জুমবাংলা ডেস্ক: সিরিয়াল কিলিং বা সিরিয়াল কিলারদের নিয়ে আমাদের আগ্রহের শেষ নেই। ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা করে কোনো ব্যক্তিকে খুন করা গল্প-উপন্যাসে আমরা হরহামেশাই পড়ি। খুন কোনো কোনো মানুষের নেশা হতে পারে তা কি ভাবতে পারা যায়! সিরিয়াল খুনিদের মনস্তত্ত্ব নিয়ে মনোবিজ্ঞানী থেকে শুরু করে অপরাধবিজ্ঞানীদেরও গবেষণার শেষ নেই। সিরিয়াল কিলার বা ধারাবাহিক খুনিদের নিয়ে যুগে যুগে বহু সিনেমা, গল্প, কাহিনীর জন্ম হয়েছে। রহস্যময় সেই সিরিয়াল কিলাররা হয়ত আমাদের আশেপাশেই লুকিয়ে আছেন আপনার মত সাধারন চেহারা নিয়েই! এমনই একজন ‘বিকিনি কিলার’!
নেপালের জেলে বন্দি আশি ছুঁই ছুঁই চার্লস শোভরাজের কথাই বলছি। যিনি ‘বিকিনি কিলার’ নামেই বিশ্বজুড়ে বেশি পরিচিত। গত শতাব্দীর সাতের দশক থেকেই তাকে ঘিরে ছড়িয়েছে নানা মিথ। কেন ঝকঝকে স্মার্ট চেহারার শান্ত মানুষটার চোখে আচমকাই ঝিকিয়ে উঠত হিংস্রতার সবুজ রং? বহু ক্ষেত্রেই তার শিকার বিকিনি পরা মেয়েরা। যা তাকে এনে দিয়েছিল ‘বিকিনি কিলারে’র তকমা।
নেপাল সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী, ১৫ দিনের মধ্যে নেপাল থেকে বের করে দিতে হবে চার্লস শোভরাজকে। ২০ বছরের কারাদণ্ড প্রাপ্ত শোভরাজ ১৯ বছরেরও বেশি সময় ধরে জেলে। তার বয়সের কথা বিবেচনা করে নেপালের সর্বোচ্চ আদালত তাকে মেয়াদের আগেই ছেড়ে দেওয়ার রায় দেয়।
শোভরাজ কাঠমান্ডু জেলের বাইরে বেরিয়ে পুলিশের গাড়িতে ওঠে। গাড়িতে করে তাকে অজ্ঞাত গন্তব্যে নিয়ে যাওয়া হয়। সূত্রের খবর, শোভরাজের হৃদযন্ত্রের সমস্যা থাকায় তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। শীর্ষ আদালতের রায়তেও তার হৃদরোগের উল্লেখ ছিল। তবে নেপালেই তার অস্ত্রপচার হবে কি না, বা কবে শোভরাজ নেপাল ছেড়ে যাবে, তা নিয়ে এখও নির্দিষ্ট জবাব মেলেনি।
শৈশব ছিল বিপন্ন
ভিয়েতনামের সবচেয়ে বড় শহর সাইগন, যার বর্তমান নাম হো চি মিন সিটি, সেখানে জন্ম চার্লসের। তার বাবা ভারতীয়, মা ভিয়েতনামের নাগরিক। কিন্তু তারা একসঙ্গে থাকলেও তাদের বিয়ে হয়নি। এবং ভদ্রলোক চার্লসকে নিজের ছেলে বলেও স্বীকৃতি দিতে চাননি। এর মধ্যেই ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় দু’জনের।
চার্লসের মা বিয়ে করেন ফ্রান্সের এক সেনানায়ককে। তিনি অবশ্য চার্লসকে দত্তক নিতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু ততদিনে বিচ্ছিন্নতার বীজ গেঁথে যায় তার রক্তের মধ্যে। ধীরে ধীরে ডাকাতি, ড্রাগ কিংবা হিরের চোরাচালানের এক কৃষ্ণগহ্বরের মধ্যে তলিয়ে গিয়েছিল সে। বহু অপরাধীর মতোই চার্লস শোভরাজের মনের ভেতরে একরাশ অন্ধকার ছড়িয়ে দিয়েছিল তার বিপন্ন শৈশব।
১৯ বছর বয়সে প্রথম জেল খেটেছিল চার্লস। কিন্তু প্যারিসের সেই জেলে ডাকাতির অভিযোগে গ্রেফতারকৃত এই তরুণের ব্যবহার মুগ্ধ করেছিল জেলের কর্মকর্তাদের। আসলে এটাই ছিল চার্লসের কৌশল। ব্য়বহার তার এমন, যেন মধু ঢালা! ফলে উল্টো দিকের লোকটা সহজেই তাকে বিশ্বাস করে ফেলতো। একের পর এক জেল থেকে পালিয়েছেন তিনি। পরবর্তী এই সুযোগেই সে চালিয়েছে অবাধ হত্যালীলা।
অসংখ্য খুন তার হাত ধরেই
সিয়াটলের এক তরুণীই ছিল চার্লসের প্রথম শিকার। খুন করে যাকে থাইল্যান্ডের এক সমুদ্রখাঁড়িতে ভাসিয়ে দিয়েছিল সে। এরপর ক্রমেই নেপাল, থাইল্যান্ড ও ভারতে একের পর এক অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে যেতে থাকে চার্লস শোভরাজের নাম। সারা জীবনে অসংখ্য খুন করেছে চার্লস। সাত থেকে আটের দশকে ১২ থেকে ২৪টি খুনের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
