের আগে জামারায় যাওয়া (সূর্যাস্তের পর শুধু ১০ তারিখ)
- সমাধান: Saudi Hajj App-এ সময়সূচি চেক করুন
স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা:
- পর্যাপ্ত পানি না পান, রোদে ক্যাপ/ছাতা না ব্যবহার
- সমাধান: প্রতিদিন ৩-৪ লিটার পানি, ইলেক্ট্রোলাইট ট্যাবলেট
মিনায় অবস্থানকালীন অপচয়:
- খাবার ফেলে দেওয়া, প্লাস্টিকের বোতল ছড়ানো
- সমাধান: প্রয়োজনানুযায়ী খাবার নিন, রিসাইকেল বিন ব্যবহার
- তাওয়াফে জিয়ারত আগেই চুল কাটা:
- ইহরামের নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ হওয়া
- সমাধান: কঙ্কর নিক্ষেপ ও কোরবানির পরই চুল কাটুন
হজের সময় স্বাস্থ্য সুরক্ষা: বাংলাদেশি হাজীদের জন্য বিশেষ গাইড
মক্কার গ্র্যান্ড মসজিদের প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা ড. আহমেদ আল-জেদ্দাউই বলেন, “প্রতিবছর ২০-৩০% হাজী হিটস্ট্রোক বা ডিহাইড্রেশনে আক্রান্ত হন। গড় তাপমাত্রা ৪৫°C এ স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে প্রস্তুতি জরুরি।”
স্বাস্থ্য সমস্যা | প্রতিরোধের উপায় | জরুরি প্রস্তুতি |
---|---|---|
হিটস্ট্রোক | সাদা ছাতা ব্যবহার, দিনে ১২-৩টার ভিতর রোদ এড়ানো | ORS, কোল্ড জেল প্যাক |
পায়ে ফোসকা | নরম জুতা (বিশেষ করে সেন্ডেল না পরা) | অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম, মোজা |
শ্বাসকষ্ট | ভিড়ের মধ্যে মাস্ক পরা, ইনহেলার রাখা | নেবুলাইজার (চিকিৎসকের পরামর্শে) |
পেটের পীড়া | বাইরের খাবার এড়ানো, বোতলজাত পানি | অ্যান্টি-ডায়ারিয়াল ট্যাবলেট |
বাংলাদেশি হাজীদের জন্য বিশেষ টিপস:
- খাদ্যাভ্যাস: মসলাদার খাবার এড়িয়ে সহজপাচ্য খান (খেজুর, ওটস, সিদ্ধ ডিম)
- ঔষধ প্রস্তুতি: নিয়মিত ঔষধের ৩০% অতিরিক্ত নিন (যানজাহান ওষুধ নষ্ট হতে পারে)
- মেডিকেল আইডি: রক্তের গ্রুপ, জরুরি কন্টাক্ট নম্বর ওয়ারিশ কার্ডে লিখে রাখুন
হজের আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি: মন ও আত্মার পরিশুদ্ধি
হজ শুধু শারীরিক ইবাদত নয়, এটি হৃদয়ের রূপান্তরের সফর। প্রখ্যাত ইসলামিক পণ্ডিত ড. জাকির নায়েকের মতে, “হজের সময় করণীয়-র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো কৃত পাপের জন্য অনুতপ্ত হওয়া এবং ভবিষ্যতে তা না করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা।”
- আত্মসমালোচনার অভ্যাস: প্রতিদিন রাতে ১০ মিনিট নিজের ভুলগুলো নিয়ে চিন্তা করুন
- ক্ষমা প্রার্থনা: যাদের আঘাত করেছেন তাদের ফোন/মেসেজ করে ক্ষমা চান (ইন্টারনেট ব্যবহার করে)
- সদকা: বাংলাদেশি টাকা সৌদিতে নিয়ে গেলে স্থানীয়দের দান করুন (প্রতিদিন ১০০-২০০ টাকার সমমান)
- কোরআন সান্ডেস্কে রাখুন: ছোট কোরআন বা ট্যাবে ডাউনলোড করে নিন, ফ্রি সময়ে তিলাওয়াত করুন
জেনে রাখুন (FAQs)
প্রশ্ন: হজের সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার করা যাবে?
