আন্তর্জাতিক ডেস্ক : যুক্তরাষ্ট্রের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক পিউ রিসার্চ সেন্টারের বিশ্বব্যাপী এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ভারতের অনেক মানুষ একনায়কতন্ত্র এবং দেশে সেনাবাহিনীর শাসন চাইছেন। বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিকদের একাংশের এই মতামতে অনেকেই বিস্মিত। তবে সেনাবাহিনীর সাবেক সদস্যরা বলছেন, ভারতের মতো দেশে সেনাবাহিনীর শাসন কখনোই সম্ভব নয়।
পিউ রিসার্চ সেন্টার পৃথিবীর ২৪টি দেশে এই সমীক্ষা চালিয়েছে, যার নাম ‘Representative Democracy Remains A Popular Ideal, but People Around the World Are Critical of How It’s Working’, অর্থাৎ প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র জনপ্রিয় আদর্শ, তবে যেভাবে গণতন্ত্র কাজ করছে, তা নিয়ে বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষের সমালোচনা আছে।
এই সমীক্ষার প্রতিবেদনে অ-গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পক্ষে ভারতীয়রাই সব থেকে বেশি মতামত দিয়েছেন।
পিউ রিসার্চ সেন্টার বলছে, ভারতে যাদের সাথে তারা কথা বলেছেন, তার মধ্যে ৬৭ ভাগ মানুষ একনায়ক-তান্ত্রিক শাসন চেয়েছেন। এর আগে ২০১৭ সালে ৫৫ ভাগ মানুষ একনায়কতন্ত্র চেয়েছিলেন।
আবার যে দেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি সেনা শাসন চেয়েছেন, সেই স্থানেও ভারত রয়েছে। ভারতের ৭২ ভাগ মানুষ চান সেনাবাহিনীই শাসন করুক।
সমীক্ষায় উঠে এসেছে, স্বল্প আয়ের মানুষরাই বেশি করে একনায়কতন্ত্রের দিকে ঝুঁকেছেন। আবার বেশি শিক্ষিতদের তুলনায় কম পড়াশোনা জানা মানুষও একনায়কতান্ত্রিক শাসন চাইছেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রতি অনুকূল মনোভাব দেখিয়েছেন ৭৯ ভাগ মানুষ। তিনি এই দিক দিয়ে বিশ্বের তৃতীয় জনপ্রিয় নেতা।
আবার বিরোধী নেতাদের প্রতি অনুকূল মনোভাবের হিসেবে ৬২ ভাগ মানুষের রায় পেয়ে বিশ্বে দু’নম্বর স্থানে রয়েছেন রাহুল গান্ধী।
কেন সেনাশাসন, একনায়কতন্ত্র?
পিউ রিসার্চ সেন্টার ভারতে ঠিক কতজনের মধ্যে সমীক্ষা চালিয়েছে, তা পরিষ্কার করে জানায়নি।
তবে তারা এটা বলেছে, যেসব দেশেই তারা এই সমীক্ষা চালিয়েছে, সেখানে উত্তরদাতাদের এমন ভাবে বাছা হয়েছে যাতে একটা প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি উঠে আসে।
এই তথ্য সামনে আসার পরে বিশ্লেষকরা বলছেন, উত্তরদাতাদের সংখ্যাটা জানা জরুরি।
তবে একনায়কতন্ত্র বা সেনাশাসন চাইবার মনোভাবকে একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিশ্লেষকরা।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমন কল্যাণ লাহিড়ীর কথায়, ‘একনায়কতন্ত্র বা সেনাবাহিনীর শাসন চাওয়ার পিছনে একটা সম্ভাব্য কারণ হতে পারে শাসকের ভূমিকা নিয়ে অসন্তুষ্টি।’
তিনি বলেন, ‘মানুষের দৈনন্দিন চাহিদার সঙ্গে রাষ্ট্রের ভূমিকার একটা সংঘাত ঘটছে। দুর্নীতি, কর্মক্ষয়ের মতো বিষয়গুলি তো এখন সামনে আসছে। সে কারণে হয়তো অনেকে মনে করছেন সেনাবাহিনীর হাতে শাসন ক্ষমতা গেলে সুষ্ঠুভাবে দেশ পরিচালিত হবে, দুর্নীতি দূর হবে, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে।’
‘তবে বৃহৎ প্রেক্ষাপটে দেখতে গেলে সামরিক বাহিনীর হাতে কোনও দেশের শাসন ব্যবস্থা কিন্তু কখনওই কাম্য নয়। তারা যদি একবার প্রশাসন হাতে নিয়ে নেয়, তা গণতন্ত্রের জন্য ভয়ঙ্কর এক বার্তা দেবে’, বলছিলেন অধ্যাপক লাহিড়ী।
সেনাবাহিনী কি প্রস্তুত?
