হাইড্রোজেন বা হিলিয়াম নয়, মহাবিশ্বের প্রথম অণুটির নাম হিলোনিয়াম। মহাবিশ্বের প্রথম অণুর খোঁজ নিতে প্রথমে খুঁজতে হবে প্রথম পরমাণু। কারণ, একাধিক পরমাণু মিলে তৈরি হবে অণু। বিগ ব্যাংয়ের ঠিক পরমুহূর্তে মহাবিশ্ব ছিল অতি উত্তপ্ত। সেখানে পরমাণুর গঠন অসম্ভব।
এমনকি প্রোটন বা নিউট্রনের গঠনও অসম্ভব ছিল। তখন ছিল শুধু মৌলিক কণাগুলো, কোয়ার্ক, গ্লুয়োন, নিউট্রিনো বা ইলেকট্রন। এসব মৌলিক কণার সৃষ্টি প্রথম এক মাইক্রোসেকেন্ডের আগেই শেষ। এক মাইক্রোসেকেন্ডে তাপমাত্রা কমে হয়েছে ১০ হাজার বিলিয়ন কেলভিন। ১০ হাজার বিলিয়ন কেলভিন অসম্ভব গরম, সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রথম প্রোটন বা নিউট্রন তৈরির জন্য উপযুক্ত। তিনটি করে কোয়ার্ক কণা মিলে তৈরি হলো প্রোটন ও নিউট্রন।
যে মুহূর্তে প্রোটন তৈরি হলো, বলা চলে তখনই আমরা পেয়ে গেলাম একটা পরমাণু। পরমাণুর মূল ব্যাপারটাই হলো কতগুলো প্রোটন আছে। একটা প্রোটন থাকলে হাইড্রোজেন, দুটি থাকলে হিলিয়াম, তিনটি থাকলে লিথিয়াম। এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত ১১৮টি মৌলিক পদার্থের প্রধান পার্থক্য হলো, প্রতিটিতে প্রোটন সংখ্যা আলাদা। সবচেয়ে কম হাইড্রোজেনে, একটি। সবচেয়ে বেশি অগানেসনে, ১১৮টি।
সারকথা হলো, প্রথম পরমাণুর জন্ম বিগ ব্যাংয়ের এক মাইক্রোসেকেন্ড পরে। কিন্তু একটা প্রোটনকে হাইড্রোজেন বলা গেলেও একে ঠিক নিরপেক্ষ পরমাণু বলা যায় না। একটা নিরপেক্ষ পরমাণু হতে দরকার প্রোটনের সঙ্গে একটা ইলেকট্রন। এতে প্রোটনের ধনাত্মক চার্জ আর ইলেকট্রনের ঋণাত্মক চার্জ মিলে প্রশমিত হতে পারে। কিন্তু ১০ হাজার বিলিয়ন কেলভিন আসলে অনেক বেশি তাপমাত্রা একটি প্রোটনের সঙ্গে একটা ইলেকট্রনের যুক্ত হওয়ার জন্য। তাই হাইড্রোজেন পরমাণু না বলে হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াস বলা বেশি সঠিক হবে।
মোটামুটি এক মাইক্রোসেকেন্ড থেকে এক সেকেন্ডের মধ্যেই সব প্রোটন আর নিউট্রনের গঠন শেষ। এরপর অনেকক্ষণ সময় চলে গেছে। প্রায় ১০০ সেকেন্ড। এতক্ষণে তাপমাত্রা নেমে এসেছে এক বিলিয়ন কেলভিনে। মহাবিশ্ব একটু ঠান্ডা হয়েছে বলা চলে। তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় এবার নিউট্রন-প্রোটন একসঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পেল।
তৈরি হলো হাইড্রোজেনের আরেক আইসোটোপ-ডিউটেরিয়ামের নিউক্লিয়াস। সাধারণত হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াসে শুধু একটা প্রোটন থাকে। কিন্তু ডিউটেরিয়ামে থাকে একটি প্রোটন, একটি নিউট্রন। বিশেষ কিছু অবস্থা বাদ দিলে রাসায়নিকভাবে দুটি একই। তাই বলা চলে, মহাবিশ্বে এখনো শুধু হাইড্রোজেনই আছে।
হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াস তৈরি হওয়ার পরই আরও নিউট্রন ও প্রোটন যুক্ত হয়ে তৈরি হলো হিলিয়াম নিউক্লিয়াস। হিলিয়াম নিউক্লিয়াসে দুটি প্রোটন থাকে, নিউট্রন হতে পারে এক বা দুটি। এভাবে শুধু হিলিয়াম নয়, তৈরি হলো অল্প কিছু লিথিয়াম নিউক্লিয়াসও। লিথিয়ামের নিউক্লিয়াসে প্রোটন আছে তিনটি।
মোটামুটি এতটুকুই। প্রাথমিক মহাবিশ্বের পরমাণু বা নিউক্লিয়াস এই তিন—হাইড্রোজেন, হিলিয়াম, লিথিয়াম। এরপরের অন্য সব ভারী পরমাণু নক্ষত্রে তৈরি।
নিউক্লিয়াস থেকে নিরপেক্ষ পরমাণু তৈরি হতে এরপর লম্বা সময় লেগেছে। ৩ লাখ ৮০ হাজার বছর পর তাপমাত্রা কমে হলো ১০ হাজার কেলভিন। এই তাপমাত্রা একটি হিলিয়াম নিউক্লিয়াসের সঙ্গে একটি ইলেকট্রন যুক্ত হওয়ার জন্য যথেষ্ট। সাধারণভাবে মনে হতে পারে, একটা প্রোটনের সঙ্গে একটা ইলেকট্রন মিলে নিরপেক্ষ হাইড্রোজেন হওয়াই সহজ। বাস্তবে ঘটনা ভিন্ন।
একটি হাইড্রোজেনের কক্ষপথ (কক্ষপথ না বলে অরবিটাল বলা বেশি শুদ্ধ) থেকে একটা ইলেকট্রন বের করতে যতটুকু শক্তির দরকার হয়, এর চেয়ে অনেক বেশি শক্তি দরকার হয় হিলিয়াম থেকে একটি ইলেকট্রন সরিয়ে ফেলতে। তাই উত্তপ্ত মহাবিশ্বে একটি হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস যদি একটি ইলেকট্রন ধরে ফেলে, উচ্চ তাপের কারণে সেটি সহজেই ছুটে যায়। অন্যদিকে হিলিয়াম নিউক্লিয়াস কোনো ইলেকট্রনকে ধরে ফেললে এই তাপমাত্রায় তা সহজে ছুটে যায় না। এভাবে হিলিয়াম একে একে দুটি ইলেকট্রন নিয়ে নিরপেক্ষ হিলিয়াম পরমাণু বানিয়ে ফেলল। রসায়নবিদেরা এমন নিরপেক্ষ হিলিয়ামকে সংক্ষেপে লেখেন He।
সংখ্যার দিক দিয়ে দেখলে তখন কিন্তু হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াসই বেশি, ৯০ শতাংশের বেশি, হিলিয়াম মাত্র ৮ শতাংশ। ভরের দিক দিয়ে দেখলে অবশ্য প্রায় চার ভাগের এক ভাগ হিলিয়াম, বাকি তিন ভাগ হাইড্রোজেন বা প্রোটন।
এদিকে হিলিয়াম নিরপেক্ষ পরমাণু তৈরি করে ফেললেও প্রোটনের জন্য ইলেকট্রন ধরে নিজের কক্ষপথে নিয়ে নেওয়ার মতো ঠান্ডা হয়নি মহাবিশ্ব। তাই প্রোটন সরাসরি নিজে ইলেকট্রন না নিতে পেরে হিলিয়ামের সঙ্গে যুক্ত হলো। একটি হিলিয়ামের সঙ্গে একটি প্রোটন মিলে তৈরি হয় হিলিয়াম হাইড্রাইড বা হিলোনিয়াম। নিরপেক্ষ হিলিয়াম আর হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াস পরস্পর যুক্ত হয়ে তৈরি হলো মহাবিশ্বের প্রথম রাসায়নিক বন্ধন। মহাবিশ্বের প্রথম অণু।
একজন রসায়নবিদ সংক্ষেপে হিলোনিয়ামকে লিখবেন HeH+। হাইড্রোজেনের একটা ইলেকট্রন কম আছে বলে ওই যোগ চিহ্ন। এরপর হিলোনিয়ামের সঙ্গে আরও ইলেকট্রন মিলে নিরপেক্ষ অণু তৈরি হয়, সেটি ভেঙে তৈরি হয় নিরপেক্ষ হাইড্রোজেন পরমাণু ও অণু।
এখনকার দুনিয়ায় ভাবলে ১১৮টি মৌলিক পদার্থের মধ্যে রাসায়নিকভাবে সবচেয়ে নিষ্ক্রিয় পরমাণু হিলিয়াম। খুব সহজে কোনো অণু তৈরি করে না। অথচ মহাবিশ্বের প্রথম অণুর প্রধান অংশ হিলিয়াম।