উত্তর: হ্যাঁ, তবে সীমিতভাবে। নামাজের সময়, তাওয়াফ বা সাঈর সময় ফোন ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন। জরুরি যোগাযোগের জন্য Saudi Telecom Company (STC)-এর স্থানীয় SIM কার্ড নিন। ফটোগ্রাফির সময় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে এমন কিছু করবেন না।
প্রশ্ন: ইহরাম অবস্থায় কী কী করা নিষিদ্ধ?
উত্তর: ইহরামে নিষিদ্ধ কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে: ১) কোনো ধরনের সুগন্ধি ব্যবহার, ২) নখ বা চুল কাটা, ৩) শিকার করা বা গাছপালা কাটা, ৪) সহবাস বা বিবাহিত জীবনের কোনো কাজ, ৫) সেলাই করা পোশাক পরা (পুরুষের জন্য)। ভুলবশত করলে ফিদয়া (ক্ষতিপূরণ) দিতে হবে।
প্রশ্ন: হজের সময় নারীদের বিশেষ কোন নির্দেশনা আছে?
উত্তর: হ্যাঁ, নারীরা সাধারণ পোশাকেই ইহরাম পালন করবেন (মাথা ঢাকা বাধ্যতামূলক)। তবে মুখমণ্ডল খোলা রাখতে হবে। ভিড়ের সময় নিরাপত্তার জন্য হজ গ্রুপের সঙ্গে থাকুন। হায়েজ হলে তাওয়াফে জিয়ারত পরে আদায় করবেন, কিন্তু কঙ্কর নিক্ষেপ ও অবস্থান করতে বাধা নেই।
প্রশ্ন: হজ শেষে মদীনায় যাওয়া কি বাধ্যতামূলক?
উত্তর: না, মদীনায় যাওয়া সুন্নত তবে ফরজ নয়। রাসূল (সা.)-এর রওজা জিয়ারত, মসজিদে নববীতে নামাজ আদায় ও উহুদ যুদ্ধের স্থান দেখার জন্য ৩-৪ দিন সময় রাখুন। বাংলাদেশি হাজীদের জন্য মদীনা থেকে সরাসরি ফ্লাইট সুবিধাজনক।
প্রশ্ন: অতিরিক্ত কঙ্কর নিক্ষেপ করলে কী করণীয়?
উত্তর: যদি ভুলবশত ৭টির বেশি কঙ্কর মারেন, তবে সেটা গুনাহ হবে না। তবে ইচ্ছাকৃতভাবে বেশি মারলে দম (ক্ষতিপূরণ) দিতে হবে। সতর্ক থাকুন, প্রতিটি জামারায় শুধু ৭টি করেই মারবেন।
প্রশ্ন: হজের সময় হারিয়ে গেলে কী করবেন?
উত্তর: паник না করে নিকটতম পুলিশ বা ভলান্টিয়ারকে আপনার মুয়াল্লিমের ফোন নম্বর ও হজ কার্ড দেখান। সবসময় হজ আইডি কার্ড সঙ্গে রাখুন। Saudi authorities-এর হেল্পলাইন নম্বর ৯১১ ডায়াল করুন।
হজের সময় করণীয় সম্পর্কে এই গাইড আপনার আধ্যাত্মিক যাত্রাকে করবে অর্থবহ ও ত্রুটিমুক্ত। মনে রাখবেন, প্রতিটি ধাপই ইব্রাহিম (আ.) ও ইসমাঈল (আ.)-এর ত্যাগের স্মৃতিবাহী। এই সফর শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়, হৃদয়ের পুনর্জন্ম। বাংলাদেশ থেকে আসা প্রতিটি হাজীর জন্য বিশেষ প্রার্থনা রইল – আপনার হজ কবুল হোক, ফেরার পথ হোক নিরাপদ। হজ মোবারক!
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।