মোঃ রাকিবুল ইসলাম: বিগত কয়েক দশক ধরে কিভাবে কর্মচারীদের কাজের চাপ কমানো যায় তা নিয়ে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যালোচনা চলে আসছিল। বিশেষ করে আবাসস্থল থেকে কর্মস্থলে যাওয়ার সময় ও ঝক্কি-ঝামেলা কমানোর জন্য নিয়োগকর্তারা নানামুখী পদক্ষেপ নিয়ে আসছিলেন। কিন্তু এতোদিন যুতসই কোন উপায় বের করতে না পারলেও করোনা মহামারী এ সমস্যা সমাধানে ‘সাপে বর’ হয়ে এসেছে। ২০২০ সালের মার্চ মাসে মহামারী এবং পরবর্তী শারীরিক বিধিনিষেধের কারণে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। যা বাংলাদেশে ‘হোম অফিস’ নামে পরিচিতি লাভ করেছে। এ ধারাটি কর্মব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য গতি অর্জন করেছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বিশ্বব্যাপী 88 শতাংশ প্রতিষ্ঠান মহামারীর পরে তাদের কর্মীদের বাড়ি থেকে কাজ করতে উৎসাহিত করেছে বা বাধ্যতামূলক করেছে।
ইতোমধ্যে প্রমাণিত যে, বাড়িতে থেকে কাজের অনেক কর্মচারী-ভিত্তিক সুবিধা রয়েছে। এটি কর্মীদের জীবনকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে কর্ম ও জীবনের ভারসাম্য তৈরি করে। হোম অফিসের মাধ্যমে কাজ করার ফলে কর্মচারীদের কাজের প্রতি গুনগত সম্পৃক্ততা অধিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে যা প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক। হোম অফিসের মাধ্যমে কাজের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সুবিধাগুলির মধ্যে একটি হল এর ইতিবাচক পরিবেশগত প্রভাব। কর্মচারীরা দূরবর্তী অবস্থানে থেকে কাজ করার জন্য অফিস স্পেসের পরিবর্তে ভার্চুয়াল অফিস তৈরি করে। যা নিয়োগকর্তার খরচ কমিয়ে আনে, কর্মীদের কষ্ট দূর করে, কাজের জন্য নির্দিষ্ট শহরে বসবাস করা থেকে বিরত রাখে, সর্বোপরি যানবাহনের ব্যবহার কমিয়ে রাস্তায় যানজট লাঘব করে। এতে জ্বালানি সাশ্রয়ের মাধ্যমে বায়ুমণ্ডলে কার্বন নিঃসরণ কমায়। ফলে পরিবেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ঘটে।
গ্লোবাল ওয়ার্কপ্লেস অ্যানালিটিক্স-এর রিপোর্টে বলা হয়েছে, করোনা মহামারীর পরে হোম অফিসের মাধ্যমে কজ করার কারনে এক বছরের ৬ লক্ষ গাড়ি রাস্তায় বের হওয়া থেকে বিরত থেকেছে। রিপোর্টে আরও দেখানো হয়েছে যে, সপ্তাহে অর্ধেক দিন বাড়িতে থেকে কাজ করা হলে প্রতি বছর ৫৪ মিলিয়ন টন কার্বন নির্গমন কমানো সম্ভব। ফলে হোম অফিস কম গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমন, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস, বায়ুর গুণমান বৃদ্ধি করে। এছাড়া বিভিন্ন অফিস সরবরাহ, যেমন- কাগজ-কালি ও পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য ব্যবহৃত বিভিন্ন রাসায়নিকের ব্যবহার কমিয়ে পরিবেশ বিপর্যয়কে বাধাগ্রস্থ করে। এভাবে বাড়ি থেকে কাজ করা দূরবর্তী কর্মীরা কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করতে বিরাট ভূমিকা পালন করে থাকে।