নিরপেক্ষ পরমাণু তৈরি হওয়াতেই মহাবিশ্ব স্বচ্ছ হয়ে উঠতে পারে। ওই সময়ের ফোটনগুলোই মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের কারণে শক্তি হারিয়ে এখনকার কসমিক ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশনে পরিণত হয়েছে। সে অবশ্য অন্য আলাপ।
হিলোনিয়াম যে প্রথম অণু, এর তাত্ত্বিক ভিত্তি অনেক আগেই বিজ্ঞানীরা দিয়েছেন। কিন্তু এই অণু মহাকাশে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরীক্ষাগারে প্রথম হিলোনিয়াম দেখা গেছে ১৯২৫ সালে। কিন্তু মহাকাশে কোথায় খুঁজে পাওয়া যেতে পারে, এ নিয়ে খুব বেশি আইডিয়া ছিল না।
সত্তরের দশকের শেষ ভাগে এসে ধারণা করা হয়, মহাকাশে যেসব জায়গায় প্লাজমা আছে, সেখানে হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে হিলোনিয়াম। যেহেতু ১৯২৫ সাল থেকেই হিলোনিয়ামের স্পেকট্রস্কপি জানা, তাই মহাকাশের কোনো প্লাজমা থেকে আসা আলোর কোনো অংশে হিলোনিয়াম দেখা যাবে, তা বিজ্ঞানীরা জানতেন।
এরপর প্রায় চার দশক কেটে গেছে। বিজ্ঞানীরা এমন কোনো রেখা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। নিশ্চিতভাবে প্রথম হিলোনিয়াম খুঁজে পাওয়া যায় ২০১৯ সালে। ম্যাক্স প্ল্যাংক ইনস্টিটিউট ফর রেডিও অ্যাস্ট্রোনমির বিজ্ঞানী রলফ গাসেনের নেতৃত্বে একদল গবেষক বিশেষ এক অবজারভেটরির মাধ্যমে প্ল্যানেটারি নেবুলা এনজিসি ৭০২৭-এ খুঁজে পান হিলোনিয়াম রেখা।
বিশেষ এই অবজারভেটরি অন্য সব অবজারভেটরির চেয়ে আলাদা। একটা বিশাল বোয়িং ৭৪৭এসপি-কে মডিফাই করে বানানো হয়েছে এই মানমন্দির। এই প্লেনের একদিক কেটে বসানো হয়েছে স্ট্র্যাটোস্ফেরিক অবজারভেটরি ফর ইনফ্রারেড অ্যাস্ট্রোনমি বা সোফিয়া। ইনফ্রারেড বা অবলোহিত আলোতে পর্যবেক্ষণ করা এই টেলিস্কোপ নিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে পাইলটরা ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪০ হাজার ফুট ওপরে চলে যান। যেখানে বায়ুমণ্ডলের প্রভাব অনেকটাই কমে যায়, মহাকাশ থেকে আসা অবলোহিত আলো দেখা যায় সহজেই।
২০১৬ সালে সোফিয়ার এমনই এক ফ্লাইটে হিলোনিয়াম আবিষ্কার হয় পৃথিবীর বাইরে। যদিও এই হিলোনিয়াম বিগ ব্যাংয়ের পরে তৈরি হওয়া হিলোনিয়াম নয়। প্ল্যানেটারি নেবুলায় তৈরি হওয়া অণু। তবু গবেষণাগারের বাইরে অ্যাস্ট্রোকেমিস্ট্রি বা জ্যোতিঃরসায়ন পর্যবেক্ষণ করা খুবই উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
এখন পর্যন্ত মহাকাশে প্রায় ২৯০টি অণু পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়েছে। এর মধ্যে ৭৩টি অণু দেখা গেছে, এমনকি মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির বাইরে। অর্ধশতাব্দী ধরে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা অ্যাস্ট্রোকেমিস্ট্রি এখন তাই বিশাল এক গবেষণাক্ষেত্র।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।