শোভরাজ কথা বলতে পারত নানা ভাষায়। তার ব্যক্তিত্বের মধ্যে ছিল এক তীব্র চৌম্বক আকর্ষণ। বিশেষ করে মেয়েরা সহজেই আকৃষ্ট হয়ে পড়ত তার ব্যবহারে। আসলে শিকার ধরার কৌশল ছিল তার রক্তের ভেতরে। প্রথমে সে তাদের সঙ্গে এমন ভাবে মিশে যেত, সন্দেহের কোনো চিহ্ন পর্যন্ত থাকত না। তারপর এক মোক্ষম মুহূর্তে আচমকাই… ওষুধে বেহুঁশ করার পর সর্বস্ব লুট করে, বহু ক্ষেত্রেই খুন করে মসৃণভাবে সেখান থেকে কেটে পড়ত চার্লস। এই মসৃণ ভঙ্গির জন্য়ই তার আরেক নাম ‘দ্য সারপেন্ট’। অর্থাৎ সাপ।
জেলে দশ বছর পূর্তির পার্টি এবং সিনেমার গল্প
১৯৮৬ সাল। তিনজনকে ওষুধ খাইয়ে খুনের চেষ্টার অপরাধে চার্লস বছর দশেক কাটিয়ে ফেলেছে বিহারের তিহাড় জেলে। এই সময় সে জেলের রক্ষীদের জন্য পার্টি দেয়! জেলে দশ বছর পূর্তির পার্টি। ততদিনে তার মিষ্টি মিষ্টি কথা বশ হয়ে গিয়েছে তারা। ব্যাস। খাবারে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে বেহুঁশ করে জেল থেকে পালালো সে। রীতিমতো হইহই পড়ে গেল চারদিকে। যেন সিনেমার কোনো ধুরন্ধর খলনায়ক লোকটা। কখন সে কোথায় কীভাবে জাল পাতবে বোঝা মুশকিল।
জেল থেকে বারবার পালাতে দেখা গিয়েছে ধুরন্ধর চার্লস শোভরাজকে। সারা জীবনে প্রায় ৩৫ বছর জেলেই কাটিয়েছে সে। তবু সুযোগ পেলেই পালিয়েছে মুহূর্তে। আফগানিস্তান, গ্রিসসহ নানা দেশের জেল থেকেই মুহূর্তে উধাও হয়ে গিয়েছে চার্লস। একবার তো অ্যাপেনডিক্সের ব্যথার অজুহাতে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে তারপর সেখান থেকে পালিয়ে গিয়েছিল সে। ভাবলে সত্যিই মনে হয় যেন এককালের সেলিম-জাভেদের তৈরি সব ছবির মতো চিত্রনাট্য!
চার্লসের জীবন নতুন মোড় নেয় ১৯৯৭ সালে। কারাবাসের মেয়াদ শেষ করে ৫২ বছর বয়সি শোভরাজ ভারত থেকে ফিরে যায় ফ্রান্সে। সেই সময় রীতিমতো তারকা জীবন কাটাতেই দেখা গিয়েছিল তাকে। সাংবাদিকদের ভিড় লেগেই থাকত তার বাড়িতে। রীতিমতো কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করে তবে মিলত সাক্ষাৎকার।
কিন্তু কয়েক বছর পরে আচমকাই ‘কাহানি মে টুইস্ট’। নেপালের কাঠমান্ডু থেকে ফের গ্রেফতার করা হয় তাকে। ১৯৭৫ সালে নেপালে দুই বিদেশি নাগরিককে খুনের অপরাধে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। অবশেষে তাকে বাগে পেয়ে চালান করে দেওয়া হয় জেলে। এখনও সেখানেই বন্দি ‘তারকা’ সিরিয়াল কিলার।
কিন্তু কেন? ফ্রান্সের নিরাপদ জীবন ছেড়ে খামোখা নেপালে যেতে গেলেন কেন তিনি? শোভরাজ অবশ্য কারণ দেখিয়েছে। সে নাকি সুরুচিসম্পন্ন পানির ব্যবসার কাজে সেখানে গিয়েছিল। কখনও বলেছে, কী একটা ডকুমেন্টারির কাজ ছিল। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, আসলে আলোকবৃত্ত থেকে দূরে থাকতে ভালো লাগছিল না তার। সেই কোন অল্পবয়স থেকে তার নাম বারবার উঠে এসেছে খবরের শিরোনামে। তাই আরও একবার সকলকে চমকে দিতেই নেপালে চলে এসেছিল চরম আত্মরতিতে ভুগতে থাকা চার্লস। হয়তো এখনও মনে মনে জেল থেকে পালানোর ছক কষে আরও একবার নিজের নামটা ভাসিয়ে তুলতে চায় সে। লোকটার নাম যখন চার্লস শোভরাজ, সেই সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
ও হ্য়াঁ, আরেকটা তথ্য। নেপালের জেলে থাকাকালীন নিজের আইনজীবীর মেয়ের সঙ্গেই সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে চার্লস। নিহিতা বিশ্বাস নামের সেই তরুণীকে নাকি চার্লস বিয়েও করেছে। যদিও জেল কর্তৃপক্ষ এটাকে গুজব বলেই উড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু বিয়ে হোক আর না হোক, নিহিতা অকপটে জানিয়েছে, ”লোকটা আগে কী করেছে তা জানি না। কিন্তু লোকটা খুব ভাল। সে নিতান্তই নিরীহ।”
বোঝাই যাচ্ছে, বয়স যতই বাড়ুক, চার্লস কিন্তু তার চৌম্বক ক্ষমতায় এতটুকু মরচে পড়তে দেয়নি!
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।