শারীরিক উপস্থিতিতে অফিস চলাকালীন সময়ে উল্লেখযোগ্য পরিমানে বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে হয় অফিস অভ্যন্তরে আলো সরবরাহ করা ও শীতাতপ ব্যবস্থা চালু রাখার জন্য। এই বিদ্যুৎ উৎপাদনে আবার জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। বেঁচে থাকার জন্য আমরা জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর ভীষণভাবে নির্ভরশীল। কিন্তু জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ালে কার্বন-ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন হয়। অন্য কথায়, এটি ক্ষতিকারক গ্যাসকে বাড়িয়ে তোলে এবং জলবায়ু সংকটকে ঘনীভূত করে। কিন্তু হোম অফিস এই বিদ্যুৎ খরচকে কমিয়ে জীবাশ্ম জ্বালানী সাশ্রয় করে। সর্বোপরি জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তনকে বাধাগ্রস্থ করে। গবেষণায় দেখা গেছে, একজন কর্মচারী বাড়ি থেকে কাজ করলে প্রতি বছর ৫,৪০০ কিলোওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ সাশ্রয় করতে পারে। ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে হোম অফিসে কাজ করায় কাগজের ব্যবহার শূন্যে নেমে গেছে। এই কাগজবিহীন অফিস কৌশল গাছ বাঁচায়। এমনকি একজন দূরবর্তী কর্মী এইভাবে বাতাস থেকে ১৪.৭ পাউন্ড কার্বন ডাই অক্সাইড অপসারণ করতে পারে। এভাবে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাস করে আমরা বায়ুর গুণমান বাড়াতে পারি। এতে বনায়ন নিধনকেও রোধ করা যায়।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, মহামারীর পরে সে দেশের কর্মীরা ওয়ার্ক ফ্রম হোমের প্রতি বেশি আগ্রহী ওঠেছে । সম্প্রতি প্রকাশিত নকরি ডট কম-এর (Naukri.com) তাদের এক সমীক্ষায় দেখিয়েছে, গত বছর জুলাই মাস থেকে এখন পর্যন্ত পাকাপাকি ভাবে বা সাময়িকভাবে বাড়ি থেকে কাজ করতে চেয়ে আবেদনকারী চাকরিপ্রার্থীর সংখ্যা ৯৩ হাজার। এর মধ্যে ২২ শতাংশের আবেদন, তারা বাড়ি থেকেই কাজ করতে চান। নকরি ডট কম-এর গত ছয় মাসের তথ্য অনুযায়ী, ওয়ার্ক ফ্রম হোমের সুবিধা রয়েছে এমন চাকরি খুঁজেছেন প্রায় ৩২ লাখ চাকরিপ্রার্থী। এর মধ্যে ৫৭ শতাংশ চাকরিপ্রার্থী পাকাপাকি ভাবে বাড়ি থেকে কাজ করতে চেয়ে চাকরির খোঁজ করেছেন। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ওয়ার্ক ফ্রম হোমের সুবিধা রয়েছে এমন চাকরি খুঁজেছেন ৩.৫ লক্ষ চাকরিপ্রার্থী। মহামারীর পরে মূলত, আইটি সংস্থাগুলি ও আইটি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বাড়ি থেকে কাজের নিয়ম চালু রেখেছে এখনও। নকরি ডট কম-এর তথ্য অনুযায়ী, আমাজন, টেক মাহিন্দ্রা, এইচসিএল, পিডাব্লুসি, ট্রাইজেন্ট, ফ্লিপকার্ট, সিমেন্স, ডেলইট, ওব়্যাকল, জেন্সার, টিসিএস, ক্যাপজেমিনির মতো সংস্থা এখনও তাদের কর্মীদের বাড়িতে বসে কাজ করার সুযোগ দিচ্ছে। বাংলাদেশেও উল্লেখযোগ্য অফিস তাদের কর্মীদের পূর্ণসময় অথবা সপ্তাহের নির্দিষ্ট সময় বাড়িতে বসে অফিস করার সুযোগ দিয়ে পরিবেশ রক্ষায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রাখছে। অপর একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৮ সালের মধ্যে এসব প্রতিষ্ঠানের প্রায় শতকরা ৭৩ ভাগ কর্মী বাড়িতে বসে তদের অফিসিয়াল দায়িত্ব পালন করবে।
এছাড়া, হোম অফিস করার কারনে কর্মীরা কাজ শেষে অতিরিক্ত সময় পেয়ে থাকে। এতে তারা নিজেদের উন্নতিতে আরও বেশি সময় ব্যয় করতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে যেসব ব্যক্তিরা মহামারীর সময় তাদের বাড়িতে সময় কাটায়, তারা তাদের সময়কে কাজে লাগানোর জন্য বাগান করা শুরু করেছিল। এসময় তারা স্বাস্থ্যকর ডায়েট শুরু করেছে এবং পরিবেশ-বান্ধব অভ্যাস অর্জন করেছে, যেমন পাবলিক জিমে যাওয়ার পরিবর্তে বাইরে জগিং করা। সকল দিক বিবেচনায় হোম অফিস বা ওয়ার্ক ফ্রম হোম হবে ভবিষ্যত কর্মব্যবস্থা- একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।