জুমবাংলা ডেস্ক: ছয় টাকার ডাক টিকিটে স্থান পায় প্রাচীন একটি মসজিদ। নির্মাণ কাঠামোর ফলে কোনো জানালা ছাড়াই সে মসজিদের ভেতর প্রাকৃতিকভাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। আজও স্থাপত্যবিদ্যা অঙ্গনে মসজিদটির নির্মাণশৈলী নিয়ে আলোচনা হয়। বলছি, মুন্সীগঞ্জের মিরকাদিমের দড়গাবাড়ির প্রায় ৫৪০ বছর বয়সী বাবা আদম মসজিদের কথা। সময় নিউজের প্রতিবেদক নাসির উদ্দিন উজ্জ্বল-এর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
মুসলিম স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন এ বাবা আদম মসজিদ। বেশ কয়েকটি কারণে অন্যান্য স্থাপত্য নিদর্শনের চেয়ে এ মসজিদ পুরোপুরি আলাদা। পর্যটকদের কৌতূহলে থাকা এ মসজিদের আদ্যোপান্ত নিয়েই আজকের আয়োজন।
নির্মাণশৈলীর সাতকাহন:
৪৩ ফুট দৈর্ঘ্যের বাবা আদম মসজিদ ৩৬ ফুট প্রস্থ। এর দেয়ালগুলো ৭৮ ইঞ্চি পুরো। দুই দেয়ালের মাঝখানে ৮ ফুট ১০ ইঞ্চি লম্বা ও সাড়ে ৫ ফুট ব্যাসের দুটি কালো পাথরের স্তম্ভ পুরো মসজিদের ভার বহন করছে শতাব্দীর পর শতাব্দী। উত্তর পাশের পাথরের স্তম্ভ পাথর প্রায়ই ঘামে। এ পাথর মসজিদকে শীতল রাখছে। দক্ষিণ পাশের স্তম্ভটি একই রকম হলেও এটি প্রয়োজন অনুযায়ী উষ্ণতা ছড়ায়। কোনো জানালা ছাড়াই বাইরের তাপদাহ ভেতরে প্রবেশ করে না। আবার শীতে ঠিক তার বিপরীত। বাইরে শীতের তীব্রতা যতই হোক মসজিদের ভেতরে বেশ উষ্ণতা বজায় থাকে। ফলে এখানে মুসল্লিরা নামাজ আদায় করে বেশ আরামবোধ করেন।
মসজিদের পূর্ব দেয়ালে ৩টি দরজা রয়েছে। মাঝখানেরটা অন্য দুটির চেয়ে প্রশস্ত। তবে বর্তমানে খোলা থাকছে মাঝখানেরটি। কোনো রকম জানালা ছাড়াই মসজিদের ভেতরের সহনীয় তাপমাত্রার বিষয়টি আজও বিস্ময়কর। মসজিদটি নির্মাণের সময় ১০ ইঞ্চি, ৭ ইঞ্চি, ৬ ইঞ্চি ও ৫ ইঞ্চি মাপের লাল পোড়ামাটির ইট ব্যবহার করা হয়েছে। মসজিদের চারকোণে ৪টি টারেট রয়েছে। যা অষ্টাভূজাকৃতির। এবং ভেতরের মেহরাব বেশ অলংকৃত করা।
এ বিষয়ে মসজিদ কমিটির সহসভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার দেলোয়ার হোসেন মিলন জানান, এ মসজিদে নামাজ আদায় করে মুসল্লিরা বিশেষ শান্তি পান। তাই পর্যটক ছাড়াও দূরদূরান্তের মুসল্লিরা আসেন এখানে নামাজ আদায় করতে। মসজিদটি এতো প্রাচীন তারপরও ভেতরে বেশ শান্ত-শীতল পরিবেশ। কোনো জানালা নেই, অথচ প্রচণ্ড তাপদাহেও ভেতরে গরম নেই।
মসজিদের পশ্চিম দিকের বাড়িতে বাসিন্দা খন্দকার দেলোয়ার হোসেন মিলন জানান, অনেকের ধারণা জানালাবিহীন মসজিদ হতেই পারে না। হয়তো পরে এটি আটকে দিয়েছে। কিন্তু বহু বছর আগে বড় বড় মেশিনপত্র এনে বিদেশি একটি বিশেষজ্ঞদল এখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছেন, মসজিদটির মূল নকশাই জানালাবিহীন। এ পুরো মসজিদে পোড়া মাটির ইটের সঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছে চুন, সুরকি আর তেঁতুলের পানি। প্রায় ৫৪০ বছর আগে তৈরি ভবনে এখনো সুন্দরভাবে নামাজ আদায় করা যাচ্ছে।
স্থাপত্যকলা অনুযায়ী মসজিদ ভবনটির সস্মুখভাগে খিলান আকৃতির প্রবেশপথ রয়েছে। প্রবেশপথের ওপরে ফার্সি অক্ষরের খোদাই করে কালো পাথরের ফলক লাগানো আছে। মূল দেয়াল থেকে সামনের দিকে অগ্রসর হলে চার কোনায় চারটি ত্রিভুজ আকৃতির স্তম্ভ চোখে পড়বে। ভেতর মেহরাবটির দুই পাশে দুইটি দেয়ালে রেকের মত খোদাই করা কারুকাজ রয়েছে। মেঝেতে ইট বিছানো। মসজিদের খিলান দরজা, স্তম্ভের পাদদেশে মেঝে ও ছাদের কার্নিশের তলা দিয়ে পাতলা ইট কেটে মুসলিম স্থাপত্যকলার নকশা লক্ষ্য করা যায়। মসজিদের প্রবেশ পথের দুই পাশে ও উত্তর-দক্ষিণের দেয়ালে ইটের ফলকের সুদৃশ্য কারুকাজের উপস্থিতি বিদ্যমান।