ভারতের সামরিক বাহিনীর একটা সুনাম আছে যে তারা কোনো দিনই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েনি। যদিও অতি সম্প্রতি কয়েকজন শীর্ষ সেনা অফিসারের কিছু রাজনৈতিক মন্তব্য বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল।
কিন্তু তার বাইরে কখনোই রাজনৈতিক নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করেনি সামরিক বাহিনী।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার প্রবীর সান্যাল বলছিলেন, ‘ক্যাডেট এবং জুনিয়ার অফিসার থাকার সময় থেকেই বাহিনীতে আমাদের শিক্ষা দেয়া হয় যে রাজনীতি এবং রাজনৈতিক নেতাদের থেকে যাতে আমরা দূরত্ব বজায় রাখি।’
তিনি বলেন, ‘আমি প্রায় ৪০ বছর কাজ করেছি সেনাবাহিনীতে, আমরা এটাই সবসময়ে মাথায় রেখেছি যে রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে হবে।’
‘আর দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করতে গেলে তো সামরিক বাহিনীকে ক্যু করতে হবে। সেটা ভারতে কখনওই হবে না। দেশে তো মানেকশ, কারিয়াপ্পার মতো ক্ষমতাসীন সেনা কমান্ডারেরা ছিলেন, তবুও তারা সব সময়েই তাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি অনুগত থেকেছেন’, বলছিলেন ব্রিগেডিয়ার সান্যাল।
ভারতে সেনা শাসন অসম্ভব
ব্রিগেডিয়ার প্রবীর সান্যাল জানাচ্ছিলেন, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নানা অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে সামরিক বাহিনীকে নামতে হয় ঠিকই, কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই আবারো বেসামরিক প্রশাসনের হাতে দায়িত্ব ফিরিয়ে দিয়ে ব্যারাকে ফিরে যায় বাহিনী।
‘সাধারণ মানুষের একাংশ চাইতেই পারেন যে দেশে সামরিক শাসন চালু হোক, কিন্তু আমার মনে হয় না, সেনাবাহিনী প্রশাসন চালানোর ঝুঁকি নেবে। অন্তত আমার জুনিয়ার অফিসারদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ আছে, তাদের কারও মনে এরকম কোনও ইচ্ছাও নেই’, বলছিলেন ব্রিগেডিয়ার প্রবীর সান্যাল।
অবশ্য, ভারত-শাসিত কাশ্মির এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কিছু এলাকায় বহু বছর ধরেই সেনাবাহিনী মোতায়েন রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে।
আবার নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও অবসরপ্রাপ্ত কমান্ডো অফিসার দীপাঞ্জন চক্রবর্তী মনে করেন যারা সামরিক শাসনের পক্ষে রায় দিয়েছেন, তারা সম্ভবত বৃহত্তর প্রেক্ষিত না বুঝেই ওই কথা বলেছেন।
প্রতিবেশী দেশগুলোতে সামরিক শাসনের ফলে কী পরিস্থিতি হয়েছে অতীতে, তা বোধহয় তারা বোঝেননি বলেও মনে করেন তিনি।
চক্রবর্তীর কথায়, ‘দেশে যখন জরুরি অবস্থা জারি হয়েছিল, এখনও অনেকে বলেন যে হ্যাঁ ওরকমটাই দরকার ছিল ভারতে।’
“সরকারি দপ্তরে কেউ ঘুষ খাচ্ছে না, সময় মতো সবাই অফিসে আসছে, ট্রেন একেবারে ঘড়ির কাঁটা ধরে চলছে। এগুলো ইতিবাচক দিক ঠিকই, তবে সেটাও তো ভোটে কোনও প্রভাব ফেলতে পারেনি। ইন্দিরা গান্ধী তো হেরে গিয়েছিলেন।”
‘সব থেকে বড় কথা, ভারতের মতো দেশে কোনো সামরিক শাসন চলতেই পারবে না। এত বিবিধতা এখানে, সংস্কৃতি হোক বা রাজনীতি, তা সামলানো সামরিক বাহিনীর পক্ষে সম্ভব নয়। মানুষ বলেছে হয়তো, কিন্তু বোধহয় পুরো প্রেক্ষাপট না বুঝেই তারা জবাব দিয়েছে’, বলছিলেন চক্রবর্তী।
‘ভবিষ্যতের কোনও একনায়ক …’
একনায়কতান্ত্রিক শাসন বা সামরিক শাসন নিয়ে অন্যান্য দেশের মানুষের মতামতের সঙ্গে ভারতের মতামত এমন একটা সময়ে তুলে আনা হল, যখন ভারতের সংবিধান বদল করা নিয়ে মন্তব্য করছেন হিন্দুত্ববাদী নেতারা।
আবার সব রাজ্য বিধানসভা এবং লোকসভার ভোট একসঙ্গে করা যায় কি না, তা নিয়েও চিন্তাভাবনা চলছে।
সমাজতত্ববিদ ও কলকাতার প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমিরেটাস অধ্যাপক প্রশান্ত রায়ের প্রশ্ন, ‘ভবিষ্যতের কোনো একনায়ক এই সমীক্ষার তথ্য থেকে সুবিধা নেবেন না তো?’
তিনি বলেন, ‘আগামী দিনে কোনো একনায়ক হয়তো এই সমীক্ষার তথ্য দেখিয়েই বলবেন যে দেশের মানুষই তো একনায়কতন্ত্র চেয়েছেন, খুব শক্তিশালী একজন দেশনেতা চেয়েছেন, তারাই তো তো সামরিক শাসনের পক্ষে রায় দিয়েছিলেন।’
‘আর তাই দেশ আমিই একা শাসন করব। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আর চলবে না’, বলছিলেন অধ্যাপক রায়।
তিনি বলেন, ‘এক্ষেত্রে চীনের উদাহরণও টেনে আনতে পারেন ভবিষ্যতের কোনো একনায়ক। সেখানে কমিনিউস্ট পার্টির নির্দেশে দেশ চলে, সেখানকার উন্নয়নের মাত্রা উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরা হতে পারে ভারতের মানুষের সামনে।’
তবে সব বিশ্লেষকেরই এই বিশ্বাস আছে যে ভারতে গণতান্ত্রিক কাঠামো এতটাই মজবুত যে এখানে সামরিক বাহিনীর অথবা কোনো একনায়কের পক্ষে দেশের দায়িত্ব নিয়ে নেয়া খুবই কঠিন হবে।
সূত্র : বিবিসি
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।