ইতিহাসের চোখে বাবা আদম মসজিদ:
উপমহাদেশে সেন শাসনামলে ১১৭৮ সালে ধলেশ্বরীর তীরে মুন্সীগঞ্জের মিরকাদিমে আসেন শহীদ বাবা আদম। এখন মুন্সীগঞ্জ জেলাধীন সদর উপজেলার মিরকাদিম পৌরসভার দরগাবাড়ি নামে পরিচিত এলাকাটি। বাবা আদমের দরগার পাশেই তাকে সমাহিত করা হয়। বাবা আদমের দরগা অনুসারেই নামকরণ হয় দরগাবাড়ি। তার মৃত্যুর ৩১৯ বছর পর সে দরগাবাড়িতে সুলতান জালালুদ্দিন ফতেহ শাহ শাসন আমলে ১৪৮৩ সালে মালেক কাফুর এ মসজিদ নির্মাণ করেন। কারুকার্যখচিত মসজিদটির নির্মাণে মালিক কাফুরশাহের সময় লেগেছিল চার বছর।
পর্যটকদের চোখে বাবা আদম মসজিদ:
পর্যটক মহফুজ হাফিজ জানান, প্রধান সড়ক থেকে মসজিদটি সামান্য ভেতরে। সামনে নানান স্থাপনাও আছে। ফলে প্রত্নসম্পদ এ মসজিদ প্রায় আড়ালে পড়ে আছে। এছাড়া মসজিদটির সামনে বাথরুমসহ অন্যান্য সুবিধার নামে দ্বিতল যে স্থাপনাটি অর্ধনির্মিত অবস্থায় পড়ে আছে। এটিও সুন্দর্য নষ্ট করছে। মসজিদের ভেতরে প্রবেশের সড়কটিও সরু। ফলে প্রধান সড়কে পর্যটকরা গাড়ি পাকিং করে ভেতরে যেতে হয়। এটা মোটেও পর্যটক বান্ধব নয়।
দ্বিতল স্থাপনা প্রসঙ্গে মসজিদ কমিটি জানায়, একজনের দানে এটি করা হচ্ছিল। পরে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। আর এর সামনে একবারে সিপাহিপাড়া-রিকাবীবাজার রাস্তা ঘেষা শহীদ সৈয়দ বাবা আদম (র.) এর সমাধি। এখানেও আধুনিক পাকা স্থাপনা করা হয়েছে।
পর্যটকদের দাবি পুরোনো কম্পাউন্ডটিই যথাযথভাবে পরিকল্পনা মাফিক যত্ন করা হলে পুরাকীর্তিটি পর্যটকদের আরও বেশি আকৃষ্ট করবে। এতে দেশি-বিদেশি পর্যটক বাড়বে।
প্রত্নসম্পদের প্রত্নতাত্ত্বিক অবহেলা:
মুসলিম ঐতিহ্যের চোখজুড়ানো এ শৈল্পিক স্থাপনার গায়ে এখন শুধুই অযত্ন-অবহেলার ছাপ। তৎকালীন ভারতবর্ষে যেকয়টি প্রাচীন মসজিদ ছিল, সেগুলোর একটি বাবা আদম মসজিদ। সংশ্লিষ্টরা জানায়, ১৯০৯ সালের পর আর এর কোনো সংস্কার কাজ হয়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ভারতবর্ষ প্রত্ন জরিপ বিভাগ ১৯০৯ সালে মসজিদটি সংস্কার করে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু এরপর আর কোনো কাজ হয়নি। পরে ১৯৪৮ থেকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর এ স্থাপনার তত্ত্বাবধায়ন করছে। কিন্তু সাইনবোর্ড টাঙিয়েই যেন খালাস। মসজিদটি সংস্কার সুরক্ষায় কোনো পদক্ষেপ নেই। পরে ১৯৯১ সালে লোহার সীমানা দেয় বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর। এই পর্যন্তই শেষ।
মসজিদটির পেশ ইমাম মাওলানা মাহবুবুর রহমান সালেহী বলেন, ‘মসজিদটির স্থায়িত্ব রাখার জন্য এখন কিছু সংস্কার করা গেলো ভালো হয়। কারণ প্রাচীন এ মসজিদের দক্ষিণ-পশ্চিম দেয়ালে সামান্য ফাটল দেখা দিয়েছে। এছাড়া কয়েকটি স্থানে ইট খুলে গেছে। তবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের নিষেধ থাকায় কারও পক্ষেই এর ওপর হাত লাগানোর সুযোগ নেই। কিন্তু প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর কোনো রকম কাজই করছে না। মসজিদে অনেক মুসল্লি নিয়মিত জামাতে নামাজ আদায় করেন। কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করছি।’
কে এই বাবা আদম:
১০৯৯ সালে সুদূর আরবের পবিত্র মক্কা নগরের অদূরে তায়েফে জন্মগ্রহণ সাধক পুরুষ বাবা আদম। আধ্যাত্মিক জ্ঞান সাধনায় তিনি বড় পীর হজরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)-এর সাহচর্য পান। পরে জন্মভূমি ছেড়ে ইসলাম ধর্ম প্রচারে ভারতবর্ষে এসেছিলেন এ আধ্যাত্মিক সাধক। উপমহাদেশে তখন সেন শাসন চলছে। ১১৭৮ সালে ধলেশ্বরীর তীরে মুন্সীগঞ্জের মিরকাদিমে আসেন তিনি। তখন বিক্রমপুর তথা মুন্সীগঞ্জ ছিল বল্লাল সেনের রাজত্ব। ওই বছরেই বল্লাল সেনের হাতে প্রাণ দিতে হয় বাবা আদমকে। পরে তার দরগার পাশেই তাকে সমাহিত করা হয়। বাবা আদমের মৃত্যুর ৩১৯ বছর পর তার সমাধির পাশেই নির্মাণ করা হয় আজকের মুসলিম ঐতিহ্যের অনন্য নিদর্শন বাবা আদম মসজিদ।
এ বিষয়ে পেশ ইমাম মাওলানা মাহবুবুর রহমান সালেহী বলেন, ‘বল্লাল সেন মিরকাদিমের কানাই নগরে বাবা আদমের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে গিয়ে মল্ল যুদ্ধের আহ্বান করেন। কিছুদিন পরে দরগাবাড়িতে বাবা আদম শহীদের প্রতিষ্ঠিত খানকা শরীফে (যেখানে বর্তমানে মসজিদ) এশার নামাজরত অবস্থায় বা নামাজের পর মোরাকাবা অবস্থায় বিশ্বাসঘাতকতা করে বল্লাল সেন বাবা আদমকে তলোয়ার দিয়ে আঘাত করেন। এতে বাবা আদম শহীদ হন। কিন্তু নির্বংশ হন বল্লাল সেন।’
বল্লাল সেনের নির্বংশ হওয়ার বিষয়ে পেশ ইমাম সালেহী বলেন, ‘ওই সময়ে কবুতরকেই বার্তাবাহক হিসাবে ব্যবহার করা হতো। রাজবাড়িতে বল্লাল সেনের নির্দেশনা ছিল, ধুতিতে রাখা কবুতর উড়ে আসলেই বোঝা যাবে বাবা আদমের সঙ্গে যুদ্ধে তিনি পরাজিত হয়েছেন। আর সবাই যেন আত্মাহুতি দেন। কিন্তু বল্লাল সেন যুদ্ধে পরাজিত না হলেও রক্ত ধোয়ার জন্য পাশের জলাশয়ে গেলে কবুতর উড়ে বাড়ি চলে যায়। এ দেখে বল্লাল সেনও দৌড় শুরু করেছিলেন। কিন্তু স্বভাবিকভাবেই কবুতর আগে রাজবাড়ি পৌঁছে যায়। বল্লাল সেন বাড়ি ফিরে দেখেন রাজ পরিবারের সবাই আগুনের কুণ্ডলিতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মাহুতি দিয়েছে, এ দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে তিনিও একইভাবে আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মাহুতি দেন।’
স্থানীয়রা কহেন:
স্থানীয়রা জানায়, বাবা আদমের মতো সাধক তাদের মাটিতে শুয়ে আছে এটি তাদের জন্য গৌরবের। মুসলিম স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন তাদের অঞ্চলের মান মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছে। পাঁচ শতাধিক বছরের আগে নির্মিত এ ছয় গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ সুলতানি আমলের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে ইতিহাসের সঙ্গে এ অঞ্চলের মানুষ জড়িয়ে আছে। পর্যটকদের বিচরণ তাদের আনন্দিত করে। এছাড়া প্রতিটি জুম্মা যেন ঈদের আনন্দ দেয়।
যেভাবে পৌঁছানো যাবে:
মুন্সীগঞ্জ শহর থেকে উত্তর-পশ্চিমে চার কিলোমিটার পথ পেরোলেই মিরকাদিম দরগাবাড়িতে অবস্থিত বাবা আদম মসজিদ। আর ঢাকা থেকে সড়কপথে মসজিদের দূরত্ব মাত্র ২৮ কিলোমিটার। সদরঘাট থেকে নৌপথে মিরকাদিমের কাঠপট্টি ঘাটে নামার পর আধা কিলোমিটারের মধ্যেই মসজিদটি। সদরঘাট থেকে কাঠপট্টি ঘাট এক ঘণ্টার পথ